লোকসভা নির্বাচন: ‘কিংমেকার’-এর ভূমিকায় নীতিশ কুমার, চন্দ্রবাবু নাইড়ু
আজ মঙ্গলবার ভারতের লোকসভা নির্বাচনের ফল ঘোষণা করা হচ্ছে। যেখানে এককভাবে এপর্যন্ত ২৪১টি আসনে জয় পেয়েছে বিজেপি। অন্যদিকে, বিজেপি নেতৃত্বাধীন জোট আজ রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত ২৯১টি আসনে এগিয়ে রয়েছে বলে জানিয়েছে দেশটির গণমাধ্যম। সরকার গঠনে দরকার ২৭২ আসন। ফলে জোট ছাড়া আর একক সংখ্যাগরিষ্ঠতায় সরকারে যাওয়া সম্ভবত হচ্ছে না বিজেপির।
সরকার গঠনও নির্ভর করছে শরীকদের এনডিএ জোটেই থাকার ওপর। এরমধ্যে বিহারের নীতিশ কুমারের জনতা দল-ইউনাইটেড (জেডি–ইউ) এ পর্যন্ত এগিয়ে রয়েছে ১৪ আসনে। আর অন্ধ্র প্রদেশে চন্দ্রবাবু নাইডুর তেলেগু দেশম পার্টি (টিডিএম) এগিয়ে রয়েছে ১৬ আসনে। এনডিএর ঝুলি থেকে সেই ৩০ আসন কমে গেলে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারাবেন মোদি।
এই বাস্তবতায়, ভারতের সত্তোরোর্ধ এ দুই রাজনীতিবিদও ফিরেছেন 'কিংমেকারের ভূমিকায়। এবারের সাধারণ নির্বাচনেও বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতায় সরকার গঠন করবে, এমন অনুমান করে নির্বাচনের আগে যাদের বাতিলের খাতাতেই রেখেছিলেন ভারতের রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের বড় অংশ। তবু, 'পুরোনো চাল– ভাতে বাড়ে' এই আপ্তবাক্যই এবার সত্যি হচ্ছে নীতিশ কুমার ও চন্দ্রবাবু নাইড়ুর ক্ষেত্রে।
নির্বাচনে বিরোধী দলগুলোর জোট 'ইন্ডিয়া' চমক দেখিয়েছে। এপর্যন্ত তাঁরা ২৩৩ আসনে এগিয়ে রয়েছে বলে জানা যাচ্ছে। এই বাস্তবতায় নীতিশ ও চন্দ্রবাবুর সমর্থন পেলে ইন্ডিয়া জোট লোকসভার আসনসংখ্যায় বিজেপিকে ছাড়িয়ে যাবে। কংগ্রেসের পক্ষ থেকে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে বলেও জানা গেছে।
অর্থাৎ, নতুন সরকার গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে চলেছেন নীতিশ, নাইড়ু।
এই প্রেক্ষাপটে তাঁদের 'কিংমেকার' অথবা 'আগামীর রাজা' – যেটাই বলুন কেন, আজ ৪ জুন ইতিহাসে পরিণত হওয়ার আগেই দেখা যাবে রাজনীতির পাশায় নতুন দান। নীতিশ ও চন্দ্রবাবুকে দুই জোটের পক্ষ থেকেই নতুন সরকারে আরো গুরুত্বপূর্ণ পদের প্রস্তাব দেওয়া হবে। বিজেপির কাছে এরমধ্যেই চন্দ্রবাবু নাইড়ুর কদর বেড়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এরমধ্যেই তাঁকে ফোন করেছেন বলে জানা গেছে। এনডিএ জোটের অস্তিত্ব ধরে রাখাই এসব ফোনালাপে প্রাধান্য পেয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
নাইড়ু, নীতিশ কোন পক্ষকে সমর্থন দেবেন?
অভিজ্ঞ এ দুই রাজনীতিক– দিন শেষে কোন পক্ষকে সমর্থন দেবেন এই হিসাবনিকাশেই আটকে আছে এনডিএর সরকার গঠন। একই প্রশ্ন ভারতের রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মুখে মুখে ফিরছে। নীতিশ, নাইড়ুর সমর্থনে ইন্ডিয়া জোট– এনডিএ'র সরকার পতনের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করবে কিনা–সে প্রশ্নও উঠছে।
উপরে উপরে এনডিএ জোটের অবিচ্ছেদ্য অংশ এ দুই আঞ্চলিক নেতা। কিন্তু, ভোটযুদ্ধের ফলে ইন্ডিয়া জোট যেভাবে শক্তি অর্জন করছে, তাতে নতুন জোটবন্ধনের সম্ভাবনাও জোরালো হচ্ছে। টেলিভিশন চ্যানেলের স্টুডিও থেকে শুরু করে রাজনৈতিক দলগুলোর রুদ্ধদ্বার সভাগুলোতে – এই আলোচনা এখন সর্বত্র।
জোট-বদলে নীতিশের ট্র্যাক-রেকর্ডের জুড়ি মেলা ভার। নির্বাচনের আগে তাঁর স্বাস্থ্যের অবনতির কথা শোনা যাচ্ছিল, নির্বাচনের সময় বড় কিছু জনসভাতেও তাঁকে দেখা যায়নি। এমনকী বিহারের পাটনায় মোদি যখন তাঁর চতুর্থ জনসভা করেন, তখনও সেখানে যাননি নীতিশ। নির্বাচনের আগে হয়তো আত্মবিশ্বাসের ঘাটতিতে পড়েছিলেন নীতিশ। তবে ঘোষিত ফলাফল নতুনভাবে উজ্জীবিত করবে তাঁকে, এই আত্মবিশ্বাসে ভর করে তিনি কি এবার ভবিষ্যতের নির্ধারক হয়ে উঠবেন? বিহারে তাঁর দল জেডি–ইউ জয় পেয়েছে, এবার কী দলটি ভারতের জাতীয় রাজনীতিতেও মূল খেলোয়াড় হিসেবে নাম লেখাবে? খুব সম্ভবত এমনটাই হতে চলেছে।
জেডি–ইউ নেতারা অবশ্য বলছেন, এবার তাঁরা পক্ষ বদল করবেন না। দলের নেতা নীরাজ কুমার বলেন, "আমরা এনডিএ'র সাথেই থাকব, জোটবদ্ধ হওয়ার অর্থ বোঝেন নীতিশ কুমার, বিরোধী জোট তাঁর সম্পর্কে ভুল ধারণা করেছে।"
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিহারের একজন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক বলেন, "সুদূর দিল্লিতে বসে কারো পক্ষে নীতিশ কুমারের রাজনৈতিক শক্তিসামর্থ্যের আন্দাজ করা সম্ভব নয়। তিনি তৃণমূলের মানুষ ও সমর্থকদের কথা শোনেন – যাদের অধিকাংশই হতদরিদ্র ও সুবিধা-বঞ্চিত। ওরাই তাঁকে অবিচল সমর্থন দিয়ে আসছে।"
ভারতীয় বার্তাসংস্থা পিটিআই জানিয়েছে, কংগ্রেস ও বিজেপি উভয় দলের পক্ষ থেকেই এখন নীতিশের কাছে ধর্না দেওয়া হচ্ছে। এমনকী নীতিশকে এনডিএ জোটের আহ্বায়ক হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে বিজেপি। ভারতের রাজনীতিতে তাই আরো একবার কিস্তিমাত করার অবস্থানে আছেন বিহারের নয়বারের এই মুখ্যমন্ত্রী।
চন্দ্রবাবু নাইড়ু অন্ধ্র প্রদেশের মানুষের কাছে সিইও- মুখ্যমন্ত্রী হিসেবেই একসময় পরিচিত ছিলেন। নতুন ভবিষ্যৎ নির্মাণে নিজের সামর্থ্য ও রাজনৈতিক দক্ষতার পরিচয় তারও রয়েছে। ২০০০ এর দশকের শুরুতে মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময় আইটি ও ডিজিটাল প্রযুক্তিকে জনপ্রশাসনে যুক্ত করা প্রথম মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন তিনি ভারতে। রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি আর অভিজ্ঞতাতেও তিনি সমৃদ্ধ।
অন্ধ্র প্রদেশের ১৬ আসনে তেলেগু দেশম পার্টি এগিয়ে রয়েছে। বিজেপি রয়েছে মাত্র ৩টিতে। এই অবস্থায়, রাজনীতির নিলামে চড়া দর হাঁকতে তাঁর বাধা নেই।
ভালোবেসে সমর্থকরা তাঁকে ডাকেন শুধু 'বাবু' নামে। অভিনেতা থেকে রাজনীতিতে নাম লেখানো এন টি রাও ছিলেন তাঁর শ্বশুর। চন্দ্রবাবু রাজ্য ও জাতীয় পর্যায়ের রাজনীতিতে বিভিন্ন দলের সাথে জোটবদ্ধ হয়েছেন আগেও। এবার নয়াদিল্লির ক্ষমতার মঞ্চে তিনি নিজেকে বা দলের কাউকে বসান কিনা– সেটিও লক্ষ করবার বিষয়।
অনুবাদ: নূর মাজিদ