বিদেশি দক্ষ কর্মীদের করছাড় সুবিধা দেওয়ার পরিকল্পনা করছে জার্মানি
দক্ষ কর্মী সংকট মোকাবিলায় বিদেশি কর্মীদের জন্য করছাড় সুবিধা দেওয়ার পরিকল্পনা করছে জার্মানি। জার্মান সরকার আশা করছে, কোম্পানিগুলোর জন্য কর সুবিধা, অবসরের আগে যারা বেশি সময় কাজ করেন তাদের জন্য প্রণোদনা এবং আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সহজ করার মতো পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে দেশটিকে বিদেশি কর্মীদের নিকট ব্যবসার জন্য আরও আকর্ষণীয় করে তুলতে পারবে।
জার্মানিতে দক্ষ কর্মীর অভিবাসন বাড়ানোর পরিকল্পনাও রয়েছে। ফেডারেল অর্থমন্ত্রী ক্রিশ্চিয়ান লিন্ডনার ৫ জুলাই বলেন, 'আমরা বিদেশি পেশাদারদের জার্মানিতে তাদের প্রথম তিন বছরে কর রেয়াতের ব্যবস্থা করছি। যারা যোগ্য বিশেষজ্ঞ হিসাবে এখানে আসবেন তাদের জন্য ৩০ শতাংশ, ২০ শতাংশ এবং ১০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় থাকবে।'
তবে অনেক জার্মানরাই এই পরিকল্পনাকে ভালোভাবে নেননি। বিরোধী রাজনীতিবিদ এবং ট্রেড ইউনিয়নবাদীদের সমালোচনায় জর্জরিত জার্মান সরকার। 'দেশীয় শ্রমিকদের বিরুদ্ধে নির্লজ্জ বৈষম্য', 'সামাজিক শান্তির জন্য হুমকি' এবং 'এখানে সবার জন্য বৈরী নীতি'— এরকম নানা মন্তব্য ধেয়ে এসেছে এই পরিকল্পনার বিরুদ্ধে।
সমালোচনা এসেছে সরকারি দল গ্রিন পার্টির ভেতর থেকেও। তারা জার্মান সংবিধান এবং শ্রম আইনে সমান আচরণের নীতি উদ্ধৃত করে যুক্তি দিয়েছেন যে, কর প্রণোদনার কারণে একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর একই কাজের জন্য আরও বেশি উপার্জন করার সুযোগ তৈরি করে দেয়া অসাংবিধানিক হতে পারে।
গ্রিন পার্টির আইনপ্রণেতা বিট মুলার-জেমেকে ডয়চে ভেলেকে বলেন, দেশের সংবিধান অনুযায়ী সব মানুষ আইনের চোখে সমান। জার্মানিতে আমাদের সমান আচরণের নীতি রয়েছে, যার অর্থ কারও সাথে খারাপ আচরণ করা উচিত নয়। আমার দৃষ্টিকোণ থেকে, এটি নাগরিকদের বিরুদ্ধে কিছুটা বৈষম্যমূলক হবে যদি আমরা বলি যে যারা অন্য দেশ থেকে আসে তারা তাদের বেতনের কমপক্ষে একটি নির্দিষ্ট অংশে কর প্রদান থেকে অব্যাহতি পাবে।
কর ছাড় নিয়ে সমালোচনা
ক্ষমতাসীন জোটের অন্যতম সমালোচক হলেন চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎসের মধ্য-বাম সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট পার্টির (এসপিডি) ফেডারেল শ্রমমন্ত্রী হুবার্টাস হেইল। ডয়েচল্যান্ডফাঙ্ক পাবলিক রেডিওতে তিনি বলেন, 'আমাদের এ বিষয়ে গভীরভাবে নজর দিতে হবে। জনমনে যাতে কোনো ভুল বোঝাবুঝি না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে'।
এসব সমালোচনা এফডিপির জন্য হতাশাজনক, কারণ তারা জার্মানির অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার জন্য কয়েক মাস ধরেই চেষ্টা করছে। অ্যাসোসিয়েশন অব জার্মান চেম্বারস অব ইন্ডাস্ট্রি অ্যান্ড কমার্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মার্টিন ওয়ানস্লেবেন বলেন, বর্তমান পরিস্থিতি কোম্পানিগুলোর জন্য খারাপ; ইন্ডাস্ট্রির ক্ষেত্রে এটা আরও খারাপ।
কয়েক বছর ধরে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো জার্মানিতে দক্ষ কর্মীর ব্যাপক ঘাটতি। বয়স্ক ব্যক্তিরা অবসর নিচ্ছেন এবং তরুণ কর্মীর সংখ্যা তুলনামূলক কম। অর্থনীতিবিদরা এখন বলছেন, এই ঘাটতিই ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য সবচেয়ে বড় ঝুঁকি।
অভিবাসনে উৎসাহিত করা
জার্মান ইকোনমিক ইনস্টিটিউটের একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, জার্মানিতে প্রায় ৫ লাখ ৭৩ হাজার দক্ষ শ্রমিকের ঘাটতি রয়েছে। অর্থনীতিবিদরা অনুমান করেছেন যে, যদি পর্যাপ্ত শ্রমিক থাকতো, তবে এই বছরের অর্থনৈতিক বৃদ্ধি প্রায় ১% (৪৯ বিলিয়ন ইউরো বা ৫৩ বিলিয়ন ডলার) অধিক হতো। যেহেতু ২০২৪ সালের জন্য মাত্র ০.২% বৃদ্ধির হারের পূর্বাভাস করা হয়েছিল, তাই এটি জার্মানির অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত।
২০২০ সালে, সরকার স্কিলড ইমিগ্রেশন অ্যাক্ট চালু করেছিল, যা প্রতিনিয়ত হালনাগাদ করা হয়েছে। এর লক্ষ্য ছিল বিদেশি শ্রমিকদের জার্মানিতে আসা আরও সহজ করে দেয়া।
তবে, দক্ষ শ্রমিকের প্রত্যাশিত বৃদ্ধি বাস্তবায়ন হয়নি। ব্যারটেলসম্যান ফাউন্ডেশনের একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, ২০২২ সালে ইউইউ বাহ্যিক দেশগুলো থেকে প্রায় ৭০ হাজার দক্ষ কর্মী জার্মানিতে এসেছেন, যা ২০১৯ সালের পূর্ববর্তী রেকর্ড ৬৪ হাজার মানুষের তুলনায় বেশি। তবে, এটি এখনো তুলনামূলকভাবে অপর্যাপ্ত।
পরিকল্পিত কর ছাড় জার্মানিতে দক্ষ কর্মীদের আকৃষ্ট করার আরেকটি প্রচেষ্টা। তবে শ্রমমন্ত্রী হুবার্টাস হেইল জোর দিয়ে বলেছেন, ভিসা প্রক্রিয়াগুলো সহজতর করা, পেশাদার স্বীকৃতি উন্নত করা এবং ভাষাগত বাধা মোকাবেলা করাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
হেইল জার্মান ভাষাকে একটি উল্লেখযোগ্য বাধা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। দক্ষ অভিবাসীদের কাছে আকর্ষণীয় এমন প্রথম পাঁচটি দেশের মধ্যে জার্মানির অবস্থান পঞ্চম। এর উপরের চারটি দেশেরই ভাষা ইংরেজি।
ইইউ'র অন্তর্ভুক্ত কর্মীদের জন্য কর সুবিধা
২০১৮ সালে, গ্রিনরা বিরোধী দলে থাকার সময় তাদের সংসদীয় অনুরোধের জবাবে, ফেডারেল সরকার বিদেশী দক্ষ শ্রমিকদের জন্য ট্যাক্স বিরতির প্রস্তাবকারী দেশগুলোকে তালিকাভুক্ত করেছিল। এর মধ্যে রয়েছে বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, ফ্রান্স, আয়ারল্যান্ড, ইতালি, লাক্সেমবার্গ, মাল্টা, নেদারল্যান্ডস, অস্ট্রিয়া, পর্তুগাল, সুইডেন, স্পেন, যুক্তরাজ্য এবং সাইপ্রাস।
জার্মান সরকারের মুখপাত্র স্টিফেন হেবেস্ট্রেইট সোমবার এ তথ্য জানিয়েছেন। লন্ডন, প্যারিস, মিলানের মতো ফ্রাঙ্কফুর্টও আর্থিক কেন্দ্র। এই দেশগুলোর মতো ইউরোপের অন্যান্য দেশেও দক্ষ কর্মীদের আকৃষ্ট করতে কর প্রণোদনা ও নানা সুবিধা দিয়ে থাকে।
তবে হেবেস্ট্রেইট স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে ফেডারেল সরকার ভবিষ্যতে সমস্ত বিদেশি কর্মীদের কর সুবিধা দেওয়ার ইচ্ছা রাখে না। পরিকল্পনাটি নির্দিষ্ট কিছু খাত লক্ষ্য করে তৈরি করা হয়েছে, যার নির্দিষ্ট বিবরণ এখনও বিকাশাধীন রয়েছে।
উপরন্তু, এই পদ্ধতির লক্ষ্য অতি-ধনীদের অত্যধিক সুবিধা না দিয়ে দক্ষ কর্মীদের আকৃষ্ট করা। অতি ধনী ব্যক্তিরা যাতে কর ছাড়ের সুযোগ পেয়ে জার্মানিতে স্থানান্তরিত হতে উৎসাহিত না হন তা নিশ্চিত করার জন্য একটি সর্বোচ্চ সীমা থাকবে।
অনুবাদ: সাকাব নাহিয়ান শ্রাবন