'আমাদের হাতের ফোনও নিরাপদ কি না জানি না': ডিভাইস বিস্ফোরণে লেবাননজুড়ে আতঙ্ক
ওয়ারলেস ডিভাইসের দফায় দফায় বিস্ফোরণে আতঙ্কে পুরো লেবাননবাসী। মঙ্গলবারের পেজার-বোমা হামলায় নিহতদের শোক পালনের সময়, বৈরুতের দক্ষিণাঞ্চলীয় হেজবোল্লাহর ঘাঁটি দাহিয়াহতে আরেকটি বিস্ফোরণ ঘটে। এবার হিজবুল্লাহ সদস্যদের ব্যবহৃত ওয়াকি-টকি থেকে এই বিস্ফোরণগুলো ঘটেছে বলে জানা গেছে।
দ্বিতীয় দফার বিস্ফোরণে অন্তত ২০ জন নিহত ও ৪৫০ জনেরও বেশি আহত হয়েছে বলে জানিয়েছে দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এমন অবস্থায় দেশটিতে যোগাযোগের কোনো যন্ত্রকেই এখন আর নিরাপদ বলে বিবেচনা করা হচ্ছে না।
দাহিয়াহতে সংবাদ সংগ্রহ করতে গেলে হিজবুল্লাহর সমর্থকেরা বিবিসির প্রতিনিধিদের বেশ কয়েকবার বাধা দেন এবং ফোন বা ক্যামেরা ব্যবহার না করার দাবি জানান।
বিবিসি-র এক প্রযোজক তার এক বন্ধুর কাছ থেকে একটি বার্তা পান, যেখানে বলা হয়—তিনি তার লেবানিজ সিম কার্ড পরিবর্তন করে আন্তর্জাতিক নম্বরের সিম নিয়েছেন, কারণ তিনি আশঙ্কা করছেন যে তার ফোনও বিস্ফোরিত হতে পারে।
এভাবে একের পর এক ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস বিস্ফোরণের ঘটনা দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছে লেবাননবাসীকে। সারা দেশের অনেক মানুষই এখন ভাবছেন সামনে কী ঘটবে। এমনকি কেউ জানেন না তার অন্য মানুষের পাশে অবস্থান করাটাও এখন নিরাপদ কি না!
"সবাই আতঙ্কিত... আমরা জানি না ল্যাপটপ বা ফোনের পাশে থাকা নিরাপদ কি না। এখন সবকিছুই বিপজ্জনক মনে হচ্ছে এবং কেউই জানে না কী করতে হবে," বলেন গিধা নামের এক নারী।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া গুজব জনমনে বিভ্রান্তি আরও বাড়িয়ে তুলছে, যার মধ্যে একটি ছিল যে এমনকি সোলার প্যানেলও বিস্ফোরিত হচ্ছে।
আরেক নারী বলেন, "মানুষের মধ্যে ব্যাপক আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে এবং এই পরিস্থিতি সত্যিই ভয়ংকর"।
লেবাননের স্বাস্থ্য মন্ত্রী জানিয়েছেন, মঙ্গলবারের বিস্ফোরণগুলোতে ১২ জন নিহত হয়েছে, যার মধ্যে আট বছর বয়সী মেয়ে ও ১১ বছরের একটি ছেলে ছিল। আহত হয়েছে ২,৮০০ জন, যাদের মধ্যে শতাধিকের অস্ত্রোপচার প্রয়োজন।
ডা. এলিয়াস ওয়ারাক বলেন, মঙ্গলবারের বিস্ফোরণে আহতদের মধ্যে অন্তত ৬০ শতাংশের একটি চোখ নষ্ট হয়েছে এবং অনেকেই আঙুল বা পুরো হাত হারিয়েছেন। তিনি এটিকে তার চিকিৎসক জীবনের 'সবচেয়ে ভয়াবহ দিন' বলে উল্লেখ করেন।
তিনি আরও বলেন, "আমার মতে, হতাহতের সংখ্যা এবং ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা অত্যন্ত গুরুতর। দুর্ভাগ্যবশত, আমরা অনেকের চোখ রক্ষা করতে পারিনি, এবং চোখের পাশাপাশি কিছু রোগীর মস্তিষ্ক ও মুখমণ্ডলেও গুরুতর আঘাত লেগেছে।"
ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ লেবাননের হিজবুল্লাহ গোষ্ঠীর ৫,০০০ পেজারে বিস্ফোরক রেখেছিল বলে দাবি উঠেছে। গত মঙ্গলবার বিস্ফোরণের আগে কয়েক মাস আগে এই বিস্ফোরকগুলো বসানো হয় সূত্র জানিয়েছে।
এ পেজারগুলো বিস্ফোরণে লেবাননে ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং প্রায় ৩,০০০ জন আহত হয়েছে। হতাহতদের মধ্যে অনেকেই হিজবুল্লাহ ও ইরানের বৈরুতের প্রতিনিধি ছিল।
লেবাননের নিরাপত্তা সূত্র জানিয়েছে, পেজারগুলো তাইওয়ানের গোল্ড অ্যাপোলো কোম্পানি থেকে এসেছে। তবে কোম্পানিটি এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, তারা পেজারগুলো তৈরি করেনি। তাদের দাবি এগুলো বিএসি নামে একটি কোম্পানি তৈরি করেছে। তাদের ব্র্যান্ড ব্যবহারের লাইসেন্স রয়েছে।
এনিয়ে দাহিয়েহ'র এক যুবক বলেন, "শরীরে ও মনে অনেক যন্ত্রণা বোধ করছি। তবে এ ধরনের কষ্টের সাথে আমরা অভ্যস্ত এবং আমাদের প্রতিরোধ আমরা জারি রাখব,"
আরেক নারী বলেন, "এটা আমাদের আরও শক্তিশালী করবে। যে এক চোখ হারিয়েছে, সে অন্য চোখ দিয়ে লড়াই করবে এবং আমরা সবাই একসঙ্গে আছি।"
অন্যদিকে, হিজবুল্লাহ এই হামলার জন্য ইসরায়েলকে দায়ী করে প্রতিশোধ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। যদি বরাবরের মতো ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী এ বিষয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।
হামলার ফলে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের মধ্যে উত্তেজনা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে, যা পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি করেছে।
সর্বশেষ বিস্ফোরণের কয়েক ঘণ্টা পর, ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট বলেন, তার দেশ 'যুদ্ধের নতুন পর্বের শুরুতে' রয়েছে, কারণ ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর ৯৮তম ডিভিশন গাজা থেকে ইসরায়েলের উত্তরে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
তবে এখন পর্যন্ত হিজবুল্লাহ ইঙ্গিত দিয়েছে যে তারা ইসরায়েলের সাথে আরেকটি বড় যুদ্ধে জড়াতে আগ্রহী নয়, কারণ লেবানন দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক সংকট থেকে পুনরুদ্ধারের জন্য লড়াই করছে।
তবে অনেকেই তাদের থেকে শক্ত প্রতিক্রিয়া আশা করছেন। হিজবুল্লাহ কী করবে তার ইঙ্গিত মিলতে পারে বৃহস্পতিবার, যখন দলের নেতা হাসান নাসরাল্লাহ প্রথমবারের মতো এ বিষয়ে মন্তব্য করবেন।
অনুবাদ: সাকাব নাহিয়ান শ্রাবন