ভারত: ৩৭ বছর আগে সহমরণে যেতে বাধ্য করা হয়েছিল, বিচারের আশা আজও ক্ষীণ
আজ থেকে ৩৭ বছর আগে ভারতের রাজস্থানে হিন্দু ধর্মের প্রথা সতীদাহের মাধ্যমে এক কিশোরী বিধবাকে তার স্বামীর সঙ্গে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছিল।
এ ঘটনা তখন সারাবিশ্বে আলোচনার জন্ম দেয়। ওঠে ব্যাপক নিন্দার ঝড়।
ওই মৃত্যুকে মহিমান্বিত করার অভিযোগে অভিযুক্ত আটজনকে সম্প্রতি আদালত বেকসুর খালাস দেওয়ার পর এখন রূপ কানওয়ারের সে ঘটনা ভারতে আবারও আলোচনায় এসেছে। সতীদাহ নিয়ে এটিই ছিল ভারতের শেষ বিচারাধীন মামলা।
১৮২৯ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকেরা প্রথম সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ করলেও ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতার পরেও এটি চলতে থাকে। রূপ কানওয়ারকে ভারতের শেষ সতী হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
তার মৃত্যুর পর দেশজুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হলে ভারত সরকার নতুন আরেকটি কঠোর আইন কমিশন অব সতী (প্রিভেনশন) অ্যাক্ট, ১৯৮৭ তৈরি করে। এ আইনে সতীদাহ প্রথাকে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি প্রথমবারের মতো এটিকে মহিমান্বিত করাকেও অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়।
যারা সতীদাহে অংশ নেবে বা প্ররোচিত করবে, তাদের জন্য মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের শাস্তির বিধান রাখা হয় আইনে। কিন্তু রূপ কানওয়ারের মৃত্যুর ঘটনায় অভিযুক্ত সবাই আদালতে খালাস পেয়ে গেছেন।
গত সপ্তাহে দেওয়া এ রায় ভারতে নতুন করে ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। রূপ কানওয়ারের মৃত্যুর জন্য কেউই দায়ী না হওয়ার বিষয়টি নিয়ে নারী সংগঠন ও অধিকারকর্মীরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
রাজস্থানের ১৪টি নারী সংগঠন মুখ্যমন্ত্রী ভজন লালকে চিঠি দিয়ে সরকারের কাছে উচ্চ আদালতে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার আহ্বান জানিয়েছে। সতীদাহকে গৌরবান্বিত করা রোধে যেন কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়, সে অনুরোধও করেছে সংগঠনগুলো। তারা বলেছে, এত দীর্ঘ সময় পর দেওয়া এ খালাসের রায় 'সতীদাহকে গৌরবান্বিত করার সংস্কৃতিকে আরও শক্তিশালী করতে পারে।'
আটজন অভিযুক্তের পক্ষে কাজ করা একজন আইনজীবী বিবিসি হিন্দিকে বলেন, তাদের খালাস দেওয়া হয়েছে কারণ 'তাদের বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।'
সরকার এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার পরিকল্পনা করছে কি না জানতে চাইলে রাজস্থানের বিচারমন্ত্রী জগারাম প্যাটেল বলেন, 'আমরা এখনো রায়ের কপি পাইনি। রায়ের গুণগত মান ও ত্রুটি [মেরিট, ডিমেরিট] বিশ্লেষণ করেই আমরা আপিল করার সিদ্ধান্ত নেব।'
কেন আগের দায়মুক্তির রায়গুলোর বিরুদ্ধে আপিল করা হয়নি প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, 'এ মামলাগুলো আমার দায়িত্ব নেওয়ার আগের ঘটনা, তাই আমি বিস্তারিত জানি না।'
১৯৮৭ সালের ৪ সেপ্টেম্বর রাজস্থানের দেওরালা গ্রামে ১৮ বছর বয়সি রূপ কানওয়ারের সতীদাহ 'প্রদর্শনীতে' পরিণত হয়েছিল। সেদিন শত শত গ্রামবাসী তার পুড়ে মরা দেখেছিলেন। এ ঘটনা রাজস্থান ও ভারতের জন্য একটি কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়।
তার স্বামীর পরিবার এবং তাদের উচ্চবর্ণের রাজপুত সম্প্রদায়ের সদস্যরা দাবি করেছিলেন, কানওয়ার নিজে সহমরণে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
তাদের দাবি, রূপ কানওয়ার তার বিয়ের সাজ পরে গ্রামের রাস্তায় নিজেই শোভাযাত্রার সামনে ছিলেন। তারপর সাত মাস আগে বিয়ে হওয়া স্বামী মাল সিংয়ের চিতায় ওঠেন। এরপর তিনি তার স্বামীর কোলে মাথা রেখে মন্ত্রোচ্চারণ শুরু করেন এবং ধীরে ধীরে জ্বলন্ত চিতায় মৃত্যুবরণ করেন।
তবে এ দাবিটি চ্যালেঞ্জ করেন সাংবাদিক, আইনজীবী, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি এবং নারী অধিকারকর্মীরা। প্রথমদিকে রূপ কানওয়ারের বাবা-মাও এর বিরোধিতা করেছিলেন। তারা দেওরালা গ্রাম থেকে মাত্র দুঘণ্টার দূরত্বে রাজস্থানের রাজধানী জয়পুরে বাস করতেন। পরদিনের সংবাদপত্র থেকে তাদের জামাইয়ের মৃত্যু এবং মেয়ের সতীদাহের খবর তারা জানতে পারেন।
কিন্তু পরে তারা বলেছিলেন, তাদের বিশ্বাস তাদের মেয়ে স্বেচ্ছায় এ কাজটি করেছেন।
সমালোচকেরা তখন বলেছিলেন, প্রভাবশালী রাজনীতিবিদদের চাপের কারণে হয়তো মা-বাবা বক্তব্য পরিবর্তন করেছন। এ রাজনীতিবিদেরা রাজপুত সম্প্রদায়কে একত্রিত করতে ভোটব্যাংকের রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ঘটনাটিকে ব্যবহার করেছিলেন।
রূপ কানওয়ারের মৃত্যুর পরের কয়েকদিন উভয় পক্ষই উচ্চস্বরে প্রতিবাদ জানায়।
সতীদাহের ঘটনায় ব্যাপক নিন্দার ঝড় ওঠে। অধিকারকর্মীরা ন্যায়বিচারের দাবিতে রাজপথে নামেন, কংগ্রেসের রাজ্য সরকারের সমালোচনা করেন এবং রাজস্থানের প্রধান বিচারপতিকে চিঠি দিয়ে সতীদাহকে উদযাপন নিষিদ্ধ করার আহ্বান জানান।
আদালতের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও কানওয়ারের মৃত্যুর ১৩ দিন পর প্রায় দুই লাখ মানুষ একটি অনুষ্ঠানে যোগ দেন। সেখানে তার ফ্রেম করা ছবি ও পোস্টার বিক্রি হয়। এর ফলে দেওরালা একটি লাভজনক তীর্থস্থানে পরিণত হয়।
এর কিছুদিন পরেই দুটি আলাদা প্রতিবেদনে উঠে আসে, কানওয়ারকে গ্রামবাসীরা 'সহমরণে যেতে বাধ্য করেছিলেন' এবং তার মৃত্যু 'স্বেচ্ছায় ঘটেনি'।
ঘটনার তিন সপ্তাহ পর তিন সদস্যের একটি দলের অংশ হিসেবে দেওরালা পরিদর্শন করেন সাংবাদিক গীতা শেশু। তিনি জানান, '[গ্রামের] পরিস্থিতি ছিল উত্তেজনাপূর্ণ ও শঙ্কাজনক।'
'রাজপুত সভা পুরো এলাকাটি নিয়ন্ত্রণ করছিল। রূপ যেখানে মারা গিয়েছিলেন, সে স্থানটি তরবারিধারী যুবারা পাহারা দিচ্ছিল। পরিবেশ এতটাই ভয়ানক ছিল যে, গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথা বলা আমাদের জন্য প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছিল,' বলেন তিনি।
তবুও দলটি কিছু গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্য সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়, যেগুলো পরে তাদের তদন্ত প্রতিবেদনে অন্তর্ভুক্ত হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, 'মাল সিংয়ের মরদেহ গ্রামে আনার পরপরই সতীদাহের প্রস্তুতি শুরু হয়। রূপ পরিকল্পনা টের পেয়ে পালিয়ে পাশের মাঠে লুকিয়ে ছিলেন। পরে তাকে একটি গোলাঘর থেকে বের করে জোরপূর্বক চিতায় তোলা হয়।'
'চিতায় নেওয়া পথে রূপকে রাজপুত যুবকেরা ঘিরে রেখেছিলেন। তাকে খুবই অস্থিরভাবে হাঁটতে দেখা গেছে বলে জানা গেছে। তার মুখ থেকে ফেনা বের হচ্ছিল।' তাতে ধারণা করা হয়, তাকে হয়তো মাদক দেওয়া হয়েছিল।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, 'চিতা জ্বালানোর পর রূপ বাইরে বেরোনোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তার গায়ের ওপর কাঠ ও নারকেল দিয়ে তাকে চাপিয়ে রাখা হয়েছিল। তরোয়ালধারী রাজপুত যুবকেরাও তাকে ঠেলে চিতায় ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, তারা রূপের চিৎকার ও সাহায্যের জন্য আকুতি শুনেছিলেন।'
গীতা শেশু বলেন, 'অনেকে এটাকে বীরত্ব বা আত্মত্যাগ হিসেবে ব্যাখ্যা করতে পারে, কিন্তু এটি ছিল পুরোদস্তুর একটি নির্মম হত্যাকাণ্ড।'
তিনি আরও জানান, কানওয়ারের বাবা-মা ও ভাইরা প্রথমে ক্ষুব্ধ ছিলেন এবং ন্যায়বিচারের জন্য লড়তে চেয়েছিলেন। কিন্তু পরে সম্প্রদায়ের নেতাদের চাপের মুখে তারা তাদের অবস্থান পরিবর্তন করেন।
কানওয়ারের বড় ভাই গোপাল সিং বলেন, 'প্রথমে আমরা সন্দেহ করেছিলাম, কিছু একটা গণ্ডগোল ছিল। কিন্তু দেওরালা গ্রামে থাকা আমাদের আত্মীয়রা জানান, এটা রূপের নিজস্ব সিদ্ধান্ত ছিল। তাই পরিবারের প্রবীণেরা বিষয়টি মেনে নেয়। আমাদের ওপর কোনো চাপ ছিল না।'
গীতা শেশু বলেন, 'ঘটনার সময়ে প্রায় সবাই ধরে নিয়েছিল, সতীদাহ একটি প্রথা, নারীরা এটি স্বেচ্ছায় পালন করেন। পুলিশ ও প্রশাসন উদযাপনের সঙ্গে এতটাই জড়িয়ে পড়েছিল যে, কোনো প্রমাণ সংগ্রহ বা দায়িত্ব নির্ধারণের চেষ্টা করা হয়নি।'
তার মতে, সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হলো কানওয়ারের মৃত্যুকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ফায়দা তোলার জন্য ব্যবহার করেছিল রাজপুত সম্প্রদায়।
'সতীদাহের সমর্থকেরা সেখানে একটি মন্দির নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সতীদাহকে মহিমান্বিত করা নিষিদ্ধকারী নতুন আইন তাদের সেই পরিকল্পনায় বাদ সাধে। তবে বর্তমান খালাসের রায়ের পর হয়তো সে স্থানটিতে আবারও ধর্মীয় পর্যটনের সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে।'
এটি অবশ্যই একটি ন্যায্য উদ্বেগ। দেওরালায় কানওয়ারের মৃত্যুর স্থানটি এখনও কিছু দর্শনার্থীকে আকর্ষণ করে।
এক বছর আগে তোলা একটি ছবিতে দেখা যায়, রূপ ও তার স্বামীর বাঁধানো ছবির সামনে প্রদীপ জ্বালাচ্ছে একটি পরিবার। ছবিটি সোনার ঝালরের লাল কাপড় দিয়ে ঢাকা একটি ছোট ইটের কাঠামোর ভেতরে রাখা।
কানওয়ারকে তারা এভাবে দেবীর মর্যাদা দিলেও ভারতের শেষ সতীর ন্যায়বিচারের সম্ভাবনা আজও ক্ষীণ।