প্রকৌশলী থেকে সমাজকর্মী; হিমশীতল মরুভূমি লাদাখের বাস্তুতন্ত্র রক্ষায় 'বাস্তবের র্যাঞ্চোর' অনশন
ভারতের এক পরিবেশ আন্দোলন কর্মী সম্প্রতি ১৬ দিনের অনশন শেষ করেছেন। মূলত তিনি ভারতের উত্তরাঞ্চলের বরফাবৃত মরুভূমির এক অঞ্চলের বাস্তুসংস্থান রক্ষায় লড়াই ও প্রতিবাদ করে যাচ্ছেন। খবর বিবিসির।
৫৮ বছর বয়সি সোনাম ওয়াংচুক ভারতে বেশ পরিচিত এক নাম। কেননা ২০০৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত হিট সিনেমা 'থ্রি ইডিয়টস'-এ আমির খানের 'র্যাঞ্চো' চরিত্র তার থেকেই অনুপ্রাণিত।
ওয়াংচুক মূলত একজন প্রকৌশলী ও আবিষ্কারক হিসাবেই দীর্ঘসময় ধরে পরিচিত। কিন্তু সম্প্রতি তিনি পাকিস্তান ও চীন সীমান্তবর্তী পাহাড়ে ঘেরা শীতল মরুভূমির নিজ অঞ্চল লাদাখের স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে আন্দোলনের জন্য আলোচিত হচ্ছেন।
লাদাখ ভারতীয় ভূখণ্ডে অবস্থিত কাশ্মীরের অংশ ছিল। কিন্তু নরেন্দ্র মোদি সরকার ২০১৯ সালে বিতর্কিত এই অঞ্চলটি ভাগ করে জাম্মু ও কাশ্মীর এবং লাদাখ নামে আলাদা দুই ফেডারেল অঞ্চলে ভাগ করেন।
এক্ষেত্রে চলতি মাসের শুরুতে এই পরিবর্তনের পর প্রথমবারের মতো জম্মু ও কাশ্মীরে বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু নির্বাচন ছাড়াই লাদাখ একটি ফেডারেল অঞ্চল হিসেবে পরিচালিত হচ্ছে।
লাদাখের মানুষেরা এমন পরিস্থিতিকে বৈষম্য বলে মনে করছেন। তারা নিজেদের নির্বাচিত প্রতিনিধি চাচ্ছেন। কেননা তারা এই অঞ্চলে অবকাঠামোগত কার্যক্রমের পরিস্থিতি নিয়েও চিন্তিত৷ যা ইতোমধ্যে বিপন্ন পরিবেশের আরও ক্ষতি করছে বলে তারা মনে করেন।
অনশন শুরুর আগে ওয়াংচুক ও তার সমর্থকেরা লাদাখ থেকে রাজধানী দিল্লিতে কয়েকশ কিলোমিটার পদযাত্রা করেছিলেন। তারা নিজেদের প্রাকৃতিক সম্পদের অপব্যবহার রক্ষায় আরও স্বায়ত্তশাসনের দাবি করছেন।
এর আগে লাদাখের স্থানীয়দের সাথে ফেডারেল সরকারি কর্মকর্তাদের কয়েক মাস ধরে আলোচনা হয়েছিল। কিন্তু সেটা ব্যর্থ হলে তারা পদযাত্রার সিদ্ধান্ত নেয়।
এক্ষেত্রে দিল্লির সীমান্তে বিক্ষোভকারীদের কয়েক ঘন্টা আটকে রাখা হয়েছিল। ঠিক এরপরেই ওয়াংচুক অনশন শুরু করেছিলেন। তবে শীঘ্রই আলোচনা আবার শুরু হবে বলে সরকার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পর গত সোমবার তিনি অনশন ভাঙেন।
ওয়াংচুকের প্রতিবাদ ও সাক্ষাৎকারের ফলে লাদাখের জনগণের দাবিগুলি এখন কয়েক সপ্তাহ ধরে ভারতের মূলধারার মিডিয়ায় আলোচিত হচ্ছে। তার অবশ্য ক্ষমতা কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে।
ওয়াংচুক শৈশবে জম্মু ও কাশ্মীরের তৎকালীন রাজধানী শ্রীনগরে তিন বছর পড়াশোনা করেছিলেন। যেখানে ইংরেজি, উর্দু ও হিন্দিতে পড়ানো হতো। এক সাক্ষাৎকারে তিনি ক্লাসে 'হাসির খোরাক' হওয়ার কথা স্মরণ করেছিলেন।
তিনি বলেন, "শ্রীনগরে আমি লাদাখ থেকে আগত একদম চুপচাপ একটা ছেলে ছিলাম। যে হিন্দি বা ইংরেজি বলতে পারতো না।"
১৯৮০-এর দশকে ওয়াংচুক নিজ অভিজ্ঞতার আলোকে লাদাখের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। তার দাবি, এক্ষেত্রে স্থানীয় পরিস্থিতিকে বিবেচনায় নেওয়া হয়নি৷ তিনি এমন একটি অঞ্চলে ইংরেজি ও উর্দুতে পাঠ্যপুস্তক ব্যবহারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন যেখানে বেশিরভাগ লোক লাদাখি ভাষায় কথা বলে।
ওয়াংচুকের প্রতিষ্ঠিত একটি স্কুলের ওয়েবসাইট নোটে বলা হয়, "প্রাক প্রাথমিক শ্রেণিসহ সমস্ত পাঠ্যপুস্তক দিল্লি থেকে এসেছে। সেখানকার উদাহরণগুলি ছিল এখানকার সংস্কৃতি ও পরিবেশের সাথে অপরিচিত।"
এরপর থেকে ওয়াংচুক স্থানীয় সম্প্রদায়ের সাথে ভিন্নধর্মী শিক্ষা ব্যবস্থা চালু নিয়ে কাজ করছিলেন। তার বহু উদ্ভাবনও গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচারিত হয়েছে।
ওয়াংচুক মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং অধ্যয়ন করেছিলেন। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে তিনি কম খরচে এমন মাটির ঘর তৈরি করেছেন যা -১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস অবস্থার মধ্যেও ১৫ ডিগ্রি তাপমাত্রা বজায় রাখে।
চলতি বছরের শুরুর দিকে ওয়াংচুক হিমশীতল ঠান্ডা আবহাওয়ায় ২১ দিন ধরে প্রতিবাদ করেছিলেন। তিনি মূলত লাদাখের পরিবেশ ও ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী আদিবাসীর সংস্কৃতি রক্ষার সরকারকে চাপ দিতে এই আন্দোলন করছেন।
ওয়াংচুকের সাথে হাজার হাজার মানুষ যোগ দিয়েছিল। তারা একসাথে অনশন ও বিক্ষোভ করছিল। কিন্তু যখন এই প্রতিবাদগুলি কাঙ্ক্ষিত ফলাফল দিচ্ছিল না তখন তারা দিল্লির অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন।
দেশটির রাজধানীতে ওয়াংচুক লাদাখের খনিজ সম্পদে স্বায়ত্তশাসনের দাবি করেছেন। যা ভারতের উত্তরপূর্ব রাজ্যগুলিতে রয়েছে। এই ধারায় প্রাকৃতিক সম্পদ ও অবকাঠামোসহ বিভিন্ন বিষয়ে তাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে বিশেষ ক্ষমতা দেয়। এখানে উল্লেখ্য, লাদাখে সংখ্যাগরিষ্ঠ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জনসংখ্যা রয়েছে।
ওয়াংচুক ও তার সমর্থকদের দাবি, সাংবিধানিক সুরক্ষার অভাবে বিপন্ন হিমালয়ের বাস্তুসংস্থান হুমকির মধ্যে রয়েছে। সরকার সীমান্তবর্তী অঞ্চলে দ্রুত অবকাঠামোগত কাজ করায় এই উদ্বেগ আরও কাজ করেছে।
লাদাখ ভারতের জন্য কৌশলগতভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ এটির চীন ও পাকিস্তান উভয়ের সাথেই সীমান্ত রয়েছে।
ফেডারেল সরকার লাদাখে বেশ কয়েকটি মহাসড়ক, বিদ্যুৎ প্রকল্প ও সামরিক অবকাঠামো নির্মাণ করেছে। ওয়াংচুক দাবি, এগুলো করার ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রতিনিধিদের সাথে পরামর্শ করা হয়নি বিধায় এগুলো এই অঞ্চলের ক্ষতি করবে।
ওয়াংচুক বলেন, "আমরা উন্নয়নের বিরোধিতা করি না। কিন্তু আমরা টেকসই উন্নতি চাই।"
আন্দোলনকারীদের দাবি, লাদাখের বাস্তুশাস্ত্র বিবেচনায় ভারতের অন্যান্য রাজ্যের উন্নয়ন মডেল এখানে প্রযোজ্য নয়। হিমালয়ের অঞ্চলটির এই ভিন্নতা বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে না।
দিল্লী অভিমুখে পদযাত্রায় অংশ নেওয়া হাজি মোস্তফা বলেন, "আপনি আপনার শহরে এমনটা দেখতে পাবেন না। কিন্তু লাদাখে পরিপূর্ণ শীত, গ্রীষ্ম ও বসন্ত ঋতু রয়েছে; যেমনটা আপনি বইয়ে পড়েন।"
বিক্ষোভকারীদের অভিযোগ, লাদাখের প্রকল্পগুলি থেকে স্থানীয়দের সুবিধা পাচ্ছে না।
মোস্তফা বলেন, "আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ শোষিত হচ্ছে। বেকারত্ব খুব বেড়েছে। এতে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা ক্ষুব্ধ। তাহলে এই উন্নয়ন কাদের জন্য?"
ইতিমধ্যে বিক্ষোভকারীরা বলছেন যে, লাদাখে যা ঘটবে সে সম্পর্কে জবাবদিহি না পাওয়া পর্যন্ত তারা তাদের লড়াই চালিয়ে যাবে। এই সপ্তাহের শুরুতে সরকার আলোচনা পুনরায় শুরু করতে রাজি হওয়ায় ওয়াংচুক আশা প্রকাশ করছেন যে, শীঘ্রই একটি সমাধান বেরিয়ে আসবে।
তিনি বলেন, "আমি আশা করি পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে আলোচনা হবে। সবার জন্য একটি ভালো সমাধান হবে এবং আমাকে আর অনশনে বসতে হবে না। কিংবা রাজধানীতে ১ হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে আসতে হবে না।"
অনুবাদ: মোঃ রাফিজ খান