‘মেটিকুলাস’, ‘ডেলভ’: লেখায় ব্যবহারের পর এবার মানুষ চ্যাটজিপিটির শেখানো শব্দ কথাতেও ব্যবহার করছেন
গবেষক ইজেকুয়েল লোপেজ সম্প্রতি একটি অ্যাকাডেমিক কনফারেন্সে উপস্থিত ছিলেন। সেখানে তিনি লক্ষ্য করেন, বক্তারা একাধিকবার 'ডেলভ' শব্দটি ব্যবহার করছেন। ইংরেজি ভাষার এ তুলনামূলক জটিল শব্দটি সচরাচর খুব বেশি ব্যবহার করা হয় না, বিশেষত কথা বলার সময়।
এদিকে একই ধারা লক্ষ্য করলেন বার্লিনের ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট ফর হিউম্যান ডেভেলপমেন্টের আরেক গবেষক ইয়াদ রাহওয়ানও — অতীতে কম ব্যবহৃত অনেক শব্দ হঠাৎ করেই অ্যাকাডেমিক কনফারেন্সগুলোতে নিয়মিত শোনা যাচ্ছে।
বিভিন্ন গবেষণায় ইতোমধ্যে দেখা গেছে, চ্যাটজিপিটি ও অন্যান্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মেশিনের ব্যবহার করা এ ধরনের জটিল ইংরেজি শব্দগুলো বৈজ্ঞানিক নিবন্ধ ও বাক্যে ক্রমশ বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, মানুষ কি অবচেতনভাবেই এসব মেশিন-প্রচলিত শব্দ এখন নিজেদের কথায়ও ব্যবহার করতে শুরু করেছে?
এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গবেষণা শুরু করেন লোপেজ ও রাহওয়ান। তাদের প্রাথমিক চ্যালেঞ্জ ছিল সাম্প্রতিক কনফারেন্সগুলোর যথেষ্ট নমুনা সংগ্রহ করা। শেষ পর্যন্ত তারা বিভিন্ন অ্যাকাডেমিক কনফারেন্সের প্রায় তিন লাখ ভিডিও সংগ্রহ করেন। এরপর গত কয়েক বছরে এসব কনফারেন্সে জটিল শব্দগুলো ব্যবহারের প্রবণতা বিশ্লেষণ করতে একটি মডেল তৈরি করেন।
গবেষক লোপেজ বলেন, 'আমরা জানতে চেয়েছিলাম, মেশিনের প্রভাবে সংস্কৃতিতে কোনো পরিবর্তন হচ্ছে কি না এবং সে-সব পরিবর্তন সমাজে কতটা বিস্তার লাভ করছে।'
গবেষণায় দেখা যায়, ২০২২ সাল থেকে এ প্রবণতা ব্যাপক আকারে বৃদ্ধি পেয়েছে। 'ডেলভ', 'মেটিকুলাস', 'রিয়েলম', 'অ্যাডেপ্ট'-এর মতো জটিল কিছু ইংরেজি শব্দের ব্যবহার চোখে পড়ার মতো বেড়েছে। অধ্যাপক ইয়াদ রাহওয়ান এ প্রবণতাকে 'পরাবাস্তব' আখ্যা দিয়েছেন।
তিনি বলেন, 'আমরা এমন একটি মেশিন তৈরি করেছি, যা আমাদের থেকেই শিখেছে। এখন আমরা উল্টো সেই মেশিনের কাছ থেকে শিখছি। এটি প্রযুক্তির ইতিহাসে প্রথম যেখানে মানুষ একটি যন্ত্র থেকে এতটা সরাসরি শিখছে।'
একটি ভাষায় নতুন শব্দ শেখা এবং তা ব্যবহারে অভ্যস্ত হওয়া মানুষের জন্য অস্বাভাবিক কিছু নয়। বিশেষ করে যদি ওই ভাষাটি ব্যক্তির মাতৃভাষা না হয়। লোপেজ মনে করেন, এতে উদ্বেগের কিছু নেই; বরং এটি যোগাযোগের ক্ষমতাকে সবার জন্য আরও সহজতর করছে।
উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, 'একজন জাপানি গবেষক যদি আপনি ইংরেজিতে কথা বলতে গিয়ে একটা কিন্ডারগার্টেনপড়ুয়া শিশুর মতো করে বলেন, তাহলে সেটা তার গবেষণার বিষয়ে তার সক্ষমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে। চ্যাটজিপিটি এ ধরনের নন-নেটিভ বক্তাদেরকে ভাষার সূক্ষ্মতা ধরতে ও তাদের শব্দভাণ্ডার বিস্তৃত করতে সাহায্য করে।'
তবে এর দুটি উল্লেখযোগ্য নেতিবাচক প্রভাবও রয়েছে। প্রথমত, বর্তমানে অ্যাকাডেমিক মহলে চ্যাটজিপিটির সুবাদে জনপ্রিয় শব্দগুলোকে খানিকটা নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখা হচ্ছে। রাহওয়ান বলেন, 'আমার ল্যাবেও এমনটা দেখা যাচ্ছে। কেউ যখন 'ডেলভ' শব্দটি ব্যবহার করেন, সবাই তখন সেটাকে বিশেষভাবে দেখেন, ক্ষেত্রবিশেষে মজাও করেন।'
দ্বিতীয় প্রভাবটি আরও গভীর হতে পারে। গবেষকেরা ভাবছেন, এ ধরনের আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স মেশিনগুলো আমাদের শব্দভাণ্ডার এবং ভাবনাকে প্রভাবিত করলে সেটা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির ওপর প্রভাব ফেলবে কি না।
যেমন চ্যাটজিপিটির মতো এআই টুলগুলো যদি ইউক্রেন যুদ্ধ বা মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে আমরা কীভাবে কথা বলব তা ঠিক করে দেয় অথবা ঐতিহাসিক কোনো ঘটনার ক্ষেত্রে পক্ষপাত তৈরি করে?
রাহওয়ান সতর্ক করে বলেন, 'এটা আপাতদৃষ্টিতে নিরীহ মনে হলেও এর পরিধি বিশাল। চ্যাটজিপিটির মতো মেশিনের বর্তমানে বিপুলসংখ্যক মানুষের ওপর প্রভাব রাখার ক্ষমতা রয়েছে, যা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি [ওয়ার্ল্ডভিউ] এবং আমরা কীভাবে কোনো বিষয়কে বর্ণনা করি সেক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন আনতে পারে।'
বর্তমানে বৈশ্বিক ব্যবহারের কারণে ইংরেজি ভাষায় এ পরিবর্তনগুলো সবচেয়ে স্পষ্টভাবে লক্ষ করা যাচ্ছে। তবে, লোপেজ মনে করেন, ভবিষ্যতে এআই মেশিনের মাধ্যমে মানুষের ভাষা প্রভাবিত হওয়ার প্রবণতা ইংরেজি বাদে অন্য ভাষার ক্ষেত্রেও ঘটতে পারে।
ভাষার বাইরে আরও কিছু অপ্রত্যাশিত প্রভাব ফেলতে পারে চ্যাটজিপিটির মতো জেনারেটিভ এআই। নেচার হিউম্যান বিহেভিয়ার-এ প্রকাশিত একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় লোপেজ এবং তার সহ-গবেষকেরা দেখিয়েছেন, এ প্রযুক্তির গণহারে ব্যবহার যৌথ বুদ্ধিমত্তার [কালেক্টিভ ইন্টেলিজেন্স] জন্য একধরনের হুমকি তৈরি করতে পারে।
যেমন, গিটহাব বা স্ট্যাক ওভারফ্লো-এর মতো কোড শেয়ারিং প্ল্যাটফর্মের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা হারিয়ে যেতে পারে যদি প্রোগ্রামাররা এআই-র সাহায্যে তাদের কোড লিখেন। কারণ তখন সহকর্মীদের সমন্বয়ে সৃষ্ট এ ধরনের প্ল্যাটফর্মগুলোর প্রয়োজনীয়তা অনেকাংশে কমে আসতে পারে।