জৈবিক বয়স: একই বয়সে কেন কাউকে কম বয়স্ক, কাউকে বেশি বয়স্ক দেখায়?
যদি আপনি কখনও স্কুলের পুনর্মিলনীতে অংশ নিয়ে থাকেন, তবে হয়ত খেয়াল করেছেন, আপনার কোনো কোনো সহপাঠী বয়সের তুলনায় দ্রুত বুড়িয়ে গেছেন, আবার কাউকে অনেক কম বয়সী মনে হয়। বহু বছর পরে দেখা হলে কোনো সহপাঠীকে দশ বছর কম বয়সী দেখায়, আবার আরেক সহপাঠী দেখে যেন দশ বছর বেশি বয়সী মনে হয়।
আলবার্ট আইনস্টাইন কলেজ অব মেডিসিনের ইনস্টিটিউট ফর এজিং রিসার্চের পরিচালক ড. নির বারজিলাই বলেন, "মানুষ এটা স্বাভাবিকভাবেই বুঝতে পারে। কিন্তু তারা জানে না এটি একটি জৈবিক বিষয়, যা আমরা আবিষ্কার করার চেষ্টা করছি।"
বিজ্ঞানীরা এই ধারণাটি পরিমাপ করার চেষ্টা করছেন এবং মানুষের প্রকৃত "বায়োলজিকাল বয়স" (জৈবিক বয়স) নির্ধারণে জন্মের পর কত বছর পার হয়েছে তা ছাড়াও তাদের কোষগত স্বাস্থ্যের দিকে নজর দিচ্ছেন।
বর্তমানে রক্তের কিছু পরীক্ষার মাধ্যমে এই বিষয়টি নির্ধারণের প্রক্রিয়া বাজারে আনা হয়েছে। তবে, এই পরীক্ষাগুলোর জন্য শত শত ডলার খরচ করার আগে, এর ফলাফল কী হবে তা জেনে নেওয়া জরুরি।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন, যদিও এই পরীক্ষাগুলো তত্ত্বগতভাবে আকর্ষণীয় এবং গবেষণার ক্ষেত্রে মূল্যবান হতে পারে, সেগুলো এখনো পুরোপুরি নির্ভরযোগ্য বা ব্যবহারোপযোগী হয়ে ওঠেনি।
কীভাবে জৈবিক বয়স নির্ধারণ করা হয়?
সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর হেলদি লংজিভিটির সহ-পরিচালক ড. আন্দ্রিয়া ব্রিটা মায়ার বলেন, গবেষকদের মতে "জৈবিক বয়স সাধারণ বয়স গণনার বাইরে গিয়ে শরীরের প্রকৃত অবস্থার একটি ধারণা দেয়।"
এটি শরীরের ক্ষয়-ক্ষতির একটি পরিমাপ, যা প্রাকৃতিক বার্ধক্য, পরিবেশ, এবং জীবনযাত্রার প্রভাবে ঘটে।
ব্রিটিশ চিকিৎসা-বিজ্ঞানী ড. অ্যালেক্স কমফোর্ট প্রথম ১৯৬৯ সালে এই ধারণা প্রকাশ করেন। তবে বহু বছর ধরে বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারেননি, কীভাবে জৈবিক বয়স নির্ধারণ করা সম্ভব।
২০১৩ সালে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক স্টিভ হরভাথ জৈবিক বয়স পরিমাপের একটি নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। তিনি এপিজেনেটিকস নামক বিজ্ঞানের একটি ক্ষেত্র ব্যবহার করে ডিএনএ পরিবর্তন বিশ্লেষণ করেন। এই পরিবর্তন সময়ের সাথে বিভিন্ন জিন চালু বা বন্ধ করতে ভূমিকা রাখে। তার উদ্ভাবিত অ্যালগরিদম বয়সের সাথে ডিএনএ পরিবর্তনের সম্পর্ক নির্ধারণ করে।
হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের গবেষক জেসি পোগানিক বলেন, প্রাকৃতিক বার্ধক্য ছাড়াও ধূমপান ও অতিরিক্ত মদ্যপানের মতো আচরণ এই পরিবর্তনকে দ্রুততর করে। ফলে, জৈবিক বয়স জীবনের প্রত্যাশিত সময় এবং স্বাস্থ্যের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত।
গবেষকরা মনে করছেন, এই পদ্ধতি স্বাস্থ্য এবং বার্ধক্য নিয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে।
জৈবিক বয়স নির্ধারণে বাণিজ্যিক পরীক্ষার বিষয়ে সতর্ক থাকা
বর্তমানে কিছু প্রতিষ্ঠান প্রায় ৩০০ ডলারে রক্ত বা লালার বিশ্লেষণের মাধ্যমে জৈবিক বয়স নির্ধারণের পরীক্ষা বিক্রি করছে। এই পদ্ধতিতে এপিজেনোমের পরিবর্তন জনসংখ্যার গড়ের সাথে তুলনা করা হয়।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই পরীক্ষা ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যের সুনির্দিষ্ট তথ্য দিতে সক্ষম নয়। এপিজেনেটিক 'ঘড়ি' মূলত বৃহৎ জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য মূল্যায়নের জন্য তৈরি, যার ফলে ব্যক্তিগত ফলাফল অসঙ্গতিপূর্ণ হতে পারে।
সম্প্রতি একটি সম্মেলনে ড. স্টিভ হরভাথ জানান, এক ব্যক্তি দুটি ভিন্ন পরীক্ষায় ১০ বছরের ব্যবধানযুক্ত ফলাফল পেয়েছেন। তার মন্তব্য, "ওই ব্যক্তি তার অর্থ বাঁচাতে পারতেন।"
কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মহামারিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড্যানিয়েল বেলস্কি, যিনি নিজেও একটি এপিজেনেটিক ঘড়ি তৈরি করেছেন, বলেন, "শ্রেষ্ঠ পদ্ধতিগুলো সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় নয়, তবে এগুলো এখনো পরীক্ষিত ক্লিনিক্যাল টুল নয়। এগুলো কৌতূহল মেটানোর জন্য বেশি উপযুক্ত।"
আরেকটি বড় সমস্যা হলো, এই পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে কী করা উচিত তা অজানা। বিজ্ঞানীরা এখনো জানেন না জৈবিক বয়স কমানো সম্ভব কি না।
এপিজেনেটিক ঘড়ির মূল উদ্দেশ্য ছিল অ্যান্টি-এজিং গবেষণায় ব্যবহার করা। এগুলো ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে শত বা হাজার মানুষের জীবনকাল পরিবর্তনের সম্ভাবনা পরিমাপ করতে কাজে লাগানো হচ্ছে।
তবুও, কিছু কোম্পানি এই পরীক্ষা বিক্রির পাশাপাশি জীবনযাত্রার পরামর্শ ও বয়স কমানোর দাবি করা সাপ্লিমেন্ট বিক্রি করে চলেছে। বিশেষজ্ঞরা এ বিষয়ে আরও গবেষণার আগে ভোক্তাদের সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন।
পুরোনো তথ্যের নতুন বিশ্লেষণ
এপিজেনেটিক ঘড়ি ছাড়াও, বাজারে আরও কিছু পদ্ধতি জৈবিক বয়স নির্ধারণের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। কিছু প্রতিষ্ঠান চিকিৎসকের কাছে প্রচলিত রক্ত পরীক্ষার প্যানেল, যেমন কোলেস্টেরল বা হিমোগ্লোবিন এ১সি (ডায়াবেটিস নির্ধারণের সূচক) ব্যবহার করে জৈবিক বয়স অনুমান করার সেবা দিচ্ছে।
এই পদ্ধতির যুক্তি হলো, অনেক স্বাস্থ্যসূচক বয়স বাড়ার সঙ্গে পরিবর্তিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, যদি আপনার বয়স ৪৫ হয়, কিন্তু কোলেস্টেরলের মাত্রার গড় ৫০ বছর বয়সীদের মতো হয়, তাহলে পরীক্ষার ফলাফল আপনার জৈবিক বয়স ৪৫ বছরের চেয়ে বেশি দেখাতে পারে।
তবে, রক্তের সূচকগুলো আসলেই জৈবিক বয়স নির্দেশ করে নাকি সাধারণ স্বাস্থ্য অবস্থা জানায়, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। এর একটি সুবিধা হলো, এই সূচকগুলো পরিবর্তনযোগ্য। উদাহরণস্বরূপ, জীবনযাত্রার পরিবর্তন ও ওষুধের মাধ্যমে রক্তে চিনির মাত্রা কমানো সম্ভব।
এর বিপরীতে, এপিজেনেটিক বয়স এখনও একটি অজানা ক্ষেত্র।
ড. জেসি পোগানিক ইমেইলের মাধ্যমে বলেন, "স্বাস্থ্যের উন্নতিতে আরও বেশি পরীক্ষা করার সুযোগ বাড়ানো একটি যুক্তিসংগত ধারণা। তবে, ব্যক্তিগত জৈবিক বয়স নির্ধারণের সুনির্দিষ্ট দাবি অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে দেখা উচিত।"