রাশিয়ার এই ব্যাংক কেন অবরোধের বাইরে? ইউরোপে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাবে এই আতঙ্কে!
মস্কোর গ্যাসের ব্যবসায়কে এ মুহূর্তে সচল রাখতে যে ব্যাংকটি সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখছে সেটি হচ্ছে গ্যাজপ্রমব্যাংক। এটি রাশিয়ার সবচেয়ে বড় ব্যাংকগুলোর একটি। এ ব্যাংকটি এখনো সারাবিশ্বে অবাধে এর কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারছে। এদিকে গ্যাজপ্রমব্যাংককেও কড়া নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)-এর কাছে আহ্বান জানিয়েছে ইউক্রেন।
রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত গ্যাস কোম্পানি গ্যাজপ্রম-এর জন্য এ ব্যাংকটি তৈরি করা হয়েছে। ইউক্রেন সরকার বলছে রাশিয়ার যুদ্ধের খরচ যোগানোর ক্ষেত্রে সাহায্য করছে এটি।
'যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের উচিত এ ব্যাংকটিকে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া। কারণ এটি কেবল রাশিয়াকে জ্বালানি বিক্রির অর্থ পেতে সাহায্য করছে না, একই সাথে গ্যাজপ্রমব্যাংক রাশিয়ার সশস্ত্রবাহিনী, রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি, ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকে সরাসরি সহায়তা দিচ্ছে,' এনবিসি নিউজকে বলেন ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির চিফ অভ স্টাফ আন্দ্রি ইয়ারমাক।
রাশিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম ব্যাংক গ্যাজপ্রমব্যাংক। অন্যান্য ব্যাংক পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়লেও এ ব্যাংকটিকে এখনো তার বাইরে রাখা হয়েছে। এটি এখনো বিশ্বব্যাপী ডলার ও ইউরোতে সেবা দিয়ে যাচ্ছে এবং আন্তর্জাতিক ব্যাংক ব্যবস্থা সুইফট-এর কিছু অংশের সাথে যুক্ত রয়েছে।
পশ্চিমা সরকারগুলো ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকেই রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে দেশটির অর্থনীতিকে কাবু করতে চেয়েছে। তবে গ্যাজপ্রমব্যাংক নিয়ে তারা এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। ইউরোপ এখনো রাশিয়ার প্রাকৃতিক গ্যাসের ওপর বিপুলভাবে নির্ভরশীল। তারা এ গ্যাসের মূল্য পরিশোধ করার জন্য গ্যাজপ্রমব্যাংকের সহায়তা গ্রহণ করে। পশ্চিমা কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইউরোপের বেশিরভাগ সরকার এ ব্যাংককে কোনো প্রকার শাস্তি দিয়ে নিজেদের প্রাকৃতিক গ্যাসের উৎসে ব্যাঘাত ঘটাতে চাচ্ছে না।
এদিকে ইউক্রেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ব্যাংকটির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিতে অনেকদিন ধরে আহ্বান জানাচ্ছে। এমনকি এ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে তারা রাশিয়ার কার্যক্রম বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে গোয়েন্দা তথ্যও সরবরাহ করেছে।
ইউক্রেনের গোয়েন্দা দপ্তরগুলোর তথ্য অনুয়ায়ী, দেশটিতে যুদ্ধরত কিছু সৈন্যের বেতনভাতা ইত্যাদি গ্যাজপ্রমব্যাংক-এর মাধ্যমে দেওয়া হয়। এছাড়া যেসব সৈন্য যুদ্ধে নিহত হয়েছেন, তাদের পরিবারকে ভাতা প্রদানেও এ ব্যাংকটির সেবা নেওয়া হয়।
ইউক্রেন আরও মনে করে এ ব্যাংকটি সামরিক সরঞ্জাম কেনার সাথেও জড়িত। দেশটির গোয়েন্দা তথ্যের দাবি অনুযায়ী, ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে যুদ্ধরত রাশিয়ান সেনাবাহিনীর ট্যাংক ডিভিশনের একজন অফিসার দুইটি ড্রোন কোয়াডকপ্টার কেনার মূল্য পরিশোধ করতে গ্যাজপ্রমব্যাংক ব্যবহার করেছেন।
চীন, ভারত, ও ইউরোপে গ্যাজপ্রমব্যাংক-এর নিজস্ব অফিস রয়েছে। ইউক্রেনের গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী, গ্যাজপ্রমব্যাংক চেষ্টা করছে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞাকে পাশ কাটিয়ে অর্থনৈতিক কাজগুলো চালিয়ে যেতে। এর জন্য ব্যাংকটি কিছু পদ্ধতি গ্রহণ করছে। যেমন, বিভিন্ন রাশিয়ান সংস্থাকে বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করতে সাহায্য করছে এটি। এছাড়া সম্ভাব্য সামরিক কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে এমন সব সরঞ্জাম কেনার প্রক্রিয়ার পেছনেও রয়েছে এটি। এসব তথ্য মার্কিন সরকারকেও জানিয়েছে ইউক্রেন।
বিভিন্ন বেসামরিক বিদেশি সহায়তা ও সাংস্কৃতিক বিনিময়ের দেখাশোনা করা রাশিয়ান সরকারি সংস্থা রসোত্রুদনিশেস্তভ তাদের পর্তুগালে অবস্থিত একটি দপ্তরে অর্থ স্থানান্তরের জন্য গ্যাজপ্রমব্যাংক ব্যবহার করার সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করেছে বলেও জানিয়েছে ইউক্রেনের গোয়েন্দা সংস্থা। অবশ্য এ ব্যাপারে সংস্থাটির কোনো মন্তব্য জানা যায়নি।
এদিকে ইউক্রেনের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো যুক্তরাষ্ট্রকে কী ধরনের গোয়েন্দা তথ্য দিয়েছে এ বিষয়েও কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি বাইডেন প্রশাসন।
গ্যাজপ্রমব্যাংকও কোনো মন্তব্য জানায়নি। যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বিভাগ জানিয়েছে, বাইডেন প্রশাসন গ্যাজপ্রমব্যাংক-এর সবধরনের কার্যক্রমের ওপর নজর রাখছে। ব্যাংকটির বিরুদ্ধে ভবিষ্যতে কোনো নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হবে না, এমন সম্ভাবনাও উড়িয়ে দিয়েছে এটি।
ট্রেজারি বিভাগের একজন কর্মকর্তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার উদ্দেশ্য হলো, 'রাশিয়াকে এর অর্থনীতির ভিত ধরে রাখা ও মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় রাজস্ব আয়ের পথ বন্ধ করে দেওয়া' এবং 'বর্তমানে ও ভবিষ্যতে শক্তিশালী হওয়া রোধ করতে দেশটির প্রতিরক্ষা শিল্পের সাপ্লাই চেইনে বিঘ্ন ঘটানো।'
সাবেক ফরাসি ট্রেজারি কর্মকর্তা ও বর্তমানে ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট-এর পরিচালক অ্যাগাথ দেমারাইস বলেন, যদি গ্যাজপ্রমব্যাংককে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা থেকে বের করে দেওয়া হয়, তাহলে ইউরোপকে 'অপ্রীতিকর পরিস্থিতি'র মুখে পড়তে হবে।
'মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জানে এটি যদি গ্যাজপ্রমব্যাংককে নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনে, তাহলে এটি ইউরোপে বড়রকমের সমস্যা তৈরি করবে। এমনটা হলে ইউরো ব্যবহারকারী অঞ্চল মন্দার মুখে পড়বে। এছাড়া এর ফলে নিষেধাজ্ঞা প্রসঙ্গে আমেরিকা ও ইউরোপের মধ্যে বিবাদমান পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটবে,' বলেন দেমারাইস। আর বাইডেন প্রশাসন ইউরোপের মিত্রদের সঙ্গে কোনো প্রকার বিবাদে যেতে চায় না বলে মন্তব্য করেন তিনি।
নিষেধাজ্ঞা বিষয়ে বিশেষজ্ঞ অনেকে বলেছেন গ্যাজপ্রমব্যাংক হয়তো চাইবে এমন কোনো আর্থিক স্থানান্তরের মধ্যে না যেতে যা যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের নজর আকৃষ্ট করবে ও মস্কোয় প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম পৌঁছানো নিশ্চিত করার পথে অন্তরায় সৃষ্টি করবে।
তবে এখন পর্যন্ত ওয়াশিংটন গ্যাজপ্রমব্যাংক-এর সম্পদ জব্দ বা ডলার স্থানান্তরে নিষেধাজ্ঞা না দিলেও গত মাসে মার্কিন ট্রেজারি বিভাগ ব্যাংকটির ২৭ জন নির্বাহী কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে।
এছাড়া ফেব্রুয়ারি মাসে গ্যাজপ্রমব্যাংক-এর একজন বোর্ডসদস্য সের্গেই সের্গিভিচ ইভানভ-এর ওপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। ইভানভ রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত হীরা উৎপাদনকারী খনির প্রধান। ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখল করে নেওয়ার পরও ব্যাংকটির ওপর আংশিক নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র।
গত বছর নিজেদের ৪৫ শতাংশ প্রাকৃতিক গ্যাসের জন্য রাশিয়ার ওপর নির্ভর করতে হয়েছিল ইউরোপকে। তবে এটি এ বছর থেকে রাশিয়ার গ্যাসের ওপর নির্ভরতা কমানোর ঘোষণা দিয়েছে। তা সত্ত্বেও বর্তমানে রাশিয়ার গ্যাসের ওপর বিপুলভাবে নির্ভরশীল ইউরোপের দেশগুলো।
ইউরোপ সামনে শীতের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ সপ্তাহে হঠাৎ করে রাশিয়া ইউরোপে গ্যাসের চাপ কিছুটা কমিয়ে দিচ্ছে। যদিও রাশিয়ান কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ব্যবস্থাপনা ত্রুটির কারণে ইউরোপে গ্যাসের সরবরাহে এ ব্যাঘাত ঘটেছে। তবে জার্মানি অভিযোগ জানিয়েছে, ক্রেমলিন জ্বালানিকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে।
ইউরোপের অর্থনীতি নিয়ে কাজ করে এমন একটি বেলজিয়ামভিত্তিক থিংক ট্যাংক ব্রুয়েগেল-এর জ্যেষ্ঠ ফেলো সিমন টাগলিয়াপিয়েট্রা বলেছেন, 'গ্যাজপ্রমব্যাংক-এর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার মানে হচ্ছে রাশিয়ান গ্যাসের ওপর অবরোধ জারি করা। সেটা এ মুহূর্তে করা সম্ভব বলে মনে হয় না।'
'ইইউ'র প্রথমে দরকার রাশিয়ান তেলের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা। সেটা এ বছরের শেষ নাগাদ শুরু হবে,' বলেন তিনি।
উল্লেখ্য, ২০২২ সালের শেষে রাশিয়ান তেলের ৯০ শতাংশ আমদানি বন্ধ করে দেওয়ার পরিকল্পনা করছে ইউরোপ।