জলবায়ু অভিবাসনের চাপে রাজধানী
প্রতিদিন ভোর হওয়ার আগেই ঘুম থেকে ওঠেন মিনুস আক্তার। ১০০ বর্গফুটের একটি খুপড়ি ঘরে স্বামী ও দুই সন্তানের সঙ্গে থাকেন তিনি। আঁকাবাঁকা গলির পথ ধরে কিছুদূর এগোতেই তার ঘরের দরজা। অন্য আর ১০টি পরিবারের সঙ্গে ভাগভাগি করে রান্নাঘর ব্যবহার করতে হয় তাকে। তাই সকাল থেকেই নাস্তা বানানোর জন্য চুলার সামনে লাইনে দাঁড়িয়ে তিনি অপেক্ষা করেন।
৩২ বছর বয়সী মিনুস আক্তার রাজধানী ঢাকার কড়াইল বস্তির বাসিন্দা। ওই বস্তিতে বসবাস করেন প্রায় ২ লাখ মানুষ।
মিনুস থাকতেন দেশের দক্ষিণ উপকূলীয় অঞ্চলে। সেখানে মাত্র আধা একর জমিতে ধানচাষ ও গবাদিপশু লালন-পালন করে জীবিকা চলত পরিবারের। কিন্তু হঠাৎ এক বর্ষায় ভেসে যায় সেই সামান্য সম্পদটুকু। ফলে জীবন-জীবিকার তাগিদে পরিবারসহ তাকে চলে আসতে হয় রাজধানীতে।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বের অনেক দেশেই ব্যাপক অভিবাসন সমস্যা দেখা যাচ্ছে। আর বাংলাদেশের নিম্ন সমুদ্রপৃষ্ঠ, মাত্রাতিরিক্ত জনসংখ্যার ঘনত্ব এবং অপর্যাপ্ত অবকাঠামো অভিবাসন সংকটকে বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। দেশের সাম্প্রতিক বন্যায় অন্তত ৬০ জন মানুষের প্রাণ গেছে; গ্রামাঞ্চল, খেত-খামার, প্রধান নদ-নদী সবই প্লাবিত হয়েছে।
প্রায় ১৭ কোটি জনসংখ্যার এই দেশে ১ কোটিরও বেশি মানুষ জলবায়ু উদ্বাস্তু। দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে নিজেদের ঘরবাড়ি হারিয়ে অন্য অঞ্চলে অভিবাসন খুঁজতে বাধ্য হয়েছে তারা। মাইগ্রেশন কাউন্সিলের তথ্য অনুসারে, প্রতিদিন আনুমানিক ২ হাজার মানুষ ঢাকায় পাড়ি জমাচ্ছে।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বাধীন হওয়ার পর থেকে ঢাকার জনসংখ্যা দেড় মিলিয়ন থেকে বেড়ে বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ২২ মিলিয়নে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির এই প্রবণতা এতটাই অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে যে, ২০১১ সালে ঢাকাকে দুটি অঞ্চলে (উত্তর ও দক্ষিণ ঢাকা) ভাগ করতে বাধ্য হয় সরকার। কারণ এতসংখ্যক মানুষের জন্য সামাজিক সেবা নিশ্চিত করা দুরূহ হয়ে পড়ছিল সরকারের পক্ষে।
সরকারের প্রাক্কলন অনুযায়ী, আগামী ২০৫০ সালের মধ্যে প্রতি ৭ জন বাংলাদেশির একজন জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাস্তুচ্যুত হবে।
কড়াইল বস্তির অবস্থান ঢাকা উত্তরে। এই এলাকার মেয়র মোহাম্মদ আতিকুল ইসলাম বলেন, 'আমার শহরে জনবসতি অনেক বেশি, কিন্তু আমি তো বাস্তুচ্যুত হয়ে ঢাকায় আসা মানুষদের ফিরিয়ে দিতে পারি না।'
বাংলাদেশের জনসংখ্যা বর্তমানে বার্ষিক প্রায় ১ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে সরকারি পরিসংখ্যান অনুসারে ২০২১ থেকে ২০২২ সাল, এক বছরের ব্যবধানে ঢাকার জনসংখ্যা বেড়েছে ৩.৩৯ শতাংশ। প্রতিদিনই বেড়ে চলেছে এ শহরের জনসংখ্যা।
'জলবায়ু পরিবর্তন একটি প্রকট সমস্যা'
মিনুস তার নিজের শহরের জীবনযাপন নিয়ে প্রায়ই স্মৃতিকাতর হয়ে ওঠেন। ঢাকায় আসার পর তার সন্তানেরা প্রায়শই ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়; তাকে রাবার টিউবের দূষিত পানির জন্য টাকা দিতে হয়, ১০০ বর্গফুটের ওই খুপড়ির জন্য ভাড়া গুনতে হয়, অল্প খাবারের জন্য বেশি দাম পরিশোধ করতে হয়। অথচ নিজের শহরে, নিজের বাড়িতে চাষাবাদ ও পশুপালন করেই মিনুসের জীবন ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ। তিনি ঢাকায় এসে এখন অন্যের বাড়িতে গৃহপরিচারিকার কাজ করেন; মাসে আয় করেন প্রায় ৬ হাজার টাকা। আবার করোনাকালীন সময়ে চাকরি হারালেও বাড়িভাড়া ঠিকই গুনতে হয়েছিল তাকে।
মিনুস বলেন, 'আর কোথায় যাব জানি না।'
ঢাকায় কাজ খুঁজতে আসা জলবায়ু অভিবাসীদের কড়াইলের মতো অবৈধ বস্তিতে প্রতিনিয়ত অসহায় অবস্থার মুখোমুখি হতে হয়। এখানে নেই বিশুদ্ধ পানি, নেই সুষ্ঠু ড্রেনেজ ব্যবস্থা; নর্দমায় আবর্জনা জমে থাকা এখানে নিত্য ব্যাপার। গ্যাসের লাইনগুলো গলির মধ্য দিয়ে টানা হয়েছে অবৈধভাবে। বার্নার এবং শর্ট সার্কিট থেকে আগুন লাগা এখানে সাধারণ ব্যাপার। তবে এরচেয়েও বড় হুমকি হলো, বস্তিটি যে ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে সেটি। ১৯৮০-র দশকের শেষের দিকে খালি উঁচু জমিতে গড়ে ওঠা বস্তিটি ধীরে ধীরে জলাধারের কোলঘেঁষে নিচু এলাকায় বিস্তৃত হওয়ায় বিপদ আরও বেড়েছে।
বাংলাদেশে ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট-এর পরিচালক সেলিমুল হক বলেন, ঢাকার জন্য এটি একটি প্রকট সমস্যা।
তিনি বলেন, জলবায়ু অভিবাসীরা কাজ খুঁজতে ঢাকায় ভিড় করছে। ঢাকায় তাদের ভিড় কমানোর একমাত্র উপায় হল, তাদেরকে অন্য কোথাও যেতে উৎসাহিত করা। সেলিমুল হকের প্রতিষ্ঠান দেশজুড়ে প্রায় দুই ডজন দ্বিতীয়-স্তরের শহর চিহ্নিত করেছে, যেখানে জনসংখ্যা রয়েছে ৫ লাখ করে এবং এসব শহরে আরও ৫ লাখ বাস্তুচ্যুতকে আশ্রয় দেওয়া সম্ভব।
তিনি বলেন, অভিবাসীবান্ধব শহর গড়ে তোলার ক্ষেত্রে দুটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে। প্রথমত, প্রতিটি শহরে জলবায়ু-সহনশীল অবকাঠামো তৈরি করতে হবে। এখানে, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর মোংলাকে মডেল হিসেবে নেওয়া যেতে পারে। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্রবন্দর এই শহরেই অবস্থিত।
২০১১ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে এ শহরের জনসংখ্যা ৪০ হাজার থেকে বেড়ে দেড় লাখে উন্নীত হয়েছে। বন্দর এলাকা হওয়ায় প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কাজের সন্ধানে শহরের রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে আসছে অভ্যন্তরীণ অভিবাসী কর্মীরা। ঝড়ের প্রকোপ থেকে বাঁচতে মোংলা শহরের একটি মেরিন ড্রাইভ বরাবর ৭ মাইলজুড়ে বাঁধ দেওয়া হয়েছে এবং বর্ষার পানিকে খালের মধ্যে ফেলতে নিষ্কাশন ব্যবস্থাও উন্নত করা হয়েছে।
এর পাশপাশি দ্বিতীয় যে কাজটি করতে হবে তা হল, অভিবাসীরা যেনো নতুন জায়গায় থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন, সে ব্যাপারটি নিশ্চিত করা।
সেলিমুল হক বলেন, 'স্থানীয় জনগণ এবং অভিবাসী জনগণের মধ্যে সব সময়ই এক ধরনের বৈরিতা কাজ করে, বিষয়টি আমরা সমাধানের চেষ্টা করছি।'
অর্থয়নের ক্ষেত্রে বৈষম্য
বাংলাদেশের অভ্যান্তরীণ অভিবাসী সংকটের ক্ষেত্রে ভয়াবহ বৈষম্যের দৃশ্য দেখা যায়। ২০২০ সালে বাংলাদেশিরা গড়ে প্রায় ০.৫৬ টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গত করেছে, যেখানে আমেরিকানরা গড়ে নির্গত করেছে প্রায় ১৪.২৪ টন। তবুও বাংলাদেশই সবচেয়ে ক্ষতির সম্মুখীন। ঘূর্ণিঝড়, বর্ষা, বন্যা এবং জলোচ্ছ্বাস যেন লেগেই আছে উপকূলে, আর এর প্রভাবে সমুদ্রগর্ভে বিলীন হচ্ছে মানুষের সহায় সম্পদ।
২০০৯ সালের কোপেনহেগেন জলবায়ু সম্মেলনে বিশ্বের ধনী দেশগুলো ২০২০ সালের মধ্যে প্রতি বছর জলবায়ু তহবিলে ১০০ বিলিয়ন ডলার অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কথা ছিল, ওই অর্থ দিয়ে উন্নয়নশীল দেশগুলো তাদের ক্ষতি মোকাবেলা করবে, তবে সেই প্রতিশ্রুতির লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছানো সম্ভব হয়নি কখনো।
গেল বছর গ্লাসগোর কপ-২৬ সম্মেলনে উন্নয়নশীল দেশগুলোর কাকে, কখন এবং কতটা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে তা নিয়েও দ্বিধার শেষ ছিল না।
ঢাকার মেয়র বলেন, 'কপ-২৬-এ অনেক কথা হয়েছে। কিন্তু আমাদের সমাধান দরকার। আমাদের ন্যায়বিচার (ক্লাইমেট জাস্টিস) দরকার।'
২০১৯ সালে আতিকুল ইসলাম মেয়র হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে ঢাকা শহর বিশ্বব্যাংক থেকে মোট ৯৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থায়ন পেয়েছে, যা ক্যালিফোর্নিয়ার ৩৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের জলবায়ু পরিবর্তন বাজেটের প্রায় ০.২ শতাংশ। এছাড়া, ওইসিডি'র এক প্রতিবেদনে অনুমান করা হয়, দাতা দেশগুলো ২০২৩ সালের মধ্যেই ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাবে। তবে এ ব্যাপারে বিস্তারিত কিছুই জানানো হয়নি।
এদিকে, শীঘ্রই স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হতে চলেছে বাংলাদেশ। দ্বিতীয়বারের মতো যোগ্যতার তিনটি মানদণ্ড (আয়, মানব সম্পদ এবং অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত ভঙ্গুরতা সূচক) পূরণ করার পর ২০২৬ সালে জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে গ্রাজুয়েট হতে চলেছি আমরা। এর মাধ্যমে দেশের ক্রেডিট রেটিং যেমন উন্নত হবে, তেমনি বাড়বে বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ। তবে এরসঙ্গে, স্বল্পোন্নত দেশের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় বাংলাদেশ এতদিন যে বিশেষ সুযোগ-সুবিধাগুলো পেয়ে আসছিল তা বন্ধ হয়ে যাবে।
এ বিষয়ে সেলিমুল হক বলেন, 'অনুদান আমাদের দুর্বল করে দিচ্ছে। আপনি একবার অনুদান পেলে অন্যভাবে অর্থের সন্ধান করবেন না, যা সাধারণত ভিক্ষুকরা করে। তাদের কোনো ইচ্ছা নেই। তাদের নিজস্ব কোনো সংস্থা নেই।'
৫০ বছর আগে যখন বাংলাদেশের জন্ম হয়, তখন সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে 'তলাবিহীন ঝুড়ির' সঙ্গে তুলনা করেছিলেন, যে দেশ অন্য দেশের সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকবে। অথচ বাংলাদেশ আজ কিসিঞ্জারকে ভুল প্রমাণিত করে বিশ্বের বুকে সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে। এদেশে সমৃদ্ধ রিয়েল এস্টেট বাজারে রয়েছে, রয়েছে ক্রমবর্ধমান মধ্যবিত্ত শ্রেণি এবং প্রতিনিয়ত বিকশিত হচ্ছে এ দেশের সাংস্কৃতি।
সেলিমুল হকের ভাষায়, 'আমাদের বিশাল অগ্রগতি হয়েছে। তবে এখনও অনেক দূর যেতে হবে।'
- সূত্র: ব্লুমবার্গ থেকে অনূদিত