এক মোগল সম্রাটের তরমুজপ্রীতি
মধ্য এশিয়ার যুবরাজ জহির উদ্দীন মোহাম্মদের পুর্বপুরুষ ছিলেন তৈমুর লং আর চেঙ্গিস খানের মতো দুই বিখ্যাত যোদ্ধা। নিজের সামরিক দক্ষতায় জহির উত্তর ভারত দখল করে হয়ে যান দিল্লীশ্বর বাবর। প্রায় ৩০০ বছর ভারতবর্ষ শাসন করে মোগলেরা। বাবর স্রেফ সম্রাট ছিলেন না, যুদ্ধেও তার বিশেষ প্রতিভা ছিল। একইসঙ্গে বাবর সংস্কৃতিমনাও ছিলেন। বাবরনামা শিরোনামে নিজের আত্মজীবনীও লিখেছেন তিনি।
বাবরনামায় নিজের সম্পর্কে অনেক তথ্যই লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন মোগল সাম্রাজ্যের এ স্থপতি। সেখানে নিজের পছন্দের খাবারদাবারের কথাও উল্লেখ করেছেন তিনি। বাবরকে ভারতবর্ষের খাবারের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে হয়েছিল। তবে তা-তে তার বেশ অসুবিধা হয়েছিল, নিজ দেশের খাবারেই তার বেশি ভক্তি ছিল। তাই স্বদেশী অনেক খাবার ভারতবর্ষে আমদানি করে সেগুলোর মাহাত্ম্যও বাড়িয়ে তুলেছিলেন তিনি।
বাবরনামা থেকে জানা যায়, তিনি ফারঘানায় বেড়ে উঠেছিলেন। বর্তমানে এ অঞ্চলটি কিরগিজস্তান, তাজিকিস্তান, ও উজবেকিস্তানের মধ্যে পড়েছে। সেখানকার আঙুর আর তরমুজ অতি সুস্বাদু বলে নিজের লেখায় প্রশংসা করেছেন বাবর।
বাবরনামায় বাবর কোনো স্থানের বর্ণনা দেওয়ার সময় সেখানকার খাবারের বর্ণনা অবশ্যই দিতেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, বাবরনামার প্রথমদিকের ভাগগুলো মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন ফল খাওয়ার বিশেষ পুস্তক হিসেবে লেখা হয়েছে।
তবে বাবরনামা আপাদমস্তক খাবার নিয়ে সমৃদ্ধ নয়। এর একটি বড় অংশজুড়ে আছে পরিবার, দ্বন্দ্ব ইত্যাদি বিষয়। বাবর বেড়ে উঠেছিলেন এমন পরিস্থিতি ও সময়ে যেখানে যুদ্ধ, দ্বন্দ্ব, সংঘাত ইত্যাদি খুবই স্বাভাবিক ছিল। তাই এসবের মধ্যেও বাবর যে খাবারদাবার নিয়ে বিশেষ আগ্রহ ধরে রেখেছিলেন, তা কিছুটা আশ্চর্যজনক।
১৪৯৪ সালে ১৪ বছর বয়স থেকেই ক্ষমতার লড়াইয়ে জড়িয়ে গিয়েছিলেন বাবর। নিজেদের আত্মীয়স্বজন তিমুরিদ যুবরাজদের বিরুদ্ধে অনেকবার আঞ্চলিক নিয়ন্ত্রণের জন্য লড়াই করেছিলেন বাবর। ১৪৯৭ সালে সমরখন্দ দখল করেও আবার তা হারাতে হয় বাবরকে। ১৫০৪ সালে ২১ বছর বয়সে চিরতরে নিজ দেশ থেকে বহিষ্কৃত হন বাবর।
সে বছর বাবর কাবুল দখল করেন। এরপর কাবুলের ভেতর ও বাইরে কমপক্ষে ১০টি বিশাল বিশাল বাগান সৃষ্টি করেন বাবর। এসব বাগানে অন্য গাছের সঙ্গে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ফলের গাছ রোপন করার ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি।
বাবর ভেবেছিলেন কাবুল থেকে পুনরায় ফারঘানা দখল করার চেষ্টা করবেন। কিন্তু তাতে সুবিধা করতে না পেরে তখন তিনি প্রতিবেশী ভারতবর্ষের দিকে নজর দেন। ১৫২০-এর দশকের শুরুর দিকে দিল্লির উত্তরাঞ্চলে আক্রমণ শুরু করেন তিনি। ১৫২৬ সালে দিল্লি দখল করেন বাবর।
মধ্য এশিয়ার নাগরিকেরা ভারতবাসীকে বিশেষ ভালো চোখে দেখেনি। ভারতীয়রা না ছিল মুসলিম, না পারসিক। বাবরনামায় বাবর লিখেছিলেন, 'হিন্দুস্তান এমন একটা দেশ যেখানে উপভোগ্য বিশেষ কিছু নেই।… এখানে না আছে সুস্বাদু মাংস, না আঙুর বা খরমুজ (ফুটি), না ভালো ফল, না আছে বরফ বা ঠাণ্ডা পানি। এ দেশের বাজারগুলোতে ভালো পাউরুটি বা খাবারও পাওয়া যায় না।'
অবশ্য বাবরের ভারতীয় খাবার নিয়েও বিশেষ পরীক্ষানিরীক্ষা করার অবকাশ ছিল না। নিজের জীবনের শেষ চার বছর স্থানীয় বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে করতেই যায় তার। ৪৮ বছর বয়সে ১৫৩০ সালে আগ্রায় মারা যান তিনি।
কিন্তু ওই সময়টুকুতেও বাবরনামায় স্বদেশে ফিরে যাবার আকুতি প্রকাশ করেছিলেন বাবর। বাড়ি ফিরতে না পারলেও নিদেনপক্ষে সেখানকার সুমিষ্ট আঙুর আর তরমুজের স্বাদ আরও উপভোগ করার আক্ষেপ তার তীব্র ছিল। ভারতে মধ্য এশিয়ার আঙুর আর তরমুজের চাষের ব্যবস্থা করেছিলেন বাবর। এটা ছিল তার স্বদেশি খাবারের শোক ভোলার একটি অবলম্বন। মোগল রসুইঘরে স্থানীয় পাচকদের পারসিক খাবার রান্নার আদেশ দিয়েছিলেন বাবর।
বাবর ভারতে মধ্য এশিয়ার একটি ফুড সাপ্লাই চেইনের সূচনা করেছিলেন। তবে ওই অঞ্চল থেকে তিনিই একমাত্র ব্যক্তি ছিলেন না যিনি ভারত শাসন করেছিলেন। ১২০৬ সাল থেকে বাবরের শাসন শুরু পর্যন্ত মধ্য এশিয়ার পাঁচটি বংশ ভারতবর্ষ শাসন করেছিল। এসব শাসকদের দ্বারাও তাদের মাতৃভূমির অনেক খাবার ভারতবর্ষে পৌঁছেছিল।
বাবরের মৃত্যুর পরবর্তী ১০০ বছর ধরে অন্যান্য মোগল শাসকেরা খাবারদাবারের ক্ষেত্রে বাবরের পথেই হেঁটেছেন, তার পরিচিত করা খাবারগুলো খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলেছিলেন। তাদের সময়েও মধ্য এশিয়া থেকে অবাধে ফলমূল ভারতে এসেছিল। এমনকি হুমায়ূন তো দিল্লিতে পারস্য থেকে পাচক নিয়ে এসেছিলেন।
বাবরের উত্তরসূরীরাও রসুইখানার জন্য দুহাতে খরচ করেছিলেন। তাদের কাছে খাবার হয়ে উঠেছিল মর্যাদা ও সম্মানের প্রতীক। তবে বাবর যেখানে পারসিক রান্নাতেই মুগ্ধ ছিলেন, অন্য মোগল সম্রাটেরা ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মোগলের রান্নাঘরে পাচকদের একত্রিত করেছিলেন। তাদের দেখাদেখি ভারতবর্ষের সম্ভ্রান্ত পরিবারগুলোও ক্রমশ পারসিক রান্নাকে নিজেদের রান্নাঘরে প্রচলন করে।
এ রান্নাগুলো ছিল সুস্বাদু, ও সুগন্ধযুক্ত। এগুলোর সঙ্গে প্রায়ই বাদাম, বিভিন্ন শুকনো ফলের সমভিব্যাহার দেখা যেত। এগুলো সেসব ফল যেগুলো বাবার ভালোবেসে ভারতবর্ষে প্রচলন করেছিলেন। এ খাবারগুলো ভারত ছাড়িয়ে ক্রমশ পশ্চিমা বিশ্বেও ছড়িয়ে পড়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে ভারতীয়রা রেস্তোরাঁ ব্যবসায় শুরু করার পর তারা মোগলদের অবদান ও খাবারগুলোকেই ভারতীয় খাবারের প্রতিনিধি হিসেবে পশ্চিমাদের কাছে তুলে ধরেছেন।
ভারতবর্ষে পারসিক খাবারের যে এত বিবর্তন ঘটলো- এসব কিছুই বাবর বুঝেশুনে করেননি। তবে ভারতে পারসিক ফলের বংশবৃদ্ধি ঘটিয়ে, আগ্রা ও দিল্লিতে পারসিক খাবারের বিপণি বসিয়ে বাবর যে তরঙ্গের সূচনা করেছিলেন, তা ধাক্কা দিয়েছে ভারতবর্ষ ও এর রান্নাপ্রণালীকে।
- সূত্র: অ্যাটলাস অবস্কুরা