পৃথিবীর সবচেয়ে বিশুদ্ধ খাবার কি ঘি?
গরম ভাত, মাছ ভাজা; ডিম, আলু ভর্তা, ফেনা ভাত; খিচুড়ি- বাঙালির চিরায়ত এ খাবারগুলোর স্বাদ নতুন মাত্রা পায় পাতে একটু ঘিয়ের ব্যবস্থা থাকলে।
একসময় এ ঘিকে অস্বাস্থ্যকর খাবার হিসেবে বিবেচনা করা হতো। কিন্তু ঘিকে এখন দেখা হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে বিশুদ্ধ খাবার হিসেবে।
কয়েকশ বছর ধরে ভারতবর্ষে খাবার হিসেবে জনপ্রিয় ও সমাদৃত ছিল ঘি। কিন্তু গত কয়েক দশক আগে থেকে সম্পৃক্ত চর্বিকে (স্যাচুরেটেড ফ্যাট) স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করার পর ঘিয়ের আদর কমে যায়।
কিন্তু হাল আমলে বিশ্বব্যাপী সম্পৃক্ত চর্বি নিয়ে মানুষের ভাবনা পাল্টাতে শুরু করেছে। ফলে ঘিয়ের মর্যাদা আবারও একটু একটু করে ফিরে আসছে ভারতবর্ষের রান্নাঘরগুলোতে।
ভারতে ধীরে ধীরে ঘিয়ের জনপ্রিয়তা আবার বাড়তে শুরু করেছে। দেশটির মানুষ এ সময়ে এসে নিজেদের দেশীয় খাবারের দিকে নতুন করে মনোযোগ দিচ্ছেন। আর ঘি বানানোও বেশ সহজ, ঘরে ঘরেই চাইলেই এ খাবারটি তৈরি করা যায়। দেশটির সংস্কৃতির সঙ্গেও ঘি ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
গুজরাটের সুরাটে ঘি তৈরি করার ফার্ম আছে নীতিন আহিরের। ঘি বানানোর কাজটাতে তার কষ্ট হয় না, বরং তিনি এটাকে ভালোবাসেন। সাধারণত বড় মাপের ঘি প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলো বিদেশি জাতের গরুর দুধ থেকে ঘি তৈরি করে। কিন্তু আহির ঘি তৈরি করেন গির গরুর দুধ থেকে।
গির একটি ভারতীয় জাতের গরু। আহিরের নিজের গির গাভির পাল রয়েছে। খোলা মাঠে চরে খায় এ গরুগুলো। তবে দোহানোর আগে বাচ্চাদের পেটপুরে দুধ খাওয়াটা নিশ্চিত করেন তিনি।
আহিরের ডেইরিতে তৈরি সবচেয়ে উন্নতমানের ঘি তৈরি করা হয় 'বিলোনা' পদ্ধতিতে। করোনাভাইরাস মহামারি শুরু হওয়ার পর থেকে তার ঘিয়ের চাহিদা ২৫-৩০ শতাংশ বেড়ে গেছে বলে জানান আহির।
ঘিয়ের আদি জন্মস্থান ভারতবর্ষ বলে ধারণা করা হয়। মাখন নষ্ট হয়ে যাওয়া থেকে বাঁচাতে এখানে মাখনকে ঘিয়ে পরিণত করার মাধ্যমে এ খাবারের জন্ম।
তবে অনেক ভারতীয়র কাছে ঘি স্রেফ খাদ্য উপাদানের চেয়েও অনেক বড়কিছু। তারা এটাকে পবিত্র হিসেবে বিবেচনা করেন।
খাবার ইতিহাসবিদ পৃথা সেন বলেন, 'ঘি হচ্ছে দুধের চূড়ান্ত ও বিশুদ্ধতম রূপ। দেবতাদের উৎসর্গের জন্য এটাকে সবচেয়ে পবিত্র উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা হতো। স্বর্গে প্রার্থনা পৌঁছানোর মাধ্যম ছিল ঘি।'
'ঘিয়ের বন্দনা পাওয়া যায় প্রায় ৪০০০ বছর পুরনো ঋগবেদে। সনাতন ধর্মের সৃষ্টির দেবতা ব্রহ্মা নিজের দুহাত ঘর্ষণের মাধ্যমে প্রথম ঘি উৎপাদন করেন। সে ঘি অগ্নিশিখায় আহুতি দিয়ে নিজের পুত্রদের সৃষ্টি করেন তিনি,' জানান শিকাগোভিত্তিক আরেক ফুড হিস্টোরিয়ান কলিন টেইলর সেন।
ভারতীয় সংস্কৃতিতে ঘিয়ের গভীর উপস্থিতি রয়েছে। বিয়ে, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া, ও অন্যান্য ধর্মীয় অনুষ্ঠানে হিন্দুরা আগুনে ঘি উৎসর্গ করেন। আয়ুর্বেদে ঘিকে মহৌষধ হিসেবে মানা হয়।
বাচ্চাদের হাড় ও মস্তিষ্কের পুষ্টি ও ভিটামিনের জন্য ঘি কার্যকর বলে জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রে বাস করা খাবারদাবার বিষয়ক লেখক সন্দীপা মুখার্জি দত্ত। 'ঘি কেবল খাবার রান্না ও ভাজার উপাদান নয়। আধুনিককালে সকালের নাস্তায় যা-ই থাকুক না কেন, একসময় বাঙালির সন্তানেরা সকালবেলা ঘি-আলুসেদ্ধ-ভাতই খেত,' বলেন তিনি।
ঘিয়ে সম্পৃক্ত চর্বির পরিমাণ ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ। ১৯৮০'র দশকে ঘি খাওয়া কমিয়ে দেয় ভারতবর্ষের মানুষ। তখন কোম্পানিগুলো জোরেশোরে ভেজিটেবল অয়েলের প্রচারণা চালিয়েছিল। এর জেরে ঘিয়ের চাহিদা পড়ে যায়, মানুষ বেশি বেশি ভেজিটেবল অয়েল ব্যবহার করতে শুরু করে।
একসময় বাঙালির ঘরে ঘরে ঘি ছিল সাধারণ আহার্য বস্তু। কিন্তু ভেজিটেবল অয়েলের দৌরাত্ম্যে এটি হয়ে গেল নিত্যকার ব্যবহার্য তেল, আর ঘি পরিণত হলো কালেভদ্রে ব্যবহৃত উপাদান হিসেবে।
সেলিব্রিটি শেফ, লেখক, ও মাস্টারশেফ ইন্ডিয়ার বিচারক রণবীর ব্রার বলেন, 'আশির দশকের চর্বি নিয়ে এ বিতর্ক ঘিকে ভিলেইন বানিয়ে দিয়েছিল। সৌভাগ্যক্রমে আমরা এখন চর্বি ও কোলেস্টেরল বিষয়ে আগের চেয়ে ভালো বুঝি।'
যদিও এখনো হাই-ফ্যাট নিয়ে সতর্ক থাকতেই পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা। তবে অনেকেই সম্পৃক্ত চর্বির সার্বিক ঝুঁকির বিষয়ে নিজেদের সুর নরম করেছেন। হাই ফ্যাট কিটো ডায়েট জনপ্রিয় হওয়ায় এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশেও ঘিয়ের জনপ্রিয়তা বেড়েছে।
ঘিকে কীভাবে সর্বোত্তম উপায়ে ব্যবহার করা যায়? রণবীরের পরামর্শ, ডাল, কোর্মা ইত্যাদি খাবারের সঙ্গে ঘি ব্যবহার করা ভালো। ভারতের অনেক প্রথমসারির শেফ ও রেস্তোরাঁ আজকাল রান্নায় ঘি ব্যবহার করছে। ইন্ডিয়ান অ্যাক্সেন্ট রেস্তোরাঁর রান্না বিষয়ক পরিচালক শেফ মনীশ মালহোত্রা মনে করেন, বিশ্ব এখন ভারতের রান্নাকে বুঝতে পারছে ও এর 'আদি' স্বাদের স্বীকৃতি দিচ্ছে।
ঘিয়ের মাহাত্ম্য বোঝা মানে ভারতের একটি সামগ্রিক প্রতীক- এর খাবারকে বুঝতে পারা। আর যখন ঘিয়ের আসল নির্যাসকে অনুধাবন করা যায়, তখন ঘি থেকে তৈরি হতে পারে পৃথিবীর সুস্বাদুতম ভোজনের আয়োজন। রণবীর ব্রার বলেন, 'ছোটবেলায় ঠাকুরমার সঙ্গে বেড়ে উঠেছি, আমাদের পুরো বাড়ি ঘিয়ের গন্ধে ম-ম করতো। আজও যখন তাকে হাত বাড়িয়ে ঘিয়ের কৌটা নিতে যাই, তখন কেবল চর্বি নয়, ছোটবেলাটার খোঁজও করি।'
সূত্র: বিবিসি