সপ্তাহে চার কার্যদিবস যেভাবে পরিবেশ ও জলবায়ুর জন্য উপকারী
সাপ্তাহিক কার্যদিবস চার দিন করলে পাওয়া যাবে তার পরিবেশগত সুফল। কমবে দূষণ আর প্রকৃতির ওপর চাপ। এমনটাই বলছেন পরিবেশবাদীরা। তবে কর্মদিবস কমলে তার বড় সুফলভোগী হবেন কিন্তু কর্মীরাই। শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যেরও উন্নতি ঘটবে কর্মীদের। বাড়বে তাদের সৃজনীশক্তি ও উৎপাদনশীলতা।
বিশ্বব্যাপী চার কর্মদিবস চালুর পক্ষে প্রচারণা চালায় এমন একটি অলাভজলাক জোট হলো - 'ফোর ডে উইক গ্লোবাল'। এর প্রধান নির্বাহী জো ও'কনোর বলেন, 'আমরা একেই তিনগুণ লাভবান হওয়ার নীতি বলছি; কারণ এর মাধ্যমে অর্থনীতি, সমাজ ও পরিবেশ–সবাই উপকৃত হবে'।
তিনি বলেন, 'সাপ্তাহিক কর্মঘণ্টা কমলে যত সুবিধা পাওয়া যাবে- সেটি নিশ্চিত করার মতো যথেষ্ট পরিমাণে নীতিগত হস্তক্ষেপ বর্তমান বিশ্বে নেই'। সরকারি ও বেসরকারি খাতে এই নীতি পরিবর্তন আনতেই জোটটি কাজ করছে।
পরিবেশ দূষণ কমার দিকটিই এপর্যন্ত সবচেয়ে বেশি প্রমাণিত সুবিধা। বিগত অনেক বছর ধরে চলে আসা গবেষণাগুলি ইঙ্গিত দিচ্ছে, কর্মঘণ্টা কমার সাথে কার্বন নিঃসরণ হ্রাসের রয়েছে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। বিশেষজ্ঞরা ব্যাখ্যা করছেন, যেদিন অফিসের যাওয়ার প্রয়োজন নেই–সেদিন নগরীর সড়কে যানবাহনের চাপ কম থাকে। ব্যবহার কম হয় জ্বালানি ও বিদ্যুতের। জীবনযাপনের ধরনেও বাড়তি ছুটিছাটা পাওয়ার একটা পরিবর্তন যোগ হয়। এসব মিলিয়ে দূষণের মাত্রাও কমে আসে।
১৯৭০ সাল থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত করা এ ধরনের গবেষণার তথ্যউপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা গেছে, কর্মঘণ্টা ১০ শতাংশ হ্রাস করলে বাস্তুসংস্থানের ওপর চাপ কমে ১২.১ শতাংশ। কার্বন ফুটপ্রিন্ট ও কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণের ফুটপ্রিন্ট কমে যথাক্রমে- ১৪.৬ এবং ৪.২ শতাংশ।
বোস্টন কলেজের অর্থনীতিবিদ ও সমাজবিজ্ঞানী জুলিয়েট শোর। দীর্ঘদিন ধরে তিনি গবেষণা করছেন 'কর্ম, ভোগচাহিদা এবং জলবায়ু পরিবর্তন' বিষয়ে। তিনি জানান, 'বহু বছরের গবেষণার তথ্য থেকে আমরা জেনেছি, যেসব দেশে কর্মঘণ্টা কম–তাদের কার্বন নিঃসরণের পরিমাণও কম। আসলে কাজের সময় কমালে সরাসরি তার প্রভাব পড়ে কার্বন নিঃসরণে'।
যেমন কর্মঘণ্টা কমানো হলে কাজের বাইরে মানুষের নিত্যদিনের জীবনে তার বড় প্রভাব পড়ে। এতে মানুষ আরও পরিবেশসম্মত জীবনযাপনের অভ্যাস গড়ে তোলার দিকেও উৎসাহী হয় বলে জানাচ্ছেন সেন্টার ফর ইকোনমিক অ্যান্ড পলিসি রিসার্চ- এর সহকারী পরিচালক মার্ক ওয়েইসব্র।
তার মতে, ' কেউ যখন নিজেকে ও পরিবারকে বেশি সময় দিতে পারে, তখন দেখা যায় তার অতি-ভোগ চাহিদা অনেকটাই কমে আসে'।
তবে এই উপকার নির্ভর করে একাধিক বিষয়ের ওপর। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানুষ কীভাবে কাজের বাইরে সময় ব্যয় করে বিশেষত তার ওপরই এটি নির্ভর করে। যেমন কেউ যদি অবসর সময়ের বেশিরভাগ সময় জীবাশ্ম-জ্বালানি চালিত গাড়ি চালিয়ে ব্যয় করেন–তাহলে তার কার্বন ফুটপ্রিন্ট না কমে উল্টো বাড়তেও পারে।
বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় কর্মঘণ্টা কমানো একটি অপরিহার্য কৌশল– চিরস্থায়ী সমাধান নয়।
ও'কনোর বলেন, 'কেউ কেউ যুক্তি দিচ্ছেন, চার কার্যদিবস এমন জাদুর কাঠি যার ছোঁয়ায় পরিবেশ নিয়ে আমাদের সব সমস্যা দূর হবে–কিন্তু বাস্তবতা তার থেকে অনেক দূরে। তবে এই পন্থা একটি শক্তিশালী নিরাময়কের অবদান রাখতে পারে অবশ্যই'।
আন্তঃনগর চলাচল ও দূর ভ্রমণে প্রভাব
শোর উল্লেখ করেন, যোগাযোগ ব্যবস্থা আজকের বিশ্বে গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণের অন্যতম বড় উৎস। মানুষের এক স্থান থেকে অন্যত্র চলাচল এর পেছনে বড় ভূমিকা রাখছে'।
যেমন ২০২০ সালে যোগাযোগ খাত যুক্তরাষ্ট্রের মোট কার্বন নিঃসরণের ২৭ শতাংশের জন্য দায়ী ছিল বলে জানাচ্ছে দেশটির পরিবেশ সুরক্ষা সংস্থা (ইপিএ)।
পরিবেশের ওপর জনসাধারণের অবাধ চলাচল কমার সবচেয়ে দৃশ্যমান অবদান দেখা গিয়েছিল করোনাভাইরাস মহামারির শুরুর সময়ে। এসময় বেশিরভাগ মানুষকে ঘরে অবস্থান করতে হয়; ফলে কমেছিল সড়ক ও আকাশপথে চলাচল। কমেছিল শিল্প পণ্যের পরিবহন ও উৎপাদনও। এসময় বিশ্বব্যাপী বড় বড় শহরের বাতাসের মানে উল্লেখযোগ্য উন্নতি লক্ষ করা গেছে। বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণও কমে আসে।
মহামারির সময়েই জনপ্রিয়তা পায় কর্মীদের ঘরে থেকে কাজ করার হাইব্রিড মডেল। এসময়ে সপ্তাহে পাঁচদিন কাজ করলেও- অনেক আমেরিকান ভ্রমণ কম করেছেন। কিন্তু, সপ্তাহে চার কার্যদিবস চালু করা গেলে যেসব শিল্প এখনও কর্মীর সশরীরে উপস্থিতির ওপর নির্ভরশীল, তারাও উপকৃত হবে বলে মনে করেন ও'কনোর।
২০২১ সালে যুক্তরাজ্যে ২,০০০ কর্মী এবং ৫০০ ব্যবসায়ী নেতার মধ্যে এক জরিপ পরিচালনা করা হয়। এতে দেখা গেছে, সপ্তাহে চার কার্যদিবস চালু করলে, বাড়ি থেকে কর্মক্ষেত্রে যাতায়াত প্রতি সপ্তাহে কমবে ৬৯১ মিলিয়ন মাইল।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানির সাশ্রয়:
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কর্মঘণ্টা কমলে জ্বালানি ও বিদ্যুতের ব্যবহারও কমবে।
২০০৬ সালের এক গবেষণা নিবন্ধে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রে যদি ইউরোপের অনুকরণে কর্মের মানদণ্ড চালু করা হতো–তাহলে দেশটিতে বিদ্যুতের জ্বালানির ব্যবহার কমতো ২০ শতাংশ। আর ইউরোপ যদি সাপ্তাহিক কাজের সময় বাড়ায়– তাহলে আরও ২৫ শতাংশ বেশি জ্বালানি ব্যবহার করবে'।
ওয়েসব্র বলেন, 'উৎপাদন, ভোগ এবং কার্বন নিঃসরণের মধ্যে এটাই সরাসরি সম্পর্ক'।
তা ছাড়া, আধুনিক সব অফিসই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। এগুলি চালাতে বিপুল পরিমাণ বিদ্যুতের প্রয়োজন হয়। অফিসের সময় কমালে বিদ্যুতের চাহিদাও অনেকগুণ হ্রাস পাবে।
২০০৮ সালে আমেরিকার উটাহ প্রদেশের সরকারি কর্মীদের মধ্যে চার কার্যদিবস পরীক্ষামূলকভাবে চালু করা হয়। তখন দেখা যায়, একদিন বেশি অফিস বন্ধ রাখলে বছরে ৬,০০০ মেট্রিক টন কম কার্বন নিঃসরণ হবে। এই গবেষণা নিবন্ধটি প্রকাশ করে সায়েন্টিফিক আমেরিকান।
অর্থনীতিবিদ ও সমাজবিজ্ঞানী জুলিয়েট শোর বলছেন, কতোটা জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সাশ্রয় হবে–তা নির্ভর করে কোন প্রতিষ্ঠান কি ধরনের উদ্যোগ নেয়- তার ওপর।
যেমন- কোনো প্রতিষ্ঠান যদি চার কার্যদিবস চালু থাকে, তাহলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ব্যবহার অনেকটা কমবে। কিন্তু, যদি কর্মীদের পালাক্রমে চারদিন কাজ করার সুযোগ দেওয়া হয় এবং অফিস আগের ছুটির দিন ছাড়া অন্য সময় খোলা থাকে– তাহলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির ব্যবহার ন্যূনতম পরিমাণে কমবে।
- সূত্র: ওয়াশিংটন পোস্ট