পাওয়ারলিফটিংয়ে বিশ্বজয়: রাইয়ানের রৌপ্য ও ব্রোঞ্জ জেতার গল্প
'প্রথমবার যখন শুনি মাইকে ডাকছে "রাইয়ান রহমান ফ্রম বাংলাদেশ" তখন গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছিল। চারদিক থেকে ক্যামেরা, সামনে তিনজন বিচারক, চারপাশে অজস্র মানুষ সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে,' বলছিলেন আন্তর্জাতিকভাবে পাওয়ারলিফটিংয়ে রৌপ্য ও ব্রোঞ্জ বিজয়ী রাইয়ান রহমান।
অদ্ভুত নেশাই বটে, নাহলে এতকিছু থাকতে পাওয়ারলিফটিং! তাতে আবার বিশ্বজয়! প্রথমবারের মতো পাওয়ারলিফটিংয়ে বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশকে অভুতপূর্ব সাফল্য এনে দিয়েছেন ১৮ বছর বয়সী তরুণ রাইয়ান।
তাও আবার যেনতেন অর্জন নয়, স্কোয়াটে রৌপ্য পদক ও ডেডলিফটে ব্রোঞ্জ পদক রাইয়ানের হাত ধরে এসেছে বাংলাদেশে। ইন্টারন্যাশনাল পাওয়ারলিফটিং ফেডারেশন আয়োজিত 'ওয়ার্ল্ড ক্লাসিক অ্যান্ড ইকুইপড সাব-জুনিয়র অ্যান্ড জুনিয়র পাওয়ারলিফটিং চ্যাম্পিয়নশিপ' প্রতিযোগিতায় ৫৯ কেজি ওজন শ্রেণিতে অংশগ্রহণ করে বাংলাদেশের রাইয়ান রহমান সর্বমোট ৪৫২.৫ কেজি ওজন উত্তোলন করে অর্জন করেছেন ৪র্থ স্থান।
বাংলাদেশ ছাড়াও এই গ্রুপে আমেরিকা, ব্রাজিল, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, মেক্সিকো, সাউথ আফ্রিকা, জাপানসহ ৯টি দেশের ১২ জন পাওয়ারলিফটার অংশগ্রহণ করেন। ২৭ আগষ্ট থেকে শুরু হওয়া পাওয়ারলিফটিংয়ের সর্বোচ্চ পর্যায়ের প্রতিযোগিতায় ৪৯ দেশের ২১৬ জন পাওয়ারলিফটার অংশগ্রহণ করছেন। তুরস্কের ইস্তানবুলে অনুষ্ঠিত হওয়া এই প্রতিযোগিতায় এবারই প্রথম বাংলাদেশ অংশগ্রহণ করে।
একদিকে পড়াশোনা আরেকদিকে পাওয়ারলিফটিং, উভয়দিকেই সমানভাবে বাজিমাত করে যাচ্ছেন রাইয়ান। তাই মা-বাবার শুরুর দিকে ছেলের ব্যাপারে চিন্তায় থাকলেও পরে তা নিমিষেই কেটে যায়। বর্তমানে ম্যানগ্রোভ কলেজে এ লেভেলে পড়ুয়া রাইয়ান নিজের ব্যাপারেও বেশ সচেতন। জিমে গিয়ে দীর্ঘসময় ধরে পাওয়ারলিফটিংয়ের চর্চা করলেও, পড়ালেখায় দেননি এক চুল ছাড়। তাই দেশীয় গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও ছিটিয়েছেন আলোকচ্ছটা।
ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, প্রাচীন গ্রীসেই জন্ম হয় পাওয়ারলিফটিং এর। গ্রীসের পুরুষেরা নিজেদের শক্তি ও পুরুষত্ব প্রদর্শনের লক্ষ্যে পাথর দিয়ে পাওয়ারলিফটিং এর চর্চা করতেন। অলিম্পিকের অংশ না হলেও ১৯৮৪ সাল থেকে প্যারাঅলিম্পিকের অংশ হিসেবে বিশ্বব্যাপী রাজ করছে পাওয়ারলিফটিং।
মোমিন এইচ রনের হাত ধরে বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে পাওয়ারলিফটিং শুরু হয় ২০১৮ সালে। বাংলাদেশের হয়ে তিনিই প্রথম আন্তর্জাতিকভাবে পাওয়ারলিফটিং এ রেফারির দায়িত্ব পালন করেছেন। তার উদ্যোগেই বাংলাদেশে গড়ে ওঠে বাংলাদেশ পাওয়ারলিফটিং এসোসিয়েশন। বর্তমানে এসোসিয়েশনের তালিকা অনুযায়ী বাংলাদেশে পাওয়ারলিফটারের সংখ্যা ১৫০ জনের মতো, যারা নিয়মিত জাতীয় প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন।
পাওয়ারলিফটিংয়ে যেভাবে আগ্রহ জন্মালো রাইয়ানের
'আমার বড় ভাই একজন অ্যাথলেট ছিলেন। ছোটবেলা থেকেই দেখতাম খেলাধুলায় ভাই অনেক মেডেল পেতো। ওকে দেখে আমারও মেডেল পাওয়ার ইচ্ছা হতো। আমি ছোটবেলায় বেশ স্থূল ছিলাম। তা নিয়ে অনেকেই কথা বলতো, হাসাহাসিও করতো। সেটা গায়ে লাগতো অনেক। আউট অফ শেপ হওয়ার কারণে ফিটনেসের জন্যই জিমে যাওয়ার কথা মনে হয়েছিল,' বলেছিলেন রাইয়ান।
ক্লাস এইটে পড়াকালীন রাইয়ানের পাওয়ারলিফটিংয়ের প্রতি আগ্রহ জন্মায়; হাতেখড়ি হয় জিমেই। জিমের প্রতি ভালোলাগা থেকে নিয়মিত চালিয়ে যেতেন চর্চা। কিন্তু ছোটবয়সে অতিরিক্ত জিমে যাওয়া নিয়ে মায়ের চোখরাঙানি চলতেই থাকত। তাই মাকে কোনোভাবে বুঝিয়েই ছুটে যেতেন জিমে, হারিয়ে যেতেন পাওয়ারলিফটিং এর দুনিয়ায়।
জিমে গিয়ে পেয়ে যান একজন ট্রেইনারকে; পরবর্তী সময়ে তিনিই রাইয়ানকে হাতে ধরে পাওয়ারলিফটিং শিখিয়েছেন। কোচ তাহসিন আলী জানান, 'রাইয়ানের সাথে আমার পরিচয় জিম থেকেই। আমি শুরু থেকেই জিমে পাওয়ারলিফটিং ট্রেনিং করতাম। আমি যখন চর্চা করতাম রাইয়ান সেটা পাশে দাঁড়িয়ে দেখতো সবসময়। ওর মধ্যেও এটা নিয়ে আগ্রহ তৈরি হচ্ছিল অনেক।'
রাইয়ানের অনুপ্রেরণা হিসেবেও কাজ করেছেন তাহসিন আলী। তিনি জানান, 'জিমে এসে কোচকে দেখে আমি প্রথমে বুঝতাম না উনি কী করছেন। দেখে মনে হতো যেভাবেই হোক ওনার মতো শক্তিশালী আমাকে হতেই হবে।'
পাওয়ারলিফটিংয়ে যুক্ত হওয়ার পর খাবারদাবারের ব্যাপারে রাইয়ানকে বেশ সচেষ্ট থাকতে হয়। ক্যালরি মেপে খাওয়ার অভ্যাস রপ্ত করতে হয়েছে তাকে। অতিরিক্ত তেল-ঝালযুক্ত খাবার এড়িয়ে যেতে হয় সবসময়। লক্ষ্য একটাই, ওজন যাতে বেড়ে না যায়। কোরবানির সময় গরুর মাংস খেতে হলেও মাপজোখ করেই খান। ১২০ গ্রাম স্টেক খাদ্যতালিকায় রাখার চেষ্টা করেন সবসময়।
অংশ নেন ন্যাশনাল পাওয়ারলিফটিং প্রতিযোগিতায়
২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ন্যাশনাল পাওয়ারলিফটিং প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার জন্য রাইয়ানকে পরামর্শ দেন তার কোচ। সেখান থেকেই গুরুর মতো শিষ্যকে শিক্ষাদান করতে থাকেন তাহসিন আলী। যত্নসহকারে শেখাতে থাকেন কীভাবে পাওয়ারলিফটিং এর চর্চা করলে বিজয়ের মুকুট অর্জন করা যাবে। প্রতিদ্বন্দ্বীমূলক স্বভাবের রাইয়ানও বুঝে নিতে থাকেন খুঁটিনাটি।
অবশেষে এগিয়ে আসে ন্যাশনাল পাওয়ারলিফটিং প্রতিযোগিতা। সেখানে গিয়ে গুরুর শেখানো পথ অনুসরণ করে রাইয়ান ন্যাশনালে স্কোয়াট ও ডেডলিফটের পূর্বের সকল রেকর্ড ভেঙ্গে দেন। কিন্তু বেঞ্চপ্রেসে পিছিয়ে যাওয়ার কারণে এ যাত্রায় প্রথম পুরস্কার পাওয়ার থেকে বঞ্চিত হন।
২০২১ সালে বাংলাদেশের ন্যাশনাল পাওয়ারলিফটিং প্রতিযোগিতায় ২য় স্থান অর্জন করে রাইয়ান। প্রথমবারে গিয়েই ২য় স্থান অর্জন রাইয়ানের আত্মবিশ্বাস আরো অনেক বাড়িয়ে দেয়। এ লেভেল পরীক্ষা থাকায় পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে চলতে থাকে পাওয়ারলিফটিং সংক্রান্ত অন্যান্য প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ। এমনও অনেক হয়েছে মাকে লুকিয়েই প্র্যাক্টিসে যাবার নাম করে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে জিতে আসতো রাইয়ান। আইপিএফ এর মতো আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় সুযোগ পাওয়ার পর মা-বাবার অনুমতি নিয়েই রওনা হয় তুরস্কের উদ্দেশ্যে।
তবে তুরস্কে যাওয়ার পথেও মুখোমুখি হতে হয় নানা বিপত্তির। ভিসা সংক্রান্ত জটিলতা তো ছিলোই, সময়মতো ভিসা পেয়ে যাওয়া হবে কি না তা নিয়েও অনিশ্চয়তা ছিলো। তাছাড়া চ্যাম্পিয়নশিপের আগে সেভাবে প্রস্তুতিও নেয়া সম্ভব হয়নি রাইয়ানের। প্রতিযোগিতায় নিবন্ধন শেষ হওয়ার মাত্র চার ঘণ্টা আগে রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন করেন তিনি। ১০ থেকে ১২ সপ্তাহের প্রস্তুতির জায়গায় মাত্র ছয় সপ্তাহের প্রস্তুতিতে রাইয়ান খেলতে গিয়েছিলো তুরস্কতে।
প্রতিযোগিতার দিনলিপি
৩১শে আগস্ট রাইয়ান দেশকে প্রতিনিধিত্ব করতে ওঠেন মঞ্চে। চারপাশের আলোর ঝলকানি আর সামনে অজস্র ক্যামেরা দুয়ের সমন্বয় রাইয়ানের সামনে নতুন পৃথিবী উন্মোচন করে। রাইয়ান অংশ নেয় ক্ল্যাসিকের 'র' অংশে; যেখানে মূলত সহায়ক কোনোকিছু পরিধান করা ছাড়াই বার তুলতে হয়।
'আমি যখন মূল মঞ্চে যাই, তখন নার্ভাস ছিলাম অনেক। সামনে দেখি সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তার উপর কিছু সরঞ্জাম ছিলো যেগুলো আগে ব্যবহারই করিনি। আমাদের দেশে এমন প্লেটস আছে যেখানে বলা হবে ওজন ২০ কেজি কিন্তু আসলে দেখা যায় ওজন ১৯ কেজি ৫০০ গ্রাম। কিন্তু প্রতিযোগিতায় এমন ছিলো না। সেখানে ২০ কেজি মানেই ২০ কেজি,' প্রতিযোগিতায় ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়ে বলছিলেন রাইয়ান।
তাছাড়াও প্ল্যাটফর্মের মেঝে অনেকটাই মখমলীয় ছিলো। যার কারণে ঠিকমতো দাঁড়ানো নিয়েও সমস্যায় পড়তে হয়েছিল তাকে। বেঞ্চপ্রেস করার আগে পিঠে ব্যথা আত্মবিশ্বাস অনেকটাই কমিয়ে দেয় রাইয়ানের। যার জন্য ২০ কেজি ওজনের বার তুলতেও বেশ বেগ পেতে হচ্ছিল তাকে। কিন্তু রাইয়ান নিজেকে নিয়ে আশাবাদী ছিলেন অনেক, মঞ্চে ঢুকেই নিজের পক্ষে দর্শকদের নিয়ে আসেন। দর্শকের উন্মাদনা রাইয়ানকে ধীরে ধীরে বিজয়ের দিকে নিয়ে যায়।
রাইয়ানের ভাষ্যমতে, প্রতিযোগিতায় ব্যবহৃত অনেক যন্ত্রই বাংলাদেশে পাওয়া যায় না। যার জন্য অভিজ্ঞতার ঝুলিও ছিলো প্রায় শূণ্য। এই অবস্থায় ঘাবড়ে যাওয়াও অস্বাভাবিক কিছু হয়। সেটিই হয়েছে রাইয়ানের সাথে; ধারালো বার ধরার সাথে সাথেই হাত কেটে যায়। প্রথম অবস্থায় সামলাতে বেগ পেতে হলেও পরক্ষণেই সামলে নেন তিনি।
এছাড়াও সময়ের ভিন্নতা, খাবার-দাবার সবমিলিয়ে কিছু সমস্যা এলেও তা সামলে নিজেকে নতুন করে প্রমাণ করার অদ্ভুত শক্তি জাগ্রত হয় তার মধ্যে।
স্কোয়াটে দ্বিতীয়স্থান, ডেডলিফটে তৃতীয়স্থান ও বেঞ্চপ্রেসে ষষ্ঠস্থান অর্জন করায় সবমিলিয়ে চতুর্থস্থানের পুরষ্কার রাইয়ানের ঝুলিতে আসে। তবে এই প্রতিযোগিতায় জাপানের অবস্থান ছিলো বেশ উঁচুতে। প্রথম ও দ্বিতীয় পুরষ্কার জাপানই পায়, তৃতীয় স্থান অর্জন করে ব্রাজিল ও চতুর্থ বাংলাদেশ।
প্রতিযোগিতার যত নিয়ম
আন্তর্জাতিকভাবে পাওয়ারলিফটিং প্রতিযোগিতায় বয়স অনুযায়ী সাতটি ক্যাটাগরি রয়েছে। এগুলো হলো- সাব জুনিয়র, জুনিয়র, ওপেন, মাস্টার্স-১, মাস্টার্স-২, মাস্টার্স-৩, মাস্টার্স-৪। সাব-জুনিয়র ক্যাটাগরিতে খেলতে হলে বয়স ১৮ এর নিচে হতে হবে। জুনিয়র ক্যাটাগরিতে বয়স ১৯-২৩। একইভাবে ওপেন ক্যাটাগরিতেও বয়স থাকতে হবে ২৪ থেকে ৩৯ এর মধ্যে। পরবর্তী ধাপগুলোতে অর্থাৎ মাস্টার্স-১ এ বয়স ৪০-৪৯, মাস্টার্স-২ এ বয়স ৫০-৫৯, মাস্টার্স-৩ এ বয়স ৬০-৬৯ এবং সবশেষে ৭০ বছর কিংবা তদুর্ধ্ব যাদের বয়স তারাই মাস্টার্স-৪ এ অংশ নিতে পারে।
বয়সের ভাগ সম্পন্ন করার পর আসে পাওয়ারলিফটিং প্রতিযোগিতার লিফট। পাওয়ারলিফটিংয়ের মূলত তিনটি লিফট থাকে। এগুলো হলো- স্কোয়াট, বেঞ্চপ্রেস ও ডেডলিফট। ইন্টারন্যাশনাল পাওয়ারলিফটিং ফেডারেশন কর্তৃক আয়োজিত প্রতিযোগিতায় প্রত্যেক ধাপে তিনবার করে অংশ নেওয়ার সুযোগ থাকে। অর্থাৎ স্কোয়াট, বেঞ্চপ্রেস ও ডেডলিফটে তিনবার করে অংশ নেওয়ার সুযোগ আছে। তিনবারে যিনি যতো স্কোর করবেন, তাই ফাইনাল স্কোর হিসেবে নির্ধারিত হবে।
প্রতিযোগিতার নিয়মানুযায়ী প্রথমবারে হালকা ওজনের, দ্বিতীয়বারে তার থেকে একটু ভারী ওজনের ও তৃতীয়বারে সবচেয়ে ভারী ওজনের ভার নিতে হয়। প্রতিযোগিতার নিয়মও এক্ষেত্রে বেশ কড়া। যে লিফটগুলো সফলভাবে শেষ করা হবে সেগুলোই মূলত গণনার আওতায় রাখা হয়।
সাধারণত ধরা হয়, যার যতো ওজন সে ততবেশি ওজনের ভার বহন করতে পারে। কিন্তু এই প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে আইপিএফ ক্যালকুলেটর অনুসরণ করা হয়। এই ক্যালকুলেটর অনুসারে যিনি যতো কেজি ওজন নিতে পারবেন সেটির যোগফল তার টোটাল হিসেবে যুক্ত হবে। এরপরে দেখা হয় ব্যক্তি হিসেবে কার কত ওজন। মোট গ্রহণকৃত ভার ও ওজনের সংখ্যা ক্যালকুলেটরে বসানোর পর একটা পয়েন্ট আসে; ওজনের অনুপাতেই মূলত এই পয়েন্ট আসে।
ওয়েটলিফটিং ও পাওয়ারলিফটিং দুটো খেলাতেই প্লেটের সাথে বার যুক্ত থাকে এবং সেটিকে তুলতে হয়। তবে মূল পার্থক্য হচ্ছে ওয়েটলিফটিংএ একবারেই সর্বাধিক ওজন তুলতে হয় এবং পাওয়ারলিফটিংয়ে তিনটি ধাপে ওজন তুলতে হয়।
বাংলাদেশে পাওয়ারলিফটিং এর বর্তমান অবস্থা
দস্তুর অনুযায়ী বাংলাদেশে পাওয়ারলিফটিং চর্চার জায়গা এখনো আন্তর্জাতিক মানের করা সম্ভব হয়নি। এখনো জিমকেই চর্চার জায়গা হিসেবে ধরা হয়। এই খেলার জন্য যেসব প্লেটস, বার বা অন্যান্য সরঞ্জাম ব্যবহার করা হয় সেগুলোর মূল্য অনেক বেশি থাকার কারণে বিশ্বমানের সামগ্রী সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। রাইয়ানের মতে, বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক মানের কোনো সরঞ্জাম নেই, যার জন্য দেশীয় পর্যায়ে অনেক উপরে উঠলেও বিশ্বের কাছে তারা কিছুই না।
এক্ষেত্রে রাইয়ান উদাহরণ টানেন জাপানের। জাপানের পাওয়ারলিফটিংয়ে ভালো করার কারণ তাদের সাংস্কৃতিক চর্চা। জাতিগতভাবে তারা শক্তিশালী ও সাংস্কৃতিকভাবে পাওয়ারলিফটিংয়ের চর্চা তাদের সফলতার প্রান্তে নিয়ে গিয়েছে।
'বাংলাদেশে অন্যতম একটা সমস্যা হচ্ছে প্রতিযোগীদের মধ্যে পারষ্পরিক কোনো সম্মান প্রদর্শন করার বিষয় থাকে না। কিন্তু আইপিএফের প্রতিযোগিতায় তা দেখা যায়নি। সবাই সবাইকে শেখাচ্ছে, সমর্থন করছে। যেটা বাংলাদেশে থাকে না', বলছিলেন রাইয়ান।
রাইয়ানের কোচ তাহসিন আলী বলেন, 'বাংলাদেশের চেয়ে অন্যান্য দেশ পাওয়ারলিফটিংয়ে অনেক বেশি আগানো। ওদের ওখানে সরকারের সমর্থন আছে, বাংলাদেশে যেটা আমরা পাচ্ছি না। যার জন্য আমাদের অগ্রগতিও অনেক অনেক ধীরে হচ্ছে। আমরা প্রথমবার আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় গিয়েছি, তাই এখন থেকে সরকারের কাছে আপিল করা শুরু করবো। আমরা যেহেতু বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করছি, তাই আমাদের সরকারের সমর্থন প্রয়োজন।'
বাংলাদেশ পাওয়ারলিফটিং এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মোমিন এইচ রন জানান, 'শুরু হওয়ার পাঁচ বছরের মধ্যে যে আমরা ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপের মতো জায়গায় যেতে পারবো এটাই আমাদের কাছে সবচেয়ে বড় ব্যাপার। আর রাইয়ানকে দেখে উদ্বুদ্ধ হয়ে ১৪ থেকে ১৮ বছরের সাবজুনিয়র ক্যাটাগরিতে ১৭জন প্লেয়ার এসেছে।'
নিয়ম অনুযায়ী তিন থেকে চার বছর খেলা পরিচালনা করার পরে সরকারের কাছে ফেডারেশন হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আবেদন করতে হয়। ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের কাছে এই মর্মে আবেদন করা হয়েছে। তাই বর্তমানে তারা সরকারের অনুমোদনের অপেক্ষায় আছেন। এই মুহূর্তে তাদের স্পন্সর ও ব্যক্তিগত ফান্ডিং এর উপর নির্ভর করেই কাজ পরিচালনা করতে হচ্ছে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
পাওয়ারলিফটিং নিয়ে রাইয়ানের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা অনেক। রাইয়ান নিজেকে ওপেন পর্যায়ে খেলার অবস্থানে দেখতে চান। তবে এক্ষেত্রেও তাকে অপেক্ষা করতে হবে আরো চার বছর। মধ্যবর্তী এই বছরগুলোর মধ্যে রাইয়ান নিজেকে আরো ভালোভাবে তৈরি করতে চান। এছাড়াও ভবিষ্যতে অত্যাধুনিক সরঞ্জাম সমেত পাওয়ারলিফটিংকে কেন্দ্র করে জিম খুলতে চান তিনি।
এছাড়াও এ বছরের ডিসেম্বরে এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশীপে অংশ নিতে দুবাই যাবেন তিনি। এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে অবশ্য রাইয়ান একা যাচ্ছেন না, ১০-১২ একত্রিত হয়ে দল হিসেবে যাচ্ছেন সেখানে। এই প্রতিযোগিতায় এশিয়ার ভিতরে থাকা বাঘা বাঘা দলগুলো অংশ নেবে।
একইভাবে রাইয়ানের কোচ তাহসিন আলীও এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশীপের কথা বলেন। তিনি জানান, 'এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে আমিও খেলবো, রাইয়ানও খেলবে। সেখানে আমরা একসাথে দুবাইতে যাচ্ছি।'
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে মোমিন এইচ রন জানান, 'আমাদের প্রথম টার্গেট পাওয়ারলিফটিংকে বাংলাদেশে ছড়িয়ে দেওয়া। লোকাল পর্যায়ের খেলোয়াড়দের সামনে নিয়ে আসার জন্য ২০২৩ সালে চট্টগ্রাম ও সিলেটে খেলা আয়োজন করার পরিকল্পনা আমাদের আছে।'
রাইয়ানকে নিয়ে গর্বিত রাইয়ানের বাবা-মাও। ছেলের সাফল্যের কথা বলতে গিয়ে গর্বের সাথে রাইয়ানের মা তারানা রহমান জানান, 'একবার আমরা রাইয়ানকে নিয়ে সিলেটের গ্র্যান্ড সুলতানে বেড়াতে গিয়েছিলাম। আমরা সবাই ঘুরতে বের হলেও রাইয়ান সেদিন যায়নি। পরে দেখি সেখানকার জিমে গিয়ে রাইয়ান পাওয়ারলিফটিং এর স্কোয়াট, ডেডলিফট প্র্যাক্টিস করছে। পাওয়ারলিফটিং প্রতি তার যে একটা আকর্ষণ রয়েছে সেদিনই বুঝতে পেরেছিলাম।'
নতুন কেউ পাওয়ারলিফটিং এ আসতে চাইলে তার প্রতি কী কী উপদেশ থাকবে জানতে চাইলে রাইয়ান জানান, ধৈর্য ধরে ধীরে ধীরে আগানোর কথা। রাইয়ানের মতে, অনেকের মধ্যেই সবচেয়ে ভারী বার সবার আগে উঠিয়ে ফেলার প্রবণতা থাকে। যার কারণে শক্তি প্রথমেই অনেকখানি শেষ হয়ে যায়। এজন্য শরীরকে বিশ্রাম দিয়ে ধীরে ধীরে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়াটাই পাওয়ারলিফটিংয়ে সফলতা পাওয়ার মূল সূত্র।