খাল ভরাট করেছে জিপিএইচসহ তিন শিল্প প্রতিষ্ঠান, পানিবন্দি ৪০০ পরিবার
স্কুল ছাত্রী সাজিয়া পারভিন (১৪)। উঠানের কোমরপানি মাড়িয়ে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছিলো সে। এতে তার পরিধেয় স্কুলের জামাটি পুরোপুরি ভিজে যায়। সকালেও একটি জামা ভিজিয়ে স্কুলে গিয়েছেন স্থানীয় লতিফা সিদ্দিকী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের এই শিক্ষার্থী।
সাজিয়া টিবিএসকে বলেন, 'উঠানে এক কোমর পানি। প্রায় তিনমাস ধরে জমে থাকা এই নোংরা পানি দিয়ে হেঁটে স্কুলে যেতে হয়। সকালে পুরনো কোন জামা পরে ঘর থেকে বের হই, ব্যাগে থাকে স্কুলে পোশাক। গ্রাম থেকে আধ কিলোমিটার দুরে এক আত্মীয় বাড়িতে গিয়ে ভেজা জামা পাল্টিয়ে স্কুলে যাই। ফেরার সময় আবারও জামা ভিজিয়ে বাড়ি ফিরি।'
শুধু সাজিয়া নয়, গত তিনমাস ধরে সীতাকুণ্ড উপজেলার দুটি গ্রামের ৪০০ পরিবারের প্রায় আড়াই হাজার মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় মানবেতর জীবন যাপন করছেন। গ্রাম দুটি হলো কুমিরা ইউনিয়নের নোয়াপাড়া ও বাঁশবাড়িয়া ইউনিয়নের হাজীপাড়া।
শিল্প প্রতিষ্ঠান জিপিএইচ ইস্পাত, পোর্টল্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল-বিডি গ্রুপ ও কেআর ফ্লেক্সিবল লিমিটেড পানি নিস্কাশনের প্রাকৃতিক পথ দখল করে নেওয়ায় গ্রামবাসীরা এই দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন।
স্থানীয়রা জানান, বর্ষা মৌসূমে সীতাকুণ্ড পাহাড় থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল গ্রামের ছড়া দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পতিত হতো। কিন্তু ২০১৮ সালে জিপিএইচ ইস্পাত তাদের কারখানা সম্প্রসারণের সময় পানি নিস্কাশনের জায়গাটি ভরাট করে ফেলে। ফলে পাহাড় থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টির পানি সাগরে নেমে যেতে পারছেনা।
গ্রামবাসীর আবেদনের প্রেক্ষিতে সীতাকুণ্ড উপজেলা ভূমি অফিসের তদন্তেও এই তিনটি শিল্প প্রতিষ্ঠান কর্তৃক খাল ভরাটের বিষয়টি উঠে এসেছে।
রিপোর্টে বলা হয়, তিনটি প্রতিষ্ঠান মিলে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পার্শ্ববর্তী উপজেলার মৌহাজিদ্দা মৌজার মোট ৪৬ দশমিক ৩৬ শতক পানি চলাচলের প্রাকৃতিক পথ করেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ২৪ দশমিক ৬৪ শতক জায়গা ভরাট করেছে জিপিএইচ ইস্পাত। এছাড়া একই মৌজার শিল্প গ্রুপ পোর্টল্যান্ড ইন্টার ন্যাশনাল বিডি ১০ শতক ও কেআর গ্রুপ ১১ দশমিক ৭২ শতক পানি নিস্কাশনের প্রাকৃতিক পথ ভরাট করেছে।
মঙ্গলবার বাঁশবাড়িয়া ইউনিয়নের হাজীপাড়া এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, গ্রামের অধিকাংশ বাড়ির উঠান-ই হাঁটু থেকে কোমর পানিতে ডুবে আছে। পানি ডিঙিয়ে বিদ্যালয় থেকে বাড়ি ফিরছে স্কুল শিক্ষার্থীরা। মসজিদ-মন্দিরে যাতায়াতে মুসল্লিরা দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। উঠান গুলো পানিতে ডুবে থাকায় বাড়িবন্দি হয়ে আছে শিশু-কিশোররা।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পার্শ্ববর্তী মগপুকুর এলাকায় পানি নিস্কাশনের জায়গাটি দখল করে মাটি ভরাট করেছে পোর্টল্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড। সেখান থেকে দক্ষিণে জিপিএইচ ইস্পাত কারখানার মূল ফটকের ১৫ প্রস্থের পানি নিস্কাশনের খালটি চারফুটের নালায় পরিণত করেছে।
তারও কিছু দুরে জিপিএইচ ইস্পাত এডমিনিস্ট্রিটিভ ভবনের সামনেও খাল দখল করা হয়েছে। এতে পানি চলাচলের রাস্তাটি সঙ্কুচিত হয়ে কারখানা সংলগ্ন হাজীপাড়া ও নোয়াপাড়া এলাকা জুড়ে তৈরী হয়েছে জলাবদ্ধতা।
জিপিএইচ কারখানা সংলগ্ন হাজীপাড়া গ্রামের গৃহবধু বিলকিস আক্তার টিবিএসকে বলেন, 'বড় ছেলেটা গত একমাস ধরে স্কুলে যেতে পারছেনা। ছোট ছেলেটিকে নিয়ে সমসময় আতঙ্কে থাকি, কখন পানিতে পড়ে যায়। পানির কারণে তারা খেলাধুলাও করতে পারে না। এছাড়া প্রায়সময়ই ঠান্ডাজনিত নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা।'
বৃদ্ধা নুরজাহান আক্তার বলেন, '৪০ বছর সংসার জীবনে কখনো এই এলাকায় পানি উঠতে দেখিনি। এখন হয়তো আমাদের এই বাড়ি ভিটা বিক্রি করে অন্য কোথাও যেতে হবে।'
এদিকে পানি চলাচলের পথ বন্ধ করে জলাবদ্ধতা সমস্যা তৈরির অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনটি প্রতিষ্ঠানই একে অপরকে দুষছে। বিবাদমান জমির উত্তর পাশে পোর্টল্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড, মাঝখানে কে.আর গ্রুপ ও দক্ষিণে জিপিএইচ ইস্পাত কারখানার অবস্থান।
জানতে চাইলে জিপিএইচ ইস্পাতের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলমাস শিমুল বলেন, 'কারখানার পাশের গ্রামের বাসিন্দারা আমাদের প্রতিবেশি। তারা জলাবদ্ধতার কারণে কষ্টে আছেন, তবে এটি আমাদের কারণে হচ্ছেনা। মূলত পোর্টল্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল পানি চলাচলের প্রবেশ পথটি ভরাট করেছে। এছাড়া ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কের নিচ দিয়ে একটি পানি চলাচলের রাস্তাটি ছিল, যেটি এখন বন্ধ আছে। এসব কারণে গ্রামের পানি নেমে যেতে পারছেনা। এ নিয়ে আমরাও জনপ্রতিনিধিদের সাথে আলাপ করেছি, উপজেলা প্রশাসনকে চিঠি দিয়েছি। আমরা চাইছি সমস্যাটার সমাধান হোক।'
পোর্টল্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল এর উপ-পরিচালক হাদিদুর রহমানের দাবি, 'আমার জায়গা ভরাট করলেও পানি চলাচলের জন্য নিচে আমি ৬০ ইঞ্চি করে দুটি পাইপ বসিয়ে দিয়েছি। কিন্তু আমাদের দক্ষিণ পাশের জায়গাটি ভরাট হয়ে যাওয়ায় পানি যাচ্ছে না।'
কেআর গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সেকান্দার হোসাইনও বলেন , 'দক্ষিণ পাশের জায়গাটি ভরাট হয়ে উঁচু হওয়ায় উত্তর দিক থেকে পানি দক্ষিণ দিকে যাচ্ছে না। ফলে গ্রাম পানিতে ডুবেছে। যদি জনগণের দুর্ভোগ লাঘবে যদি কোন সিদ্ধান্ত হয় তা আমি মেনে নেব।'
স্থানীয় বাসিন্দা হাকীম আবু বক্কর চৌধুরী অভিযোগ করেন, 'বাড়িঘর, মসজিদ, কবরস্থান, বিদ্যালয় ও রাস্তাঘাট থেকে জমে থাকা বৃষ্টির পানি নামছেনা। বেশ কয়েকবার জনপ্রতিনিধি ও উপজেলা প্রশাসনকে গ্রামবাসীর দুর্ভোগের কথা জানালেও, সে কথা কানে তুলেনি কেউ।'
পরিবেশ অধিদপ্তর, চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. ফেরদৌস আনোয়ার টিবিএসকে বলেন, 'ঘটনাটি তদন্ত করে রিপোর্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেওয়া হয়েছে। আশা করছি খুব তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'
সীতাকুণ্ড উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) আশরাফুল আলম বলেন, 'আমরা গ্রামবাসীর অভিযোগ পেয়েছি। সরেজমিনে গিয়ে অভিযোগের সত্যতাও পেয়েছি। তবে সড়কের পাশের ওই জায়গা শুধু যে ওই তিনটি প্রতিষ্ঠান দখল করেছে তা নয়; স্থানীয়রাও পানি নিস্কাশনের ওই জমি দখল করে আছে।'
'ইতোমধ্যে আমরা উভয় পক্ষের সাথে আলাপ করেছি, সকলেই সমস্যার সমাধানে রাজি আছে,' যোগ করেন তিনি।