সৈকতে স্থায়ী সমাধান ‘ডেইল’ পুনরুদ্ধার করুন
কক্সবাজার-টেকনাফে অধিকাংশ জায়গায় সৈকতের বারোটা বেজে গেছে। স্থানীয় জাতের লতাপাতা-ঝোপঝাড়-গাছগাছালি বিলুপ্তপ্রায়, সৈকতের প্রাণবৈচিত্র্য নিঃশেষের পথে, সামুদ্রিক ও উপকূলীয় পাখপাখালিও আর নেই তেমন, এবং সৈকতের প্রাকৃতিক রক্ষাকবচ ডেইল (dune) প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত। ভাঙন বাড়তে বাড়তে এখন নানা জায়গায় বালুময় সৈকত বলে আর কিছু নেই, শুধু জোয়ার-ভাটার মাঝখানের কাদামাটি অবশিষ্ট।
এই দুরবস্থার পেছনে কর্তৃপক্ষসৃষ্ট কারণ দুটো। প্রথমত, ডেইলে এবং সৈকতে আগ্রাসী ও ক্ষতিকর প্রজাতির অস্ট্রেলিয়ান পাইনের (ঝাউ গাছ) বাগান করা। দ্বিতীয়ত, জিও-টিউব এবং কংক্রিটের টেট্রাপড পরিকল্পনাহীনভাবে নির্বিচারে বসানো।
সৈকতে ভাঙন বেশি ঘটছে ওইসব জায়গায়, যেখানে সৈকত বালু-বঞ্চিত হয়েছে; দালানবাড়ি, পাকা রাস্তা (যেমন মেরিন ড্রাইভ) বা অন্যান্য স্থাপনা রক্ষা হবে চিন্তা করে যেখানে কংক্রিটের দেয়াল কিংবা ব্লক বসানো হয়েছে বা টেট্রাপড বা জিও-টিউব বসানো হয়েছে।
মজবুতভাবে পাকা করলে অবশ্য উপকূলীয় জমি ও এইসব স্থাপনা অন্তত কিছুকালের জন্য ভাঙন থেকে রেহাই পায়, পাচ্ছে। কিন্তু এতে করে ভাঙনের চাপ পুরোটা পড়ছে সৈকতের ওপর। যার ফলাফল: সাগর আর পাকার মাঝখানে বালুময় সৈকত বলে আর কিছু থাকছে না শেষ পর্যন্ত।
সৈকতের এইরকম পাকাকরণ করা ছাড়াই এখানে বহুকাল ধরে সৈকতের ভাঙা ও গড়ার প্রাকৃতিক ভারসাম্য ছিল। কারণ সৈকতের স্বাস্থ্য ভালো ছিল; উপকূলীয় জমি আর সৈকতের মাঝখানে ছিল উঁচু উঁচু ডেইল। এমনকি সাম্প্রতিক বছরে পানির বাড়তি জোয়ার ও ঘন ঘন ঝড়ো হাওয়ার পরেও ডেইলসমৃদ্ধ এলাকাগুলোতে কিছুই ভাঙছে না; না সৈকত, না উপকূলীয় জমি।
যদি প্রচুর বালু থাকে সৈকতে, তবেই সৈকতের স্বাস্থ্য ভালো থাকে। সৈকতে প্রাকৃতিকভাবে বালু সরবরাহে যদি বাধা দেয়া হয়, তবে সৈকত ভাঙবেই। সৈকতে বালুর আসা-যাওয়ার যে প্রাকৃতিক-প্রক্রিয়া আছে, তাকে বাধা না দিয়ে দক্ষভাবে ব্যবস্থাপনা করলে এই সৈকতে কখনো বালুর অভাব হবার, ভাঙন হবার কথা না।
খবরে প্রকাশ, সম্প্রতি বন বিভাগ স্বীকার করেছে যে, ডেইলে ও সৈকতে আগ্রাসী ও ক্ষতিকর বিদেশি প্রজাতির গাছের বাগান (অস্ট্রেলিয়ান পাইন বা ঝাউগাছ) করা খুব ভুল কাজ হয়েছে, এর কারণে ভাঙন বেড়েছে।
সৈকতে বালু আসে দুটো উৎস থেকে—স্থ লভাগ ও সাগর। সাগরের স্রোতে বালু এসে উপকূলে জমা হয়ে সৈকত তৈরি হয়, সৈকত চওড়া ও উঁচু হয়। এবং সাগর-সৈকতের অন্যপাশে উপকূলীয় জমির দিকে তৈরি হয় বালুর ঢিবি–ডেইল, যেখান থেকে আবার বাতাস ও ঢেউয়ের তোড়ে বালু সরবরাহ হয় সৈকতজুড়ে।
যখন ঝড়ো আবহাওয়া হয়, তখন উঁচু ও শক্তিশালী ঢেউয়ের প্রভাবে সৈকতে নানা অদলবদল হয়, সৈকতের আকার-আকৃতির বদল হয়। সৈকত ও ডেইলের বালু সামাল দেয় প্রবল ঢেউয়ের শক্তি; বালু টেনে সাগরের দিকে নিয়ে যায় ঢেউ—জমা করে উপকূলীয় অগভীর সাগরতলে। এতে করে সৈকত দুদিকে সমতল হয়ে যায় এবং সমুদ্রতলের উচ্চতা বাড়ে। বালুর ডুবোচরে আটকে যায় ঢেউ, এবং সৈকতের থেকে অনেক দূরেই বাধাপ্রাপ্ত হয় ঢেউয়ের তোড়জোড়, ফলে ভাঙার ক্ষমতা কমে যায়।
এরপর মৌসুমের পালাবদলে ঢেউয়ের শক্তিতে পরিবর্তন আসে। ঝোড়ো হাওয়ার বর্ষাকাল যখন চলে যায়, তখন ছোটো ছোটো ঢেউয়েরা সৈকতের দিকে নিয়ে আসতে থাকে বালু। জোয়ার-ভাটার মাঝখানে সেই তীরে আসা বালু বয়ে সৈকতের ওপরে—ডেইলের দিকে নিয়ে আসে বাতাস। কিন্তু সেই বালু আটকে জমা করে উঁচু উঁচু ডেইলে পরিণত হবে তখনই, যখন ডেইলে ও উপকূলীয় জমিতে থাকবে স্থানীয় জাতের লতাপাতা-ঝোপঝাড়-গাছগাছালি। এবং যখন সৈকত ও ডেইলে অন্য কোনো পাকা বা আধাপাকা বাধা (যেমন, কংক্রিটের ঢালাই বা জিও-টিউব) থাকবে না।
খবরে প্রকাশ, সম্প্রতি বন বিভাগ স্বীকার করেছে যে, ডেইলে ও সৈকতে আগ্রাসী ও ক্ষতিকর বিদেশি প্রজাতির গাছের বাগান (অস্ট্রেলিয়ান পাইন বা ঝাউগাছ) করা খুব ভুল কাজ হয়েছে, এর কারণে ভাঙন বেড়েছে।
অস্ট্রেলিয়ান পাইন গাছ খুবই আগ্রাসী ভূমিকা রাখে আমাদের এই অঞ্চলে। ঝাউ গাছেরা এত দ্রুত বাড়ে যে দেশি উদ্ভিদেরা পাল্লা দিয়ে পারে না। দ্রুত বর্ধনশীল ও দীর্ঘ ছায়ার ঝাউ গাছের পাতার জৈব-রাসায়নিক প্রভাবও স্থানীয় প্রতিবেশের জন্য ক্ষতিকর। সবমিলিয়ে ফলাফল হলো, ঝাউ বাগানের নিচে বা আশপাশে দেশি জাতের গাছগাছালি হয় না।
জাতিসংঘ কৃষি ও খাদ্য সংস্থা থেকে শুরু করে নানা নির্ভরযোগ্য সংস্থার গবেষণায় এই বিষয়ে বিস্তারিত বলা আছে। আপনি যদি ঝাউ-উপদ্রুত এলাকায় যান, তবে নিজের চোখেই দেখতে পাবেন।
বালুভূমিতেও যদি ঝাউগাছ লাগানো হয়, তবে কয়েক বছরের মধ্যে সব বালু ক্ষয় হয়ে যায়, বালুভূমি পরিণত হয় পুষ্টিহীন ও বিরান মাটিতে। ঝাউ গাছের শিকড় খুব বেশি গভীরে যায় না মাটির, ফলে ঝাউ-উপদ্রুত বিরানভূমির পুষ্টিহীন জমি খুব সামান্য বাতাস ও ঢেউয়ে ক্ষয় হয়, ভেঙে যায়।
ঝাউয়ের কারণে ডেইল ধ্বংস হবার পরে যখন সৈকতে ভাঙন বেড়েছে, তখন আবার পানি উন্নয়ন বোর্ড ওইসব জায়গায় ভাঙন ঠেকানোর চিন্তা করে জিও-টিউব বসিয়েছে। এবং তাতে ভাঙন আরো বেড়েছে। এর দুটো কারণ। প্রথমত, টিউবে ভরার জন্য বালু তোলা হয় সৈকত থেকে, তাতে জোয়ার ও ঢেউয়ের বিপরীতে আরো অরক্ষিত হয়ে পড়ে সৈকত। দ্বিতীয়ত, সৈকতের শেষপ্রান্তে বা ক্ষয়ে যাওয়া ডেইলের ওপর জিও-টিউব বসানোর কারণে শুকনা মৌসুমে ওইখানে আর ডেইলে প্রাকৃতিকভাবে বালু জমা হতে পারে না, গাছগাছালি-ঝোপঝাড়-লতাপাতাও হয় না।
শুকনো মৌসুমে জিও-টিউব উপদ্রুত এলাকায় সৈকতের বৃদ্ধি—অর্থাৎ ডেইল তৈরি হবার প্রক্রিয়া ব্যাহত হওয়ার কারণে সৈকত অরক্ষিতই থেকে যায়। এবং পরের বর্ষা মৌসুমে ওই অরক্ষিত সৈকত অসহায়ভাবে ঢেউয়ের তোড়ে পড়ে। এবং ঝাউ ও জিও-টিউবের এই দুষ্টচক্রের কারণে চক্রবৃদ্ধি হারে ভাঙছে সৈকত প্রতি বছর। বর্তমান দুরবস্থা থেকে উত্তরণ চাইলে আরো বেশি পাকাকরণের দিকে না গিয়ে (যেমন, কংক্রিটের বাঁধ) বরং এই অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী স্থায়ী সমাধান ডেইলের দিকে মনোযোগ দিতে হবে।
যদি জিজ্ঞেস করেন, কক্সবাজার-টেকনাফ উপকূলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো উন্নয়নের খাত কী? এর জবাব হচ্ছে 'ডেইল' (dune), ডেইল পুনরুদ্ধার ও স্থায়ী ব্যবস্থাপনা হচ্ছে এই উপকূলে সবচেয়ে জরুরি অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ।
কক্সবাজার-টেকনাফ উপকূলে গতিশীল-স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে ডেইল। এখানে ডেইলগুলো বিচিত্র রকমের প্রাণী ও উদ্ভিদের আবাসস্থল হিসাবে ভূমিকা রাখে এবং বালুর প্রাকৃতিক গুদামঘর হিসাবে থাকে—ভেঙে যাওয়া বা ক্ষতিগ্রস্ত সৈকতে বালুর জোগান দিয়ে সুস্থ করে তোলে। ভরা জোয়ার, বিশাল ও শক্তিশালী ঢেউ, ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের কবল থেকে প্রাকৃতিক সুরক্ষা হিসাবেও অবদান রাখে এইসব ডেইল। এভাবে ডেইলগুলো উপকূলীয় ঝড়-বন্যা-ভাঙনের প্রভাব প্রশমিত করে এবং জানমালের ক্ষয়ক্ষতি কমায়।
বিলুপ্ত এবং ক্ষতিগ্রস্ত ডেইল পুনরুদ্ধার ও পুনর্বাসন করা এখন খুবই জরুরি। সেই লক্ষ্যে বনবিভাগকে অবশ্যই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অবলম্বন করে অস্ট্রেলিয়ান পাইনের (ঝাউ) উপদ্রব ঠেকাতে হবে। ঝাউয়ের নতুন বাগান উপড়ে ফেলে সেখানে স্থানীয় জাতের উদ্ভিদ ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে হবে। পর্যায়ক্রমে ঝাউয়ের পুরোনো বাগানগুলোতেও একই কাজ করতে হবে। এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডকে অবশ্যই কংক্রিটের বাঁধ ও জিও-টিউবের বিকল্প হিসেবে ডেইল পুনরুদ্ধার ও ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ নিতে হবে।
স্থানীয় লোকসমাজ, জেলে সমিতি, কৃষক সমিতি, পর্যটন ব্যবসায়ীসহ নানা সমিতি ও সংস্থাকে ঐক্যবদ্ধ করে স্থানীয় জাতের গাছপালা-ঝোপঝাড়-লতাপাতা ফিরিয়ে আনার মাধ্যমে কক্সবাজার উপকূলে ডেইল ফিরায়ে আনা সম্ভব।
- মোহাম্মদ আরজু: 'ইনডিজেনাস এন্ড লোকাল কমুনিটি কনসার্ভড এরিয়া কনসোর্টিয়াম' শীর্ষক আর্ন্তজাতিক সংস্থার যোগাযোগ সমন্বয়ক
এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।