ঢাকার বাইরেও ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ছে
গত দুই বছরের তুলনায় এ বছর ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু রোগীর হার বেশি। ঢাকার বাইরে ডেঙ্গুতে মৃত্যুও বাড়ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা সেবা নিতে সারাদেশের হাসপাতালগুলোকে চিঠি দেওয়া, ডেঙ্গু শনাক্তে টেস্টিং কিট সরবরাহ করা, ডাক্তারদের রোগী ম্যানেজমেন্টের ট্রেনিং দিলেও ডেঙ্গু পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে মশা মারতে উদ্যোগ নেয়ার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কর্মী আব্দুর রহমান (৪১) গত ৯ সেপ্টেম্বর (শনিবার) ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হন। জ্বর না কমায় পরদিন পাবনার ইশ্বরদীর স্থানীয় চিকিৎসক তাকে একটি ইনজেকশন দেয়। অবস্থার উন্নতি না হলে সোমবার তাকে পাবনা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেদিন তার প্লাটিলেটের মাত্র ছিল ৫৫ হাজার, পরদিন প্লাটিলেট লেবেল ২৮ হাজারে নেমে আসে।
পাবনা জেনারেল হাসপাতালে প্লাটিলেট দেয়ার ব্যবস্থা না থাকায় এবং রোগীর অবস্থার অবনতি হলে মঙ্গলবার রাত তিনটার সময় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসে রোগীর স্বজনেরা। তখন তার শরীরে প্লাটিলেটের মাত্রা ছিল ৬ হাজার। ঢাকা মেডিকেলে দুই দফা প্লাটিলেট দেওয়ার পর সোমবার সুস্থ হয়ে বাসায় ফেরেন আব্দুর রহমান।
আব্দুর রহমানের মতো তার অনেক সহকর্মীও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ইশ্বরদী ও পাবনা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি আছে। পাবনা জেনারেল হাসপাতালের ডেঙ্গু সেলে ভর্তি রোগীদের অধিকাংশই রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কর্মী বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা। তবে সেখানে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু নিয়ে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিদেশি কোনো কর্মী ভর্তি হয়নি।
শুধু পাবনা নয়, ঢাকার বাইরের অন্যান্য জেলাগুলোতেও ডেঙ্গু রোগী বাড়ছে। এ বছর এখন পর্যন্ত ২০% ডেঙ্গু রোগী ঢাকার বাইরের, যা গত দুই বছরের তুলনায় বেশি। এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মৃত ৪৫ রোগীর মধ্যে ২৪ জনই ঢাকার বাইরের রোগী।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০১৬ সালে দেশে ডেঙ্গু রোগীর ৯৯ শতাংশই ছিল ঢাকায় এবং মাত্র ১ শতাংশ ছিল ঢাকার বাইরে। ২০১৭ সালে ঢাকায় রোগী ছিল ৯৬ শতাংশ ও ঢাকার বাইরে ৪ শতাংশ। পরের বছর ২০১৮ সালে শতভাগ রোগীই ছিল ঢাকায়। ২০১৯ সালে দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়, সে বছর ঢাকায় রোগী ছিল ৫১ শতাংশ ও ঢাকার বাইরে ৪৯ শতাংশ। এরপর থেকেই ঢাকার বাইরে রোগী বাড়তে থাকে। ২০২০ সালে ঢাকার ডেঙ্গু রোগী ছিল ৮৭ শতাংশ ও ঢাকার বাইরে ১৩ শতাংশ এবং ২০২১ সালে ঢাকায় ৮৩ শতাংশ ও ঢাকার বাইরে ১৭ শতাংশ। কিন্তু চলতি বছর এরই মধ্যে ঢাকায় ৮০% ও ঢাকার বাইরে ২০% ডেঙ্গু রোগী।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, 'এ বছর ঢাকার বাইরে অনেক বেশি ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যাচ্ছে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশন, পৌরসভাকে মশা মারতে উদ্যোগ নিতে হবে। বাড়িতে, টবে পানি জমতে দেয়া যাবে না। কেউ যদি ডেঙ্গু আক্রান্ত হয় তাহলে ডাব, স্যালাইন, পানি খেতে হবে। প্যারাসিটামল ছাড়া কোন ধরণের ব্যথানাশক ওষুধ খাওয়া যাবে না। ডেঙ্গুতে অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োজন নেই। জ্বর বেশি হলে হাসপাতালে ভর্তি হওয়াই ভালো, তবে ডেঙ্গুতে অধিকাংশ রোগীর প্লাটিলেট বা ব্লাড দেওয়ার প্রয়োজন হয় না। তাই ডেঙ্গু হলেই আতঙ্কিত হয়ে প্লাটিলেট দিতে হবে না।'
সোমবার পর্যন্ত সারাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ১০,০৪১, যার মধ্যে ২,০৯৬ জন ঢাকার বাইরের।
অন্যদিকে চট্টগ্রাম বিভাগের ১,৫২৯ জন ডেঙ্গু রোগীর মধ্যে ৯৮৭ জনই কক্সবাজারের। এ বছর কক্সবাজারের ১৮ জন ডেঙ্গু রোগী মারা গেছে।
কক্সবাজারের সিভিল সার্জন ডা. মাহবুবুর রহমান বলেন, 'ডেঙ্গুতে মৃতদের অধিকাংশই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। তারা ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে কবিরাজের কাছে চিকিৎসা নিয়েছে। একেবারে ক্রিটিক্যাল অবস্থায় ডাক্তারের কাছে গেছে। তবে এখন রোহিঙ্গাদের মধ্যে ডেঙ্গুর সংক্রমণ কমলেও হোস্ট কমিউনিটির মধ্যে ডেঙ্গু আক্রান্তের হার বাড়ছে। মশা মারতে আমরা স্থানীয় সরকার বিভাগকে ব্যবস্থা নিতে বলেছি।'
এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এবিএম খুরশীদ আলম টিবিএসকে বলেন, 'ঢাকা ও ঢাকার বাইরে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ছে। স্বাস্থ্য সেবা দিতে পারি, আমরা সেটা করছি। কিন্তু প্রতিরোধ জরুরি। সারাদেশে মশার উপদ্রব রয়েছে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্য বিভাগ, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, সিটি করপোরেশন সবাইকে যৌথভাবে কাজ করতে হবে।'