ছাত্র রাজনীতির অপরিহার্যতা কি ফুরিয়ে গেছে?
ভারতীয় উপমহাদেশে আমাদের এই ভূখণ্ড আদিকাল থেকে বিভিন্ন নামে পরিচিত হয়ে সর্বশেষ ১৯৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ নাম ধারণ করেছে। ভূখণ্ডটির নাম বঙ্গ, পূর্ববঙ্গ , পূর্ব বাংলা, পূর্ব পাকিস্তান- পরিশেষে আজকের এই বাংলাদেশ। নামের পরিবর্তনের সঙ্গে এদেশে তরুণ সমাজের গভীর সম্পৃক্ততা ছিল। বঙ্গ যখন ভাগ করে দুই বাংলায় রূপান্তরিত করা হয়, পূর্ব বাংলা ও পশ্চিমবাংলার যুবকরা তখনো বঙ্গভঙ্গ মেনে নিতে পারেননি। বঙ্গভঙ্গের বিপক্ষে আন্দোলন শুরু করেছিল তারা। ১৯০৫ সাল থেকে নিয়ে শুরু করে ১৯১১ সাল পর্যন্ত ছিল সেই বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন। শেষ পর্যন্ত উপনিবেশিক শাসক ব্রিটিশরা সেই দাবি মানতে বাধ্য হয়েছিল। তখন থেকেই এক দুরন্ত স্বাধীনতা সংগ্রামের আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল সর্বভারতীয় আঙ্গিকে।
বাংলায় ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসনের বিপক্ষে সে সময়ও দেখা গেছে তরুণ ছাত্রসমাজ নানান ভাবে আত্মাহুতি দিচ্ছে। আন্দোলন সংগ্রামের নেতৃত্ব দিচ্ছে। এই ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের পরিণতিতে ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা ভারত থেকে বিদায় নেয় এবং দুটি নতুন দেশের জন্ম নেয়। পাকিস্তান ও ভারত।
সেই সময়ও নানা আন্দোলন সংগ্রামে এই তরুণ যুবকদেরকে সামনে দেখা গেছে। সেই নবগঠিত পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে বৈষম্য ও অগনতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে ভাষা আন্দোলন হয়েছে, শিক্ষা আন্দোলন হয়েছে, স্বায়ত্ত শাসনের আন্দোলন হয়েছে- প্রায় সকল ক্ষেত্রেই তরুণ-যুবক ছাত্রসমাজ আন্দোলনের প্রধান সৈনিক ও নেতৃত্ব প্রদান করেছে।
আমাদের ছাত্রজীবনের উল্লেখযোগ্য অংশ ছিল ১৯৬৯ এর গণ আন্দোলন ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম। ১৯৬৯ এর আইয়ুব বিরোধী গণ আন্দোলনের ছাত্রসমাজের ১১ দফা এবং সেই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সারাদেশে ছাত্র সমাজের ভূমিকা ইতিহাসের পাতায় এক অনন্য ইতিহাস হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
সেই সময় ছাত্র সমাজের নেতৃত্ব প্রদান করেছেন মূলত পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন, এছাড়াও আরো বেশ কিছু ছাত্র সংগঠনের অস্তিত্ব তখন ছিল। ছাত্র সমাজের সেই ১১ দফা ছাত্র আন্দোলনে সময় সরকারদলীয় ছাত্র সমর্থক গোষ্ঠী ন্যাশনাল স্টুডেন্ট ফ্রন্ট ও যোগদান করে, যারা এন এস এফ নামে পরিচিত ছিল।
আন্দোলনের প্রথম দিকে তারা সাধারণ ছাত্র কিংবা ছাত্রলীগের উপর আক্রমণ করতো; পরবর্তীকালে তারাও আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রদের রাজনীতি করার অধিকার ছিল এবং প্রায় সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতো। আইয়ুবি শাসন আমলে প্রায় সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচন হতো। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমবার নির্বাচন হয়েছিল ১৯৭২ সালে। সেই নির্বাচনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ডাকসুর সহ সভাপতি (ভিপি) হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন বর্তমান বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। এর পরের বছরই ডাকসু নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশ করার আগেই ব্যালট বক্স ছিনতাই করা হলো। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে সেই ব্যালট বক্স ছিনতাইয়ের অভিযোগ আসলো।
এরপরে ১৯৭৫ সালে ঘটে যাওয়া বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পরে দেশের সামরিক শাসন জারি হল এবং ছাত্র সংসদ সমূহের নির্বাচন স্থগিত হয়ে গেল। ১৯৭৮-৭৯ সাল থেকেই ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবিতে দেশের প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ছাত্ররা আন্দোলন শুরু করল। ঢাকা ,রাজশাহী, চট্টগ্রাম জাহাঙ্গীরনগর সর্বত্রই ছাত্র সংসদের নির্বাচনের দাবি তীব্রভাবে সামনে আসাতে সেই সময়ের শাসক জিয়াউর রহমান ছাত্র সংসদ নির্বাচনের কার্যকর ব্যবস্থা সৃষ্টি করলেন। ফলে ঢাকা রাজশাহী চট্টগ্রামসহ তখনকার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন শুরু হল। কিন্তু এই নির্বাচন কখনোই নিয়মিতভাবে অনুষ্ঠিত হয়নি, কারণ বারবার সামরিক শাসন তাকে ব্যাহত করেছে।
এরশাদের সময়কালেও শেষের দিকে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়েছে দু-একবার। দুই একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। তখন দেশে কোন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না। ছাত্র সংসদ নির্বাচনের সময় প্রায় প্রতিটি ছাত্র সংগঠন নির্বাচনে অংশ নিত। নিজ নিজ কর্মসূচি প্রকাশ করত। মারামারি হানাহানি হলেও তা দীর্ঘস্থায়ী হতো না। তাদের মধ্যে সমঝোতার সৃষ্টি হতো। সহঅবস্থানও লক্ষ্য করা গেছে তাদের মধ্যে।
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে প্রায় সকল ছাত্র সংগঠনের নিজ নিজ কর্মসূচি পালনের পরিস্থিতির পরিসমাপ্তি ঘটলো এরশাদের পতনের পরে। ১৯৯১ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে যে সরকার ক্ষমতায় আসলো তারা আর কখনোই ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দিকে মনোযোগী হলো না।
সেই ১৯৯১ এর সরকারের ক্ষমতায়নের পর থেকে আজ পর্যন্ত যে সরকার ক্ষমতায় এসেছে তারা কখনোই সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের কোন উদ্যোগ গ্রহণ করেনি ।এই ধারা চলতে চলতে ২০০৯ যে সরকার ক্ষমতায় আসলো তাদের ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ সারাদেশে একক কর্তৃত্ববাদিতা সৃষ্টির পথে এগিয়ে চললো। প্রধান প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে বিতারণ করল এবং ক্ষমতাসীনরা বাংলাদেশ ছাত্রলীগের একক কর্তৃতবাদিতা সারাদেশের সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে আজ কোথায় নিয়ে দাঁড় করিয়েছে তা আমরা আজ আতঙ্কের সাথে লক্ষ্য করছি।
দেশের অন্যতম প্রধান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বুয়েটে আবরার হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হলো এই ছাত্রলীগের নেতৃত্বে এবং যাদের একগুচ্ছ তরুণকে এ হত্যাকাণ্ডের দায়ভার ঘাড়ে নিয়ে মৃত্যুদণ্ডের সাজা গ্রহণ করতে হয়েছে।
আমরা যারা ১৯৬৯ এর গণ আন্দোলনের সময় ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছিলাম আমরা সবসময়ই ছাত্রকর্মী হিসেবে নিজেদেরকে ছাত্রদের কাছে গ্রহণযোগ্য হিসেবে তুলে ধরার জন্য একটি মৌলিক নীতিমালা মেনে চলতাম। আজকের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মতন তীব্র আবাসন সমস্যা না থাকলেও হলগুলোতে সিট বণ্টনের ক্ষেত্রে মেধার প্রাধান্য দেওয়া হতো। হলগুলোতে নানান রকমের নৈতিক নীতিমালা মেনে চলা হতো।
গত কয়েক বছর যাবত দেশের গণমাধ্যমে প্রতিনিয়ত ছাত্রলীগের সিট, বাণিজ্য ভর্তি বাণিজ্য ইত্যাদি তথ্য প্রকাশিত হচ্ছিল কিন্তু রাষ্ট্রের দায়িত্বে আছেন যারা তারা কখনোই এ বিষয়ে মনোযোগী হননি। তারা ভেবেছেন এই যুব সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করা গেলেই হয়তো নির্বিঘ্নে ক্ষমতায় থাকা যাবে, সেই লক্ষ্যে প্রায় প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই সকল ছাত্র সংগঠন বিতারিত হয়ে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের একক অস্তিত্বের সৃষ্টি হয়েছে। যে ছাত্রলীগের নেতৃত্ব নির্ধারিত হয় ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে। যেখানে নেতৃত্ব সৃষ্টির জন্য ছাত্রদের কোন ভোটাভুটির প্রয়োজন হয় না এবং প্রায় প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ছাত্র সংগঠনটি নানান বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত তার ইতিহাস গত কয়েক বছর গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত হলেও দু একটি ঘটনায় এদের নেতৃত্ব থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া হলেও এদের কর্মকাণ্ডের সামগ্রিক কোন পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়নি ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল।
ইডেন মহিলা কলেজ দেশের প্রথম মহিলা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বিখ্যাত বহু মানুষ এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে তাদের শিক্ষা জীবন পার করেছেন। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে যে সমস্ত অভিযোগ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘুরে বেড়াচ্ছে তা উচ্চারণ করাও প্রায় অসম্ভব। সিট বাণিজ্য তো চলছেই তার পরেও সেখানে আরও কিছু ঘটনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, যা বিশ্বাস করা আমাদের এই পড়ন্ত জীবনে খুবই কষ্টকর। আজকের দিনে মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ঘটনাটি ঘটেছে তেমন ঘটনার উদাহরণ প্রায় সব কটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের।
মাঝখানে এই দীর্ঘ ১২ বছরের বর্তমান শাসনকালে কেবলমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ নি র্বাচন একবার সংঘটিত হয়েছে, তাও আদালতের নির্দেশে। অন্য কোথাও এই নির্বাচন ব্যবস্থা করা হয়নি। ছাত্র সংসদ নির্বাচন সৃষ্টি করা না গেলে এই তরুণরা যে ব্যাপক দৌরাত্ম্য সারা দেশে সৃষ্টি করেছে তা থেকে পরিত্রাণের কোন সুযোগ নাই। এবং দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে যে রাজনৈতিক দলগুলোর অস্তিত্ব টিকে আছে এবং যারা দেশের শাসন ব্যবস্থা নিয়ে কথা বলেন তাদের মধ্যেও কাউকে দেখি না ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবি তুলতে।
প্রতিবেশী দেশ ভারতের সব কটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচন এখনো অব্যাহত আছে। অক্সফোর্ড, ক্যামব্রিজ পৃথিবীর এই নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও ছাত্র সংসদ কাজ করে। বিশ্বের রাজনীতি অর্থনীতি বিজ্ঞান প্রায় সকল বিষয়েই এই ছাত্র সংসদগুলো তার নিজস্ব ভূমিকা পালন করে। বিশ্বখ্যাত মানুষদেরকে এই ছাত্র সংসদগুলোর ব্যবস্থাপনায় বক্তৃতা করতে দেখা যায় অব্যাহতভাবে। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের দেশের যে ছাত্ররা এদেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিল সেই ছাত্র সমাজের সরকারি দলের ছাত্র সংগঠন এখন দেশের কাছে এক বিতর্কিত জনগোষ্ঠী হিসেবে ভাবমূর্তি গড়ে তুলেছে।
আবরার হত্যাকাণ্ডের পরে বুয়েটের যে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছে তাও কোন সঠিক ব্যবস্থা নয়। বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে ছাত্র রাজনীতি না থাকলে এই তরুণ যুব সমাজ দেশ সম্পর্কে সঠিক ধারণা থেকে বঞ্চিত হয়।