শক্তিশালী ডলার কেন সবার জন্য উদ্বেগের?
বৈশ্বিক মুদ্রাবাজারে অদম্য গতিতে এগোচ্ছে 'সুপারচার্জড' ডলার। চলেছে আরেকটি ঐতিহাসিক মাইলফলক অর্জন– ব্রিটিশ পাউন্ডের সাথে সমতা সৃষ্টির দিকে। অর্থাৎ, চলতি বছরেই ১ ডলারের বিনিময়ে ১ ব্রিটিশ পাউন্ড লেনদেনের ঘটনা প্রথমবারের মতো ঘটতে পারে।
এর আগে ইউরো-ও ডলারের বিপরীতে বিনিময় দর বা মান হারায়। পাউন্ড-ও সেপথেরই যাত্রী। চলতি বছরেই ২০ বছরের মধ্যে প্রথমবার ডলারের সবচেয়ে কাছাকাছি নেমেছে ইউরোর মান।
ইউরোর এই অবমূল্যায়ন হয় ইউরোজোনে জ্বালানি সংকট এবং তার ফলে মন্দা দেখা দেওয়ার আশঙ্কায়। এখানেও 'নাটের গুরু' ইউক্রেন যুদ্ধ।
বিশ্ববাণিজ্যে বেশিরভাগ লেনদেন হয়– এমন প্রধান প্রধান মুদ্রাগুলিও শক্তিশালী ডলারের সামনে ম্রিয়মাণ। চলতি বছরে ডলারের বিপরীতে ২০ শতাংশ মান হারিয়েছে জাপানি ইয়েন। ১৯৯৮ সালের পর যা সর্বনিম্ন।
চলতি বছরের শুরুর দিকেই ভারতীয় রুপির মানে রেকর্ড পতন ঘটে। এসময় প্রথমবারের মতো ৮০ রুপির বেশি হয় প্রতি ডলারের দর। এরপর গত সোমবারও নতুন করে রেকর্ড দরপতন হয়েছে ভারতীয় মুদ্রার। বৈশ্বিক বিনিয়োগকারীরা উদীয়মান বাজারের সম্পদ থেকে ডলারমুখী হওয়ার কারণেই যা হয়েছে।
ডয়চে ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় গবেষণা শাখার প্রধান জর্জ সারাভেলোস গ্রাহকদের উদ্দেশ্যে পরামর্শক নোটে লিখেছেন, '১৯৮০-র দশকের পর সবচেয়ে বড় মূল্যায়ন অর্জন করছে (মার্কিন) ডলার। অস্থিতিশীল এ পরিবেশে ধীরে ধীরে বিশ্বজুড়ে অস্বস্তির আবহ সৃষ্টি হচ্ছে'।
ডলারের মান চড়ছে কেন?
অর্থনৈতিক সংকটকালে নিরাপদ সম্পদ রক্ষায়–ডলারের খ্যাতি রয়েছে নিরাপদ বিনিয়োগ উৎস হিসেবে, আর সেটা এর উত্থানেরও প্রধান শক্তি। পৃথিবী যখন মূল্যস্ফীতির গ্রাসে, জ্বালানি ও খাদ্যের দর যখন ইউরোজোন-সহ প্রায় সব অঞ্চলেই আকাশচুম্বী–তখন দেখা দিচ্ছে মন্দার ভয়। মূল্যস্ফীতির থাবা থেকে জনগোষ্ঠীকে রক্ষায়– সুদহারও বাড়াতে হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলিকে। এতে কমছে বাজারে অর্থপ্রবাহ। ফলে নতুন বিনিয়োগ হওয়া এবং কর্মসংস্থান তৈরিতে শূন্যতা দেখা দেওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। কমতে শুরু করছে ভোগ চাহিদাও।
অর্থনীতির এই আসন্ন সংকোচনের ভয়েই বিনিয়োগকারীরা মার্কিন ডলারে সম্পদের নিরাপদ আশ্রয় খুঁজছেন। তাছাড়া বৈশ্বিক নানান ঝুঁকি থেকেও সবচেয়ে কম প্রভাবিত হওয়ার অবস্থানে রয়েছে সবুজাভ মার্কিন মুদ্রাটি।
দ্বিতীয় প্রধান কারণ– ফেডারেল রিজার্ভের আগ্রাসীভাবে সুদহার বৃদ্ধি। যুক্তরাষ্ট্রে রেকর্ড মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতেই অত্যন্ত দ্রুত গতিতে তারল্য প্রবাহ কমিয়ে আনছে মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংকটি। ফেডের এই নীতির বিপরীতেই অবস্থান জাপানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। ব্যাংক অব জাপান দীর্ঘদিন ধরে অতই-নিম্ন সুদহার ধরে রেখেছে। ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকও দীর্ঘদিন ধরে চড়াভাবে সুদহার বাড়ানোর বিরোধী ছিল।
এতে করে, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ইউরো জোনের সুদহারে একটি বড় পার্থক্য তৈরি হয়েছে। উচ্চ মুনাফার আশায় তাই আটলান্টিকের ওপাড়ে নিজেদের টাকা সরাচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা।
বিনিয়োগ ধরে রাখতেই তাই এখন প্রাণান্তকর চেষ্টা করতে হচ্ছে ইউরোপের সরকারগুলিকে। তাতে অবশ্য খুব একটা লাভ হচ্ছে না। যেমন যুক্তরাজ্য সরকার ৫০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় কর কর্তনের ঘোষণা দেওয়ার পরও হয়েছে পাউন্ডের বিপরীতে ডলারের উত্থান। সরকারের এই সিদ্ধান্তের পর ব্যাংক অব ইংল্যান্ড আরও আগ্রাসীভাবে সুদহার বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ডয়চে ব্যাংকের গবেষক জর্জ সারাভেলোস বলেন, 'আমাদের দৃষ্টিতে এই মুহূর্তে অর্থনীতির নিম্ন প্রবৃদ্ধি যুক্তরাজ্যের তাৎক্ষণিক চ্যালেঞ্জ নয়; বরং বিদেশি অর্থায়নের ওপর নির্ভরশীল অতি-ঋণাত্মক বাহ্যিক হিসাবের ঘাটতি মোকাবিলাই সবচেয়ে বড় শঙ্কার বিষয়। সরকারের ঘোষিত কর ছাড়– স্বল্পমেয়াদে প্রবৃদ্ধিকে চাঙ্গা করতে পারে। কিন্তু, তার চেয়েও বড় প্রশ্ন হলো– কে এই বিনিয়োগ করবে?'
শক্তিশালী ডলার কেন ভোক্তাদের ওপর কেমন প্রভাব ফেলে?
অতি-শক্তিমান ডলার যুক্তরাষ্ট্রের আমদানি সক্ষমতা বাড়ায়। কিন্তু, উল্টো চাপ পড়ে অমার্কিন ভোক্তার ঘাড়ে। যেমনটা দেখা যাচ্ছে ইউরোপে। মহাদেশটির গার্হস্থ্য পর্যায় থেকে শুরু করে কোম্পানিগুলোর খরচ এতে বেড়ে গেছে। মূল্যস্ফীতির এই সময়ে যা আরও ব্যয়ের চাপ সৃষ্টি করেছে। কারণ বিশ্ববাণিজ্যে জ্বালানিসহ অধিকাংশ পণ্যের সিংহভাগ লেনদেন এখনও ডলারেই হয়।
এই পরিস্থিতিতে ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়নের অর্থ কাঁচামাল ও নিত্যপণ্য আরও দামি হয়ে ওঠা। যা স্থানীয় মূল্যস্ফীতিকে জোরদার করে, ভোক্তাদের ভোগ কমাতে বাধ্য করে।
তবে মুদ্রার অবমূল্যায়ন রপ্তানি খাতের জন্য ভালো। জার্মানির মতো রপ্তানি-নির্ভর অর্থনীতি এর সুবিধা নিতে পারবে। কিন্তু, বৈশ্বিক সরবরাহ চক্র ব্যাহত হওয়া, ইউক্রেন যুদ্ধ ও রাশিয়ার ওপর দেওয়া নিষেধাজ্ঞার ফলে এই সুফল খুব একটা বেশি হবে না। ভোক্তা মূল্যস্ফীতি লাঘবেও বাড়তি রপ্তানি আয় খুব বেশি অবদান রাখবে না।
উন্নয়নশীল তথা উদীয়মান দেশের বাজারও ডলারের দেওয়া যন্ত্রণার কাঁটা অনুভব করছে। এসব দেশের আবার রয়েছে ভোগ্যপণ্য আমদানি নির্ভরশীলতা। যেমন অপরিশোধিত জ্বালানি ও ভোজ্য তেল আমদানির ওপর ব্যাপক নির্ভরশীলতা রয়েছে ভারতের। ডলারের বিপরীতে মান হারানোর কারণে এসব আমদানি নয়াদিল্লির জন্য আরও খরচবহুল হয়ে উঠছে।
বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভেও ঘাটতি তৈরি করেছে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির ফলে দেখা দেওয়া ডলারের সংকট।
তাছাড়া ডলারের মান বাড়ার কারণে, ঋণগ্রহণের খরচও বাড়ছে উন্নয়নশীল দেশগুলোর।
সে তুলনায় স্বস্তিতে আছে মার্কিন ভোক্তা ও ব্যবসা খাত। তবে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক কোম্পানিই বিদেশে উৎপাদন করে। ওইসব দেশে কাঁচামাল আমদানি ব্যয় বাড়ায়– সার্বিকভাবে তাদের মুনাফা কমে যাবে।
নেতিবাচক পরিবেশ
আগেই বলা হয়েছে ডলার শক্তিশালী হওয়া মানে, উদীয়মান অর্থনীতিগুলোর জন্য বিপদ। বিশেষ করে যেসব দেশের আছে মার্কিন ডলারে নেওয়া বিপুল ঋণের বোঝা। যেমন দেওয়া যায়– তুরস্ক, আর্জেন্টিনা ও ঘানার উদাহরণ। ডলারের মান বাড়ার ফলে দেনা পরিশোধের খরচ অটেকসই হয়ে উঠবে অনেক দেশেরই।
ক্যাপিটাল ইকোনমিক্স সংস্থার উদীয়মান বাজার বিষয়ক অর্থনীতিবিদ উইলিয়াম জ্যাকসন বলেন, 'উদীয়মান বাজারের জন্য সার্বিকভাবে এটি নেতিবাচক এক পরিবেশ। তবে ভালো খবর হলো- বড় আকারের উদীয়মান অর্থনীতিগুলোর ডলারে নেওয়া ঋণের অঙ্ক তুলনামূলকভাবে স্বল্প। এবং তাদের মুদ্রার খুব বড় পরিসরে অবমূল্যায়ন ঘটেনি। এই দেশগুলির মধ্যে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে ফ্রন্টিয়ার মার্কেট বলে পরিচিত বিকাশমান অগ্রণী বাজারগুলি। যেমন এরমধ্যেই এমন দুটি দেশ শ্রীলঙ্কা ও ঘানায় আশঙ্কা বাস্তবে রূপ নিয়েছে। তুরস্ক ও আর্জেন্টিনার মতো দেশগুলিও রয়েছে ঝুঁকির তালিকায়'।
সার্বিকভাবে বলা যায়, আমদানি নির্ভর দেশের জন্য দুঃসংবাদ শক্তিশালী ডলার। এতে মূল্যস্ফীতির দাবানল আরও ছড়াবে। ডলার রিজার্ভও তাতে আশঙ্কাজনকভাবে কমবে তাদের। ফলে আমদানি ব্যয় পরিশোধ করাটাও হয়ে উঠবে আরও প্রাণান্তকর চেষ্টা।
- সূত্র: ডয়চে ভেলে