কেন রাশিয়া সস্তা ইরানি ড্রোন বিপুল সংখ্যায় ইউক্রেনে ব্যবহার করছে
ইউক্রেনে রণাঙ্গনে মাসের পর মাস- ইউক্রেনীয় বাহিনীর ড্রোন আর দূরপাল্লার রকেটের আঘাতে নাজেহাল হয়েছে রুশ বাহিনী। এসব অস্ত্র দেয়- তুরস্ক, যুক্তরাষ্ট্র ও অন্য পশ্চিমা দেশগুলো। তুর্কি ড্রোনের সাফল্য দেখে যুক্তরাষ্ট্র পরে ইউক্রেনকে আকারে ছোট ও রণাঙ্গনের যেকোনো স্থান থেকে নিক্ষেপযোগ্য সুইচব্লেড সিরিজের কামিকাজি (আত্মঘাতী) ড্রোনও দেয়।
শত্রুর এসব কৌশলকে রপ্ত করেছে রাশিয়া। এভাবে আঘাত হানার সামর্থ্য অর্জনও করেছে। ইরান থেকে সংগ্রহ করা রাশিয়ার ড্রোনের মধ্যে আছে ডানাওয়ালা মিসাইল সদৃশ শাহিদ সিরিজের ড্রোন। এখন প্রতিনিয়ত যার হামলার শিকার হচ্ছে ইউক্রনীয় বন্দর নগরী ওডেসা।
গত গ্রীষ্মের আগে ওডেসা আক্রান্ত হবে এমন ভীতিতে শহরটি ছেড়ে পালান বহু মানুষ। এরপর দীর্ঘদিন তেমনটা দেখা যায়নি। কিন্তু, ইরানি ড্রোনের মুহুর্মুহ আক্রমণের মুখে আবারো বাড়িঘর ছেড়ে পালাচ্ছে অনেক ওডেসাবাসী।
ওডেসার কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত ইউক্রেনীয় সামরিক বাহিনীর দক্ষিণাঞ্চলীয় কমান্ড; সেখানে এবং ওডেসার বন্দর অবকাঠামোয় ফের আঘাত হানতে শুরু করেছে রাশিয়া। ড্রোন দিয়ে গত এক সপ্তাহে হামলা চালিয়েছে একটি গোলাবারুদের ডিপো এবং শহরের বাইরের অন্যান্য লক্ষ্যবস্তুতে।
১০ লাখ অধিবাসীর ওডেসায় নতুন আতঙ্কের নাম ইরানের শাহিদ ড্রোন। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, যুদ্ধকালে টিকে থাকার আপ্রাণ চেষ্টারত স্থানীয় ব্যবসাবাণিজ্য, বন্দরেও তৈরি হচ্ছে জটিলতা। মাথার ওপর ইরানি শাহিদ-১৩৬ ড্রোন উড়তে থাকায় জাহাজে মালামাল ওঠানামা করতেই ভয় পাচ্ছে ডক কর্মী ও নাবিকরা।
ব্লুমবার্গকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এ বর্ণনা দেন ওডেসার মেয়র গেনেডি তুর্খানভ।
এর আগে জাতিসংঘ ও তুরস্কের মধ্যস্ততায় ইউক্রেন ও রাশিয়া একটি চুক্তি সই করে। যার আওতায় ওডেসা বন্দর দিয়ে খাদ্যশস্য রপ্তানির সুযোগ দেয় রাশিয়া। কৃষ্ণসাগরে অবরোধকারী রুশ যুদ্ধ জাহাজগুলি এ চুক্তি মেনে ইউক্রেনীয় বন্দরটিতে বাণিজ্য জাহাজের আসা-যাওয়ায় বাধা দেবে না। চুক্তির ফলে প্রাণ ফিরছিল ওডেসার অর্থনীতিতে। তুর্খানভ জানান, এরপর থেকে ২২৮টি জাহাজ ওডেসায় যাতায়াত করেছে।
ব্লুমবার্গের মতো পশ্চিমা গণমাধ্যমের দাবি, চুক্তির পরও ড্রোন হামলা করে জাহাজ চলাচলে ব্যাঘাত ঘটাতে চায় রাশিয়া। তবে মস্কো সামরিক উদ্দেশ্যেই ড্রোন ব্যবহার করছে বলে মনে করেন নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞরা।
ইরানি ড্রোনের সবচেয়ে বড় সুবিধা– এগুলো বানানোর খরচ অনেক কম, আবার আকারে ছোট হওয়ায় গুলি করে ভূপাতিত করাও সহজ নয়। ফলে ইউক্রেনীয় বাহিনীর পেছনের সাড়িতে অবস্থিত রসদ সরবরাহ ও কমান্ড সেন্টারে অনায়সেই আঘাত হানছে।
রাশিয়া ইরানের থেকে শুধু ড্রোনই কেনেনি, বরং স্থানীয়ভাবে সেগুলি উৎপাদনের লাইসেন্স নিয়েছে। যেমন ইরানের তৈরি শাহিদ-১৩৬ ড্রোন গেরান-২ নামে উৎপাদন করছে।
ওডেসার আঞ্চলিক সামরিক প্রশাসনের একজন মুখপাত্র সেরহি ব্রাতচুক বলেন, 'এই ড্রোন বেশ ধীরগতির হলেও বহন করে শক্তিশালী বিস্ফোরক– ফলে এগুলির আঘাত একটি ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতের সমান'।
'ক্ষেপনাস্ত্রের চেয়েও বহুগুণে সস্তা হওয়ায়, একটি লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে একাধিক শাহিদ-১৩৬ নিক্ষেপ করা হয়। সস্তা হওয়ায় একটি ড্রোন সফল হওয়াই যথেষ্ট, বাকিগুলি ধবংস হলেও উদ্দেশ্যসাধন ঠিকই হয়'।
ব্রাতচুক বলেন, 'এতে জনসংখ্যার ওপর মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব পড়ে। এটি সন্ত্রাসবাদের শামিল। রাশিয়ানরা এখন তাদের কৌশলের নতুন প্রয়োগ খুঁজছে'।
রাশিয়ার সামরিক ব্লগাররা ইরানি ড্রোনের ব্যবহারকে ইউক্রেনের আমেরিকান হিমার্স রকেট সিস্টেম ব্যবহারের সাথে তুলনা করছেন। হিমার্স দিয়ে দূরপাল্লার রকেট ছুঁড়ে রুশ গোলন্দাজ বাহিনীর গোলাবারুদের মজুদ ধবংস করে দেওয়া হয়। ফলে রাশিয়ানদের গোলা নিক্ষেপের সক্ষমতায় পড়ে ভাটা। এই অবস্থায় পাল্টা আক্রমণ অভিযানের সুযোগ পেয়ে যায় কিয়েভ। আর তাতে অনেকটাই ঘুরে গেছে যুদ্ধের মোড়।
লড়াইয়ের সম্মুখভাগেও ব্যবহার হচ্ছে ইরানি ড্রোন। রাশিয়ার সামরিক ব্লগারদের অনেকেই শাহিদ-১৩৬ এর আঘাতে ধবংস হওয়া ইউক্রেনীয় সাঁজোয়া যান ও কামানের ছবি পোস্ট করেছেন। মার্কিন গণমাধ্যম দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের একটি প্রতিবেদনও তাদের দাবিকে সমর্থন করছে।
ড্রোন ভূপাতিতও হচ্ছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যায়। তবু শেষরক্ষা হচ্ছে না। যেমন গত মঙ্গলবার ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর ফেসবুক পেইজে ওডেসার পার্শ্ববর্তী মিকোলায়েভ অঞ্চলে আরও তিনটি শাহিদ ড্রোন ধবংস করার কথা জানানো হয়। এনিয়ে মোট ২০টি শাহিদ ড্রোন ভূপাতিত করলো কিয়েভের বাহিনী।
লেজিটিমেট- নামধারী রুশপন্থী এক ব্লগার লিখেছেন, 'শুধু ওডেসাকে রক্ষা করতে হলে– চাই শত শত কোটি ডলারের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। যেগুলির রক্ষণাবেক্ষণ খরচ আরও শত শত মিলিয়ন ডলার। এত টাকা ইউক্রেনের নেই'।
রুশপন্থি সাইটগুলোতে দেখা যাচ্ছে উল্লাস। রুশ ব্লগার ও তাদের সমর্থকরা আশা করছেন, একসঙ্গে বহু ড্রোনকে উড়িয়ে ধবংস করে দেওয়া যাবে ইউক্রেনের অ্যান্টি-এয়ারক্রাফট ব্যাটারিগুলোকে। ফলে যুদ্ধের শুরু থেকেই রাশিয়া আকাশপথে যে আধিপত্যের অভাবে ভুগছে তা প্রথমবারের মতো লাভ করবে।
তবে এই আশাপূরণের সম্ভাবনা খুবই কম বলে জানাচ্ছেন পশ্চিমা সামরিক বিশ্লেষকরা। তবু ইরানি ড্রোন ওডেসার জন্য নতুন এক হুমকি হয়ে উঠেছে বলেই জানান মেয়র তুর্খানভ।
মঙ্গলবার ব্লুমবার্গকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, 'এই ড্রোন মোকাবিলার কার্যকর একটি উপায় বের করব আমরা' – এরমধ্যেই বেজে ওঠে বিমান হামলার সাইরেন। ফলে সাক্ষাৎকার বন্ধ করে নগরীর একটি সিনেমা হলের বেজমেন্টে আশ্রয় নিতে হয়ে সকলকে।
ইউক্রেনীয় বাহিনী পরবর্তীতে জানায়, রাশিয়ান একটি সুখই-২৫ বিমানের হামলা সম্পর্কে ওই সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছিল। তারা এটিকে ভূপাতিত করার দাবিও করেছে। ওইদিন বিকেলেই আরও তিনটি ড্রোন ধবংসের দাবি করে ইউক্রেনীয় বিমানবাহিনী। তবে সেগুলো কোন ধরনের ড্রোন তা তখনও নিশ্চিত করতে পারেনি।
ইসরায়েল থেকে অ্যান্টি-ড্রোন সিস্টেম কেনার সম্ভাবনার প্রতি ইঙ্গিত দেন তুর্খানভ। কারণ অন্তত এক দশক ধরে ইরানের তৈরি লয়টারিং মিউনিশন জাতীয় ড্রোন ঠেকাতে সফলতা দেখিয়েছে সেগুলো। ইউক্রেনীয় প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রকৌশলীরাও এমন সুরক্ষা ব্যবস্থা তৈরির চেষ্টা করছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা তথ্যমতে, গত আগস্টের শেষদিকে ইরান থেকে ১ হাজার ড্রোনের চালান পেয়েছে রাশিয়া।
দামে সস্তা শাহিদ-১৩৬ ড্রোন একসাথে অনেকগুলি ওড়ানো যায়। অন্যদিকে এগুলো ধবংস করতে ইউক্রেনকে যেসব বিমান-বিধ্বংসী মিসাইল ছুড়তে হয়- তার একেকটির দামই লাখ লাখ ডলার। ফলে শত্রুর ওপর প্রচণ্ড আর্থিক ও মানসিক চাপ সৃষ্টি করতে অদ্বিতীয় শাহিদ-১৩৬।
লন্ডন-ভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইন্সটিটিউটের বিমানশক্তি ও সামরিক প্রযুক্তি বিষয়ক জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো জাস্টিন ব্রঙ্ক অবশ্য মনে করেন, যুদ্ধের মোড় ঘোরানোর মতো 'সুপার অয়েপন' নয় শাহিদ।
এই অস্ত্রের বিষয়ে এক টুইটার থ্রেডে ব্রঙ্ক ব্যাখ্যা করেছেন যে, প্রপেলার-চালিত ধীর গতির ও নিচু দিয়ে উড়তে সক্ষম– এমন মিসাইল সিরিজের একটি হলো শাহিদ-১৩৬। ১৯৮০- এর দশক থেকেই এ ধরনের অস্ত্র ব্যবহারের প্রচলন রয়েছে। ইরান আলিবাবার মতো ই-কমার্স সাইটে সহজে কিনতে পাওয়া যায় এমন জিপিএস সিস্টেম কিনে এতে যুক্ত করেছে। ফলে এটি কিছুটা উন্নত হয়েছে।
এগুলি সহজেই ইলেকট্রনিক জ্যামিং ও বিমান-বিধ্বংসী কামানের শিকারে পরিণত হতে পারে। এক্ষেত্রে কার্যকর হবে জার্মানির তৈরি গেপার্ড যান। এরমধ্যেই ইউক্রেনকে অন্তত ২৬টি গেপার্ড পাঠিয়েছে বার্লিন। আবার ইসরায়েলি সিস্টেমগুলিও হবে অতি-কার্যকর। কারণ তাদের আরও অত্যাধুনিক ইরানি ড্রোন ধবংসের উজ্জ্বল রেকর্ড আছে।
তবে এটাও ঠিক, আকারে ফ্রান্সের চাইতেও বড় একটি দেশের পুরো আকাশসীমাকে নিরাপদ রাখার মতো এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম নেই কিয়েভের কাছে। অন্যদিকে, হাজারো মাইল দূরত্ব পাড়ি দিতে পারে শাহিদ-১৩৬; শত্রুর আকাশসীমায় প্রবেশ করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা উড়ে বেড়ায়– আর কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যবস্তু শনাক্ত হওয়ার পরই কম্যান্ড সেন্টারের নির্দেশমতো তার ওপর হামলা চালায়।
তাই এটি মোকাবিলায় 'পশ্চিমা সহযোগীদের কিয়েভকে আরও স্বল্প ও মধ্যম পাল্লার বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপনাস্ত্র সরবরাহের' পরামর্শ দেন ব্রঙ্ক।
- সূত্র: ব্লুমবার্গ, স্টারস অ্যান্ড স্ট্রাইপস