১৫ বছর বয়সে ভারত ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন শেষ শিখ রাজা দুলিপ সিং, বন্ধু হয়েছিলেন রানি ভিক্টোরিয়ার
১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ক্রমশ ভারতে আধিপত্য গেড়ে বসে। এর ১০০ বছর পরে ১৮৫৮ সালে ভারত শাসনের ক্ষমতা কোম্পানি ব্রিটিশ সরকার তথা রাজপরিবারের কাছে হস্তান্তর করে। ব্রিটিশদের শাসনামালে ভারতবর্ষে যেমন অসংখ্য ইংরেজ ও ইউরোপীয় রাজকর্মচারী এসেছিলেন, তেমনি এখানকার অনেকেই ব্রিটেন ও ইউরোপে গিয়েছিলেন।
ভারতবর্ষ থেকে মূলত সম্ভ্রান্ত, বনেদি পরিবারের মানুষেরাই ব্রিটেনে যেতেন। কখনো পড়ালেখার উদ্দেশ্যে, কখনো হয়তো ভ্রমণের জন্য। ব্রিটিশ রাজপরিবারে সঙ্গেও ভারতীয় অনেক রাজপরিবারের সদস্যদের সংযোগ ঘটেছিল। খোদ ব্রিটেনের রানি ভিক্টোরিয়ার ভারতীয় খানসামা ছিল। সেই খানসামা আবদুল করিম পরে রানির উর্দু শিক্ষক হন। তবে তাদের সম্পর্ক গুরু-শিষ্য বা প্রভু-খানসামা'র সম্পর্ক ছাড়িয়ে অন্য মাত্রার বন্ধুত্বপূর্ণ ঘনিষ্ঠতায় পৌঁছে গিয়েছিল।
ভারতের কুর্গ রাজ্যের রাজকুমারী গৌরাম্মার ধর্মমাতা হয়েছিলেন রানি ভিক্টোরিয়া। নিজের সাম্রাজ্যকে মানবহিতৈষী হিসেবে তুলে ধরতে সে সময় রানি ভিক্টোরিয়া সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে থাকা ব্রিটিশ উপনিবেশগুলো থেকে অনেক কিশোর-কিশোরীকে দত্তক হিসেবে নিয়েছিলেন। ভারতবর্ষ থেকে এরকম আরেকজন রাজপুত্র ব্রিটিশ পরিবারে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন শিখ সাম্রাজ্যের শেষ রাজা মহারাজ দুলিপ সিং।
১৭৯৯ সালে পাঞ্জাবে শিখ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সম্রাট রঞ্জিত সিং। তারই সর্বকনিষ্ঠ পুত্র দুলিপ সিং। ভাই ও বাবা মারা যাওয়ার পর মাত্র পাঁচ বছর বয়সে শিখ সাম্রাজ্যের সিংহাসনে বসেন দুলিপ। কিন্তু ১৮৪৯ সালে ব্রিটিশরা পাঞ্জাব দখল করলে ক্ষমতা ছাড়তে হয় তাকে।
১৫ বছর বয়সে চিরতরে ভারত ত্যাগ করে ইংল্যান্ডে চলে যেতে বাধ্য হন দুলিপ সিং। নতুন বিলেতজীবনের সঙ্গে সঙ্গে তার ধর্মীয়জীবনেও পরিবর্তন আসে। তিনি খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন। রানি ভিক্টোরিয়ার কাছে তাকে পাঠানো হয়। বলা হয়ে থাকে, ভারতে ডালহৌসি'র শাসনে একজন রাজা হিসেবে যতটা মর্যাদা ও আরাম-আয়েশ পেতেন, ব্রিটেনের রাজপরিবারে তার চেয়ে বেশি পেয়েছেন দুলিপ।
ইংল্যান্ডে প্রথম আসার দুলিপের অভিভাবকত্বের দায়িত্ব দেওয়া হয় সেনাবাহিনীর সার্জন স্যার জন স্পেন্সার লগিন ও তার স্ত্রী লেডি লগিনের ওপর। তবে রাজপরিবারের ছায়া তার ওপর সবসময় ছিল।
রানি ভিক্টোরিয়া দুলিপ সিংকে বেশ পছন্দই করতেন। ১৮৬৮ সালে লেখা তার জার্নালে তিনি নিজেকে দুলিপের 'স্নেহধন্য' বন্ধু হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তৎকালীন প্রিন্স অভ ওয়েলস ও পরে রাজা সপ্তম এডওয়ার্ডের সঙ্গে দুলিপ নিয়মিত শিকারে যেতেন বলেও উল্লেখ পাওয়া যায়।
দুলিপ বিলেতে আসার আগেই রাজকুমারী গৌরাম্মাকে দত্তক নিয়েছিলেন রানি ভিক্টোরিয়া। তিনি চেয়েছিলেন গৌরাম্মা আর দুলিপের মধ্যে বিয়ে হোক। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা আর হয়ে ওঠেনি। তারা দুজনই নিজেদের মধ্যে বিয়ের ব্যাপারে আগ্রহ দেখাননি।
দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-এর এক লেখায় জানা যায়, প্রাথমিক জীবনে পরিবারের আর্থিক অবস্থা নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকতেন দুলিপ। ভারতেও তার আর ফেরার কোনো উপায় ছিল না, কারণ ততদিনে তখনকার গভর্নর-জেনারেল লর্ড ডালহৌসি দুলিপ ও তার পরিবারের সব ধরনের রাজকীয় সুযোগসুবিধা বাতিল করেছেন।
দুলিপ সিংয়ের কাছ থেকেই কোহিনুর হীরা চলে যায় ব্রিটিশদের কাছে। ১৮৪৫-৪৬ সালে সংঘটিত 'অ্যাংলো-শিখ' যুদ্ধের 'ক্ষতিপূরণ হিসেবে' রানি ভিক্টোরিয়াকে কোহিনুর উপহার দিয়েছিলেন দুলিপ। উনবিংশ শতকের গোড়ার দিকে দুলিপের বাবা রণজিৎ সিংয়ের হাতে আসে হীরাটি।
ব্রিটিশ অভিজাততন্ত্রে মহারাজ দুলিপ সিংয়ের ছেলেদের 'হেরাডিটারি পিয়ার্স' সুবিধা চেয়েছিলেন রানি ভিক্টোরিয়া। কিন্তু সে প্রস্তাবে না করে দেন দুলিপ। পাঞ্জাবের রাজকোষ থেকে কোহিনুরসহ অন্যান্য দামি হীরা হাতিয়ে নিয়েছিল ব্রিটিশরা। তারই ক্ষতিপূরণ হিসেবে এমন প্রস্তাব জানিয়েছিলেন রানি।
এই অভিজাত উপাধিতে কোনো নগদ অর্থের সুবিধা ছিল না বটে কিন্তু এর ফলে মহারাজ দুলিপের ছেলেদের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অংশ হওয়ার সুযোগ হতো, সামাজিক মর্যাদাও তুঙ্গে উঠত। এমনকি হাউজ অভ দ্য লর্ডসেও বসার সুযোগ পেতেন দুই শিখ যুবরাজ।
যদি দুলিপ সিং রানির এ আমন্ত্রণ গ্রহণ করতেন, তাহলে প্রথম অশ্বেতাঙ্গ হিসেবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের 'পিয়ারেজ' নামক এ সুবিধাটি পেতেন তারা। কিন্তু সিং বলেছিলেন, 'আমি মহারানিকে ধন্যবাদ জানাই… কিন্তু আমাদের কোনোভাবেই শিখ পরিচয় ত্যাগ করা যাবে না।'
দুলিপের দুই পুত্র ভিক্টর ও ফ্রেডির জন্য আলাদা আলাদা উপাধি দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল রাজপরিবারের। বড় ছেলে ভিক্টরকে মারকুইজ (কাউন্টের ওপরে ও ডিউকের নিচের উপাধি) এবং ফ্রেডিকে আর্ল (ভিসকাউন্টের ওপরে ও মারকুইজের নিচে) খেতাব দিতে চেয়েছিলেন তারা। মনে করা হয়, শিখ মহারাজকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রতি আজীবনের জন্য অনুগত করে রাখার নানা প্রচেষ্টার একটি ছিল এটি।
ব্রিটেনে গিয়ে সংসারজীবনে থিতু হতেও কিছুটা বেগ পোহাত হয়েছিল মহারাজ দুলিপকে। পছন্দসই কোনো ইংরেজ নারীর খোঁজ পাননি তিনি। শেষে ১৮৬৪ সালে জনৈক জার্মান-ইথিওপিয়ান দম্পতির মেয়ে বাম্বা মুলারকে বিয়ে করেন দুলিপ।
ইংল্যান্ডের সাফোকের গ্রাম এলাকায় এলভেডেন হল নামক একটি প্রাসাদোপম বাড়ি তৈরি করেন দুলিপ। এলভেডেন হলের আয়তন ছিল ১৭,০০০ একর। দুলিপ-মুলারের ঘরে ছয় সন্তানের জন্ম হয়। নিজের পরবর্তী জীবনে 'দ্য ব্ল্যাক প্রিন্স অফ পার্থশায়ার' নামে পরিচিত হয়েছিলেন মহারাজ দুলিপ সিং।
যুক্তরাজ্যের একজন ইতিহাসবিদ ও শিল্পসংগ্রাহক পিটার বেন্স গত ২৫ বছর ধরে দুলিপ সিংয়ের ওপর গবেষণা করছেন। মহারাজ দুলিপের অনেক ব্যক্তিগত জিনিসপত্র তিনি কখনো স্থানীয়দের কাছ থেকে, আবার কখনোবা দুলিপের পরিবার থেকে সংগ্রহ করেছেন। দুলিপের দ্বিতীয় সন্তান প্রিন্স ফ্রেডেরিক ডুলিপ সিং ১৯২১ সালে ১৫ শতকের একটি পুরোনো বাড়ি কিনে সেটিকে পরে জাদুঘরে পরিণত করেন।
কেনার তিন বছর পর তিনি অ্যানসিয়েন্ট হাউজ মিউজিয়াম নামের ওই জাদুঘরটি স্থানীয় লোকদের জন্য দান করে যান। পিটার বেন্স জানিয়েছেন, ওই জাদুঘরে দুলিপকে নিয়ে বইপত্র থাকলেও তার সন্তানদের নিয়ে বিশেষ কিছু নেই। তিনি নিজ দায়িত্বে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে মহারাজ দুলিপ সিংয়ের সন্তানদের বিষয়ে খবরাখবর জানার চেষ্টা করেন।
বর্তমানে (অক্টোবর, ২০২২) যুক্তরাজ্যের নরউইচের আর্কাইভ সেন্টারে দুলিপ সিংকে নিয়ে একটি প্রদর্শনী চলছে। নিজের সংগ্রহের অনেক কিছুই এ প্রদর্শনীকে ধার দিয়েছেন পিটার বেন্স। তিনি আশা করেন এ প্রদর্শনীর মাধ্যমে বর্তমান প্রজন্মের ব্রিটিশ-ভারতীয়রা নিজেদের ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে জানার জন্য আরও বেশি উৎসাহিত হবে।
- তথ্যসূত্র: বিবিসি, দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ট্রিবিউন ইন্ডিয়া