আমি সেই ট্রাম ড্রাইভারকে খুঁজি
১.
আমি সেই ট্রাম ড্রাইভারকে খুঁজি। শুনেছি চেতলা অঞ্চলে বাড়ি তাঁর। ১৪ অক্টোবর ১৯৫৪ বাড়ি ফিরে নিশ্চয় কষ্ট হয়েছিল তাঁর। এতবার ট্রামের ঘণ্টা বাজাচ্ছিলেন, রাস্তার লোকজন তারস্বরে চিৎকার করছিল, তবু মানুষটির যেন কোনও বাহ্যজ্ঞান ছিল না। আপনমনে রাস্তা পার হচ্ছিলেন। এই পৃথিবীর হয়েও যেন এই পৃথিবীর নয়।
পরেরদিন কবির দুর্ঘটনার খবর যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত হলো। ট্রাম ড্রাইভার ভদ্রলোকের তা নজর এড়িয়ে গেল। আর অন্যদিনের মতো তিনি ঘর থেকে বের হলেন, কাজে গেলেন। শুধু দেশপ্রিয় পার্ক অঞ্চলের কাছাকাছি এলেই বুকে যেন চিনচিন ব্যথা। ইশ্ ভদ্রলোককে বাঁচাতে পারলাম না! শুধু তাঁর নিজের জীবনে কেন, কারও কাছেও তিনি শোনেননি কোনো মানুষ পৃথিবীর মন্থরতম এই যানে চাপা পরেছে।
আমি ট্রামে চাপা পড়া সেই হতভাগ্য মানুষটিকেও খুঁজি। সেই কতদিন আগে তিনি তাঁর ডায়েরিতে সংগোপনে ট্রাম সম্পর্কে লিখে রেখেছিলেন এই অমোঘ মন্তব্য: 'Philosopher's Car'
শুধু তাই নয়, তাঁর গল্পের নায়ক যখন বাড়ি ফেরে, তাকে সাবধান করে দেওয়া হয়, ট্রামে যেন চাপা না পড়ে। হ্যাঁ, গাড়ি বাস থাকতেও শুধু ট্রামের কথা বলা হয়! ট্রাম লাইনকে তাঁর মনে হবে 'আদিম সর্পিণী সহোদরার মতো'!
কী বলব একে? ভবিষ্যতদ্রষ্টা? সমাপতন? নইলে এক্সিডেন্টের দুদিন আগে থেকে কীভাবে ভাইয়ের বাড়িতে গিয়ে খোঁজ নেন, এই অঞ্চলে কোনো দুর্ঘটনা হয়েছে কিনা। ঠিক একদিন আগে রেডিওতে যে কবিতা পড়বেন, তাতেও তো মৃত্যুর ছায়া!
'শূন্যকে শূন্যের হাতে ছেড়ে দিয়ে শেষে
কোথায় সে চলে গেল তবে।
কিছু শীত কিছু বায়ু আবছা কিছু আলোর আঘাতে
ক্ষয় পেয়ে চারিদিকে শূন্যের হাতে
নীল নিখিলের কেন্দ্রভার
দান করে অন্তহীন শূন্যতাময় রূপ বুঝি;
ইতিহাস অবিরল শূন্যের গ্রাস।'
আমি সেই ট্রাম ড্রাইভারকে খুঁজি।সেদিন যে ট্রাম নিয়ে তিনি রওনা হয়েছিলেন সেই ট্রামের নম্বর BLG304। আমি সেই ট্রামটিকে খুঁজি। শুনেছি সেই অভিশপ্ত ট্রাম আগুনে পুড়ে ধ্বংস হয়ে গেছে। আমি দু'দিক রাস্তার মাঝখানের সেই ঘাস খুঁজি, ঘাসে কবির রক্তের দাগ খুঁজি। কতদিন হল, সেই ঘাস উপড়িয়ে ফেলে কংক্রিট করে ফেলা হয়েছে।
মৃত্যু নিয়ে একটু বেশিই আবিষ্ট ছিলেন ট্রামে চাপা পড়া মানুষটি। তাঁর গল্পের নায়ক মৃত্যু নদীর কোনো এক রাজহংসীর জন্য শুধু অপেক্ষা করে। তাঁর গল্পের নায়ক একখানা স্টিক হাতে নিয়ে অন্ধকারে বাড়ি থেকে বের হয়, 'জীবনের যত মৃত ধ্বনি, যত মৃত কথা, মৃত সুখ খুঁজে বার করবার জন্য'।
কী আশ্চর্য সমাপতন! সেই ট্রাম ড্রাইভারের ১৬/১৭ বছরের ছেলেটি বাবাকে লুকিয়ে লুকিয়ে কবিতা পড়ত, যে মানুষটি ট্রাম দুর্ঘটনায় আহত হয়েছিলেন, সেই মানুষটির কবিতাই! লুকিয়ে কারণ বাবা ছেলেকে কবিতা পড়তে দেখলে খুব রেগে যেতেন যে।
ততদিনে ট্রামে চাপা পড়া ভদ্রলোকের মৃত্যু হয়েছে। ট্রাম ড্রাইভার জানতে পেরেছেন, যেমন তেমন মানুষ নন তিনি, এই সময়ের এক মহত্তম কবি। নাম জীবনানন্দ দাশ।
সেদিন একটু আগেই বাড়ি ফিরে এসেছেন। মনটা ভালো নেই। শুধু সেই কবির মুখটা চোখে ভাসছে। শেষ মুহূর্তে হাজার চেষ্টা করেও দুর্ঘটনা রোধ করতে পারেননি তিনি। ছেলেকে কোমল গলায় ডাকলেন, কী কবিতা পড়িস তুই আমাকে লুকিয়ে লুকিয়ে। ছেলে কম্পিত হাতে একটি কবিতার বই বাবার সামনে মেলে ধরল। 'জীবনানন্দ দাশ প্রণীত শ্রেষ্ঠ কবিতা'। বাবার চোখে জল। আলতো হাতে ছেলেকে স্পর্শ করলেন। যেন অতীত ভবিষ্যতকে স্পর্শ করছে।
তখন অনেক রাত। চেতলা থেকে ক্যাওড়াতলা শ্মশান তো বেশি দূরের পথ নয়। কিছুদিন আগে জীবনানন্দকে এখানে দাহ করা হয়েছে। ছেলে সঙ্গে কবির বই নিয়ে এসেছে। বাবা অস্ফুট স্বরে বললে, বাছা কয়েকটি কবিতা পড়ে শোনা তো।
শ্মশানের নিভন্ত আলোতে ছেলে পড়তে থাকে:
'তোমাকে দেখার মতো চোখ নেই— তবু,
গভীর বিস্ময়ে আমি টের পাই— তুমি
আজো এই পৃথিবীতে র'য়ে গেছ।
কোথাও সান্ত্বনা নেই পৃথিবীতে আজ;
বহুদিন থেকে শান্তি নেই।
নীড় নেই
পাখিরো মতন কোনো হৃদয়ের তরে।
পাখি নেই।
মানুষের হৃদয়কে না জাগালে তাকে
ভোর, পাখি, অথবা বসন্তকাল ব'লে
আজ তার মানবকে কি ক'রে চেনাতে পারে কেউ।'
২.
অফিসে আপনি টয়লেটে গেলে খাতায় সময় নোট করে রাখা হত।
আপনি কোনো প্রতিবাদ করেননি।
আপনার কাজের জায়গায় টেবিল থেকে সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ ফাইল সরিয়ে নেওয়া হল।
আপনি কোনো প্রতিবাদ করেননি।
একটি পত্রিকা সম্পাদনা করলেন আপনি অথচ সম্পাদক হিসেবে অন্য নাম ছাপা হলো।
আপনি কোনো প্রতিবাদ করেননি।
আপনার দেখা পরীক্ষার খাতা আপনার অজান্তে আবার অন্য কোনো পরীক্ষককে দিয়ে পরীক্ষা করে দেখা হতো।
আপনি কোনো প্রতিবাদ করেননি।
টিউশনি না গেলে মাইনে থেকে সমানুপাতিক টাকা কেটে নেওয়া হতো।
আপনি কোনো প্রতিবাদ করেননি।
দিস্তার পর দিস্তা নোট লিখেছেন আপনি আর সেই নোট অন্যের নামে প্রকাশিত হতো।
আপনি কোনো প্রতিবাদ করেননি।
ক্লাসের ছাত্ররা কাগজ গোল্লা করে আপনাকে ছুঁড়ে মারত, বিল্লি ডাকত।
আপনি কোনো প্রতিবাদ করেননি।
অনেক এলেবেলে লেখা যত্ন করে পত্রিকার ওপরে ছাপা হত আর আপনারটা সবার নিচে।
আপনি কোনো প্রতিবাদ করেননি।
আপনার কবিতা থেকে লাইনের পর লাইন বাদ দিয়ে তা প্রকাশ করা হয়েছে।
আপনি কোনো প্রতিবাদ করেননি।
গভীর রাতে আপনার স্ত্রীকে অন্য লোক বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছে।
আপনি কোনো প্রতিবাদ করেননি।
ডায়েরিতে লিখবেন, '...কোনো দিন কি table turned হবে? তাহলে দেখিয়ে দিতাম মজা...কিন্তু তা তো হবে না, আমিই চিরকাল অনেকের কাছে underdog হয়ে থাকব & shall make them feel the pleasures of top dogs.'
তাই হয়তো আপনি কোনো প্রতিবাদ করেননি।
জীবনানন্দ দাশ, আপনার জীবনে শুধুমাত্র একটিই প্রতিবাদ। এবং তা আপনার লেখা।
- লেখক: জীবনানন্দ গবেষক