লৌহবস্তু দিয়া বাষ্পীয় রকেট চলিতেছে
ভারত স্বাধীন হওয়ার ঠিক ৯৩ বছর আগে ১৫ আগস্ট ১৮৫৪ অখণ্ড বাংলার হাওড়া থেকে হুগলি পর্যন্ত প্রথম বাণিজ্যিক ট্রেন চলাচল শুরু করে। দেড় ঘণ্টার যাত্রাপথের ভাড়া তৃতীয় শ্রেণিতে ৭ আনা, দ্বিতীয় শ্রেণিতে ১ টাকা ২ আনা এবং প্রথম শ্রেণিতে ৩ টাকা। ২৭ আগস্ট ১৮৫৪ এই উদ্বোধনী ট্রেনযাত্রার যে বিবরণটি সম্বাদ ভাষ্কর ছেপেছিল তা বেশ কৌতূহলোদ্দীপক:
'লৌহবস্তু দিয়া বাষ্পীয় রকেট চলিতেছে। ইহাতে প্রতি দিবস হাওড়া শ্রীরামপুর ফরাসডাঙ্গা হুগলি এই চারিস্থানে লোকারণ্য হইতেছে লোকদের ভিড়ে টিকিট বিক্রয় গৃহে ক্রেতারা প্রবেশ করিতে পারেন না যাহারা ঠেলাঠেলি করিয়া অতিকষ্টে আগে যান তাহারাই প্রাপ্ত হন। তদ্ভিন্ন প্রতি দিবস প্রতি আড্ডা হইতে দুই আড়াইশত লোক ফিরিয়া যাইতেছেন ইহাতে রেলরোড কোম্পানিদিগের লাভের হানিও হইতেছে। ... এই ক্ষণে বাষ্পীয় শকটে গমনার্থে যত লোক উৎসাহিত হইয়াছেন তাহারদিগের গমনোপলক্ষে গাড়ি সকল প্রস্তুত হয় নাই অতএব তাহারদিগের সকলের গমনোপযুক্ত গাড়ি সকল শ্রীঘ্র প্রস্তুত হউক, যাহারা এই বিষয়ে লক্ষ্য করিতে উৎসুখ হইয়াছেন তাহারা অতি শীঘ্র অধিক গাড়ি প্রস্তুত করিলে দেখিতে পাইবেন প্রতিদিবস গাড়ি ভাড়ার টাকা রাখিবার স্থান পাইবেন না। (দীপঙ্কর গৌতমের 'বাংলা সাহিত্যে রেল' থেকে গৃহীত)
প্রথম দিনের যাত্রী রূপচাঁদ ঘোষ নামের ব্যবসায়ী এত কম সময়ে হুগলি পৌঁছে সন্দিহান হয়ে পড়েন সঠিক জায়গায় এসেছেন কিনা। তিনি অবাক হয়ে বিভিন্ন লোককে স্থানটির নাম জিজ্ঞেস করতে থাকেন। রাধালঙ্কার ব্যানার্জি নামের জ্যোতিষী রেলে চড়ার ঘোর কাটাতে হুগলি স্টেশনে নেমেই মন্ত্র জপতে শুরু করেন এবং নিজে থেকেই সিদ্ধান্ত নেন অগ্নিনির্ভর সর্বনাশা এই গাড়ি যাত্রীদের আয়ুক্ষয় করেই ছাড়বে। সুতরাং ফেরার সময় তিনি আর ট্রেনে চড়েননি।
লোহার সমান্তরাল লাইনের ওপর দিয়ে ট্রেন ছুটতে দেখে যাদের শৈশব স্মৃতিময় হয়ে উঠেছে, আমি তাদের একজন। হাতিরপুল দিয়ে কারওয়ান বাজার হয়ে রেল চলাচল যখন বন্ধ হলো, যারা দুঃখ পেয়েছে—আমি তাদেরও একজন। ১৯৮৮-এর মে মাসের প্রথম দিন কমলাপুর রেলস্টেশন চালু হয়ে যায়। এপ্রিলের শেষদিন ফুলবাড়িয়া থেকে যে ট্রেন শেষবারের মতো বেরিয়ে আসে, সেই ট্রেনও গার্ডের ছবি ছাপা হয়েছিল পরের দিন দৈনিকে, খুব মনে আছে।
ছবির নিচে লেখা ছিল, 'ফুলবাড়িয়ার শেষ ট্রেন শেষ গার্ড'। ভেতরের সংবাদে লেখা হয়েছিল: এই স্টেশন হইতে আর কোনোদিন ট্রেন ছাড়িবে না। ফুলবাড়িয়া কেবল স্মৃতি হইয়া থাকিবে।
একালের ফুলবাড়িয়াতে স্টেশনের সামান্য স্মৃতিচিহ্ন নেই। কেবল বইপত্রে দু-একটি ছবির দেখা মেলে।
রবীন্দ্রনাথের রেলগাড়ি
রবীন্দ্রনাথসহ তিনটি বালক একসাথে বড় হচ্ছিলেন, তাদের একজন সত্যপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায় (১৮৫৯-১৯৩৩), তার চেয়ে দুই বছরের বড় এবং বড়দি সৌদামিনীর পুত্র। বালক রবীন্দ্রনাথের হিমালয় যাত্রার আয়োজনের কথা শুনে বালক সত্য জানিয়েছেন: 'বিশেষ দক্ষতা না থাকিলে রেলগাড়িতে চড়া এক ভয়ঙ্কর সঙ্কট—পা ফসকাইয়া গেলেই তার রক্ষা নাই। তারপর গাড়ি যখন চলিতে আরম্ভ করে তখন শরীরের সমস্ত শক্তিকে আশ্রয় করিয়া বসা চাই, নহিলে এমন ভয়ানক ধাক্কা দেয় যে, মানুষ কোথায় ছিটকাইয়া পড়ে তাহার ঠিকানা পাওয়া যায় না। স্টেশনে পৌঁছিয়া মনের মধ্যে বেশ একটু ভয়ভয় করিতে ছিল, কিন্তু গাড়িতে এত সহজে উঠিলাম যে মনে সন্দেহ হইল এখনো হয়ত গাড়ি উঠার আসল অঙ্গটাই বাকি। তাহার পরে যখন অত্যন্ত সহজে গাড়ি ছাড়িয়া দিল তখন কোথাও বিপদের একটুও আভাস না পাইয়া মনটা বিমর্ষ হইয়া গেল।'
রবীন্দ্রনাথ তখন আর বালক নন। ১৯০৭ সালে রবীন্দ্রনাথের বয়স ৪৬ বছর। তারপুত্র শমীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বয়স ১১ বছর, পুত্র মুঙ্গের গুরুতর অসুস্থ। রবীন্দ্রনাথকে শিগগিরই পৌঁছাতে হবে। কিন্তু সে সময় কোনো প্যাসেঞ্জার ট্রেন নেই। ইস্ট ইন্ডিয়া রেল কর্তৃপক্ষ বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে। কিন্তু গুরুদেবকে যেতেই হবে। তারা রবীন্দ্রনাথকে মালগাড়িতে তুলে দিলেন। পরদিন পৌঁছলেন। শমীন্দ্রনাথ ব্যাধি কাটিয়া উঠতে পারেননি, তার মৃত্যু ঘটে।
১০৯ বছর আগে বাংলা সাহিত্যের একমাত্র নোবেল প্রাইজটি এসেছিল মূলত ব্রিটিশ রেলের সততার কল্যাণে। কেমন করে?
১৯১২ সালে ১৬ জুন সন্ধ্যায় রবীন্দ্রনাথ লন্ডন পৌঁছলেন, উঠলেন ব্লুমসবেরি হোটেলে। ছেলে রবীনও ছিলেন সাথে। 'পিতৃস্মৃতি থেকে রবীন্দ্রনাথের রচনার একটি অংশ উদ্ধৃত করেছেন রবীন্দ্র জীবনীকার প্রশান্তকুমার পাল: 'চেয়ারিং ক্রস স্টেশনে এসে জানা গেল টমাসকুক (ট্র্যাভেলিং এজেন্ট টমাস কুক অ্যান্ড সন্স) আমাদের জন্য ব্লুমসবেরি অঞ্চলে একটি হোটেলের কয়েকটি কামরা ভাড়া করে রেখেছেন। স্টেশন থেকে টিউব রেলযোগে আমরা ব্লুমসবেরি অভিমুখে রওয়ানা দিলাম। মাটির তলায় সুড়ঙ্গ রেলপথে এই আমার প্রথম অভিযান। নতুন অভিজ্ঞতার জন্যই হোক কিংবা অত্যধিক দায়িত্বভারের জন্যই হোক—আমি নিজের হাতে অতি সন্তর্পণে বাবার যে অ্যাটাচি কেসটি বহন করে আনছিলাম, টিউব থেকে নামবার মুখে সেইটিই নামাতে ভুলে গেলাম। এই অ্যাটাচির মধ্যেই বাবার ইংরেজি অনুবাদের পাণ্ডুলিপি ও আরও অনেক সব দরকারি কাগজপত্র ছিল।
পরদিন নিশ্চিন্ত রবীন্দ্রনাথ চিঠি লিখে দ্বিজেন্দ্রনাথ মৈত্রকে লিখলেন যে তিনি স্বভাবত হোটেলচারী জীব নন; কাজেই অন্য কোনো স্বাস্থ্যকর জায়গায় ঠাঁই নিতে হবে। 'আপাতত এখানকার পাতালপুরীর নলের ভিতর দিয়া একবার রাদেস্টাইন সাহেবের সন্ধানে বাহির হইয়া পড়িব।'
রথীন্দ্রনাথ থেকে উদ্ধৃতি, 'পরের দিন বাবা যখন রটেনস্টাইনের বাড়ি যাবেন, অ্যাটাচির খোঁজ পড়ল, আর তখনই বোঝা গেল সেটি টিউবে ফেলে আসা হয়েছে। আমার অবস্থা অনুমেয়; শুকনো মুখে আমি চলে গেলাম টিউব রেলে লষ্ট প্রপার্টি অফিসে। সেখানে যেতে প্রায় সঙ্গে হারানো ধন ফেরত পাওয়ার পর আমার প্রাণে যে কী গভীর স্বস্তি হয়েছিল, সে আমি কখনো ভুলবো না।'
গীতাঞ্জলীর এই পাণ্ডুলিপির ওপর ভিত্তি করেই ডব্লিউ বি ইয়েটস দীর্ঘ ভূমিকা লিখেছেন, বিলেতে রবীন্দ্রনাথের অনূদিত কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। কবি টি স্টার্জমুর নোবেল পুরস্কারের জন্য রবীন্দ্রনাথের নাম প্রস্তাব করেছেন এবং ব্রিটিশ নাগরিক হিসেবে রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন।
এই পাণ্ডুলিপি পাতাল রেলওয়ে থেকে ফেরত না পেলে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তি পিছিয়ে যেতে পারত, আর পিছিয়ে গেলে হয়তো রবীন্দ্রনাথ বাদই পড়ে যেতেন।
রেলগাড়িতে পাণ্ডুলিপি হারানোর যাতনা ভোগ করতে হয়েছে তরুণ আর্নেস্ট হেমিংওয়েকে, রবীন্দ্রনাথকে নয়। হেমিংওয়ের প্রথম স্ত্রী এলিজাবেথ হেডলি রিচার্ডসন প্যারিস থেকে সুইজারল্যান্ড যাবার সময় স্বামীর সমস্ত লেখালেখি, কার্বন অনুলিপি, কার্বন কাগজ সবই স্যুটকেসে ভরে রওয়ানা হন। ট্রেন থেকে পুরো স্যুটকেসই নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। পরবর্তী প্রায় শতবছরে সেই স্যুটকেসের হদিস মেলেনি। হেমিংওয়ে স্ত্রীর ওপর ভীষণ ক্ষিপ্ত ছিলেন দীর্ঘ সময়।
নোবেল পুরস্কার বিজয়ী রবীন্দ্রনাথকে অভিনন্দন, জানাতে গাঁটের পয়সা খরচ করে বাংলার ৫০০ সম্মানিত ব্যক্তি স্পেশাল ট্রেন ভাড়া করে বোলপুর এসেছিলেন। এই বুদ্ধিজীবীদের কেউ কেউ একদা রবীন্দ্রনাথকে যথেষ্ট উপেক্ষা করেছেন। সুতরাং তাদের অভিনন্দন রবীন্দ্রনাথের কাছে অমৃতবৎ মনে হয়নি, মনে হয়েছে হলাহল তুল্য, কাজেই তাদের দেওয়া সম্মান গ্রহণ ওষ্ঠে বিষের পেয়ালা ছোঁয়ানোর মতোই হবে। এ কথা সম্মানের জবাবে দেওয়া ভাষণে উল্লেখ করায় বুদ্ধিজীবীরা ক্ষুব্ধ হন, তাদের জন্য পরিবেশন করা মিষ্টি ও কমলা না খেয়ে ট্রেনে এসে বাকিদের অপেক্ষায় বসেছিলেন। পরে শান্তিনিকেতনের পরিচারক খাবারগুলো ট্রেনে দিয়ে যান।
রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিজীবনে এবং তার গল্পেরও উপন্যাসের কোনো কোনো পাত্র-পাত্রীর জীবনে অনেক রেলভ্রমণ ঘটেছে।
অপু ট্রিলজির রেলগাড়ি
বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের আরণ্যক রেলের নাম পেয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ ও ঝাড়খণ্ড সংযোজকে প্রতিদিন আসাযাওয়ায় ৬২২ কিলোমিটার দীর্ঘ পথ পেরোনো আরণ্যক এক্সপ্রেস। সত্যজিত রায়ের হাতে যখন অপু আর দুর্গা সিনেমায় উঠে এল, বিভূতিভূষণের উপন্যাসে যোগ হলো নতুন মাত্রা। মৃত্যুর আগে দুর্গা বলল, অপু, সেরে গেলে একদিন আমায় রেলগাড়ি দেখাবি?
অপু যেদিন প্রথম রেলগাড়িতে চড়ল, দিদির না মেটা সেই সাধের কথাই তার মনে হলো।
বনফুলের 'হাটে বাজারে' উপন্যাসের নামে চালু হয়েছে ১৯৯৯ সালে ইন্ডিয়ান ইস্টার্ন রেলওয়ের ব্যবস্থাপনায় হাটে বাজারে এক্সপ্রেস। ৫৯৬ কিলোমিটার পথের এই ভ্রমণে সময় লাগে ১৭ ঘণ্টা ১০ মিনিট। ট্রেনটি শিয়ালদহ থেকে বিহার আপ-ডাউন করে থাকে।
গণদেবতা এক্সপ্রেস
১৯৪২ সালে প্রকাশিত এবং ১৯৬৬ জ্ঞানপীঠ পুরস্কারপ্রাপ্ত তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের উপন্যাস 'গণদেবতা'র নামে চালু হয়েছে ২৮০ কিলোমিটার রেলপথের গণদেবতা এক্সপ্রেস। ইস্টার্ন রেলওয়ের ব্যবস্থাপনায় হাওড়া থেকে মুর্শিদাবাদের আজিমগঞ্জ জংশন পর্যন্ত ৭ ঘণ্টার এই এক্সপ্রেস ট্রেন প্রতিদিনই চালু থাকছে। ট্রেনটি বর্ধমান, বোলপুর, শান্তিনিকেতন, আহমেদপুর নহাটি হয়ে আজিমগঞ্জ যায়।
কাইফিয়াত এক্সপ্রেস
উর্দু কবি কাইফি আজমিকে (১৯১৯-২০০২) সম্মান জানাতে ইন্ডিয়ান রেলওয়ে চালু করেছে প্রতিদিনের সুপারফাস্ট এক্সপ্রেস ট্রেন কাইফিয়াত। উত্তর প্রদেশের আজমগড় এবং পুরোনো দিল্লির মধ্যে এই ট্রেনটি ২০০৩ সালে নর্দার্ন রেলওয়ের ব্যবস্থাপনায় চালু হয়। দুই প্রান্তের দূরত্ব ৮০৩ কিলোমিটার। ভ্রমণের সময় ১৪ ঘণ্টা ২০ মিনিট।
তুতারি এক্সপ্রেস, গোদানু এক্সপ্রেস
২০১১ সালে মারাঠি কবি কেশব ডামলের তুতারি নামের কবিতাটি ব্যবহার করে মহারাষ্ট্রের এই রেলওয়ে চালু হয়েছে। মুম্বাই থেকে সন্তবাদী ৪৯৮ কিলোমিটার পথ নিত্যদিন এই এ্রক্সপ্রেস ট্রেন চলে কৃষ্ণজি কেশব ভামলে (১৮৬৬-১৯৯৫) অন্যতম প্রধান মারাঠি কবি। মুন্সি প্রেমচাঁদের উপন্যাস গোদান তিন রাজ্যের মধ্যে চলাচলকারী ট্রেনের নাম পেয়েছে। রাজ্য তিনটি উত্তর প্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ এবং মহারাষ্ট্র। দুপ্রান্তের দুই স্টেশন হচ্ছে মুম্বাইয়ে লোকমান্য তিলক টার্মিনাস এবং গোরকপুর জংশন। দূরত্ব ১৭৩৩ কিলোমিটার।
হাওড়া বোলপুর কবিগুরু এক্সপ্রেস
ইন্ডিয়ান ইস্টার্ন রেলওয়ে ১৩ নভেম্বর ২০১৯ থেকে ১৫৯ কিলোমিটার দূরত্ব পাড়ি দেবার একটি এক্সপ্রেস ট্রেন চালু করে। হাওড়া থেকে বোলপুর এবং বোলপুর থেকে হাওড়া প্রত্যাবর্তন প্রতিদিনই। ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১১০ কিলোমিটার গতির এই ট্রেনে স্বাভাবিক সময়ে পৌঁছতে সময় লাগে ৩ ঘণ্টা ৫ মিনিট। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে সম্মান জানাতেই এই ট্রেনের নাম রাখা হয়েছে কবিগুরু এক্সপ্রেস। যারা কবিগুরু এক্সপ্রেসে চড়েন, তাদের কি মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিণত বয়সে লেখা রেলগাড়ির কামরায় হঠাৎ দেখা কবিতার কিছু পঙ্ক্তি:
রেলগাড়ির কামরায় হঠাৎ দেখা
ভাবিনি সম্ভব হবে কোনদিন...
হঠাৎ খবরের কাগজ ফেলে দিয়ে
আমাকে করলে নমস্কার
সমাজবিধির পথ গেল খুলে:
আলাপ করলাম শুরু—
কেমন আছে, কেমন চলছে সংসার।...
বাইরের আকাশের দিকে তাকিয়ে শুধোল
'আমাদের গেছে যে দিন
একেবারেইকি গেছে-
কিছুই কি নেই বাকি?'
কবি জবাব দিলেন রাতের সব তারাই আছে। দিনের আলোর গভীরে। তারপর যা হবার—ট্রেন থেকে সবাই নেমে গেল পরের স্টেশনে। কবি রয়ে গেলেন চলমান ট্রেনে একাই।
ফিকশনের ট্রেন সিনেমার ট্রেন
রেলযুগের প্রথম দিককার গল্প-উপন্যাস লেখকদের অন্যতম চার্লস ডিকেন্স। পিকউইক পেপার্সে রেলওয়ে এসেছে কিন্তু ডিকেন্স বলছেন সত্যিকারের ভালোবাসা স্টেজকোচে। তলস্তয়ের আনা কারেনিনার শুরুতে রেলস্টেশন, রেলগাড়ি এবং হাতের ব্যাগ ছুড়ে দিয়ে ট্রেনের নিচে ঝাঁপিয়ে পড়ে তার নায়িকা। ডিকেন্সের ট্রেন ভালো না বাসার কারণ তখনকার ট্রেনের শ্লথগতি; তিনি এক্সপ্রেস ট্রেন পাননি। রেলযুগে একই সাথে যোগ হলো রেলগাড়িতে পড়ার মতো বই সাথে নেওয়া। মার্ডার অ্যাট ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস (১৯৩৪ সালে প্রকাশিত) লিখে রেল ভ্রমণ শিহরণ এনে দিলেন আগাথা ক্রিস্টি। ফিকশনভিত্তিক শত শত সিনেমার নাম উল্লেখ করা যাবে। কয়েকটি উল্লেখ করা হচ্ছে: ব্রিফ এনকাউন্টার (১৯৪৫) রেলস্টেশনে রোম্যান্স; এম্পায়ার অব দ্য নর্থ পোল (১৯৭৩), ব্রিজ অন দ্য বিভার কাওয়াই (১৯৫৭), দ্য গ্রেট ট্রেন রবারি (১৯০৩ নির্বাক ছবি), ক্যাসান্ড্রা ক্রসিং (১৯৭৬), টেরর বাই নাইট (১৯৪৬), শার্লক হোমস মুভি, দ্য ট্রেইন (১৯৬৪), কায়রো স্টেশন (১৯৫৮), দার্জিলিং লিমিটেড (২০০৭), ডেথ লাইন (১৯৭২), দ্য ফার্স্ট গ্রেট ট্রেন রবারি, ফ্রম রাশিয়া উইথ লাভ, দ্য বার্নিং ট্রেইন (১৯৮০), নর্থ বাই নর্থওয়েস্ট (১৯৫৯, আলফ্রেড হিচককের থ্রিলার), দ্য পোলার এক্সপ্রেস; স্ট্রেঞ্জার্স অন অ্য ট্রেইন (১৯৫১), অ্যাটমিক ট্রেন (১৯৯৯)। হ্যারি পটারভক্তদের জন্য রয়েছে হগওয়ার্থ এক্সপ্রেস ট্রেন।
আমাদের আচ্ছন্ন করে রেখেছে স্কুলপাঠ্য আর এল স্টিভেনশনের সেই কবিতা: ফ্রম আ রেলওয়ে ক্যারেজ:
ফাস্টার দ্যান ফেয়ারিস, ফাস্টার দ্যান উইচেস
ব্রিজেস অ্যান্ড হাউসেস, হেজেজ অ্যান্ড ডিচেস
সেই সাথে ফিরে আসে বিভূতিভ'ষনের অপুর প্রশ্ন: তুই রেলের রাস্তা কোথায়, জানিস?
দুর্গা জানিয়ে দেয়: ওই তো সোনাডাঙ্গার মাঠ, তারপর ধানখেত তারপর রেলের রাস্তা।
বাসন্তী গুহঠাকুরতার ফতুল্লার রেলগাড়ি
স্বল্পালোচিত কিন্তু নগর ও নাগরিক জীবন গড়ে ওঠার অত্যন্ত বিশ্বস্ত একটি দলিল বাসন্তী গুহঠাকুরতার 'কালের ভেলায়'।
উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়েও ঢাকার পাকা রাস্তার দৈর্ঘ্য ২২ মাইলের একাংশ ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রোড, একাংশ ঢাকা-টঙ্গী। নারায়ণগঞ্জ ঢাকারই অংশ, জেলার আওতায় মহকুমা। বিক্রমপুর পরগনার বাসন্তীর পরিবার পদ্মার ভাঙনে বাস্তুচ্যুত হয়ে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় আশ্রয় নেন। ফতুল্লায় তাঁর স্বজনদের জমির ওপর দিয়ে চলে গেছে সমান্তরাল রেললাইন, মাথার ওপর দাঁড়িয়ে আছে টেলিগ্রামের খুঁটি, দুই স্টেশন মাস্টারের কথা চালাচালির জন্য টেলিগ্রামের তার। যখন ফতুল্লার বুকের ওপর দিয়ে ট্রেন যায়, ছেলেবুড়ো সব সাগ্রহে লাইনের কাছাকাছি ছুটে আসে। কিন্তু ট্রেন থামে না। গাঁয়ের মুরব্বিরা আবেদন করলেন, স্টেশন চাই, রেলওয়ে জবাব দিল ফতুল্লাতে আয়ের কোনো পথ নেই। তার পরও চাপের মুখে এক মাস পরীক্ষামূলকভাবে ট্রেন থামার আদেশ জারি হলো, যদি টিকিট বিক্রি সন্তোষজনক হয়, তখন বিবেচনা করা হবে। এটাকে সবাই চ্যলেঞ্জ হিসেবে নিলেন। বাসন্তীর বাবা পাড়ার ছেলেদের ধরে ধরে ১ টাকা করে দিতেন, যা ট্রেনে ঢাকা থেকে ঘুরে আয়। স্টেশনটি যে গুরুত্বপূর্ণ, তা প্রমাণের জন্য অন্যরাও অকারণে টিকিট কিনে ঢাকা থেকে ঘুরে এসেছে। এভাবেই একসময় স্থায়ী ফতুল্লা স্টেশন হলো।
১৯৩১-এর আশ্বিনের মাঝামাঝি সময়ের একটি ঘটনা: ''সন্ধ্যার পর সাড়ে ৬টার ট্রেনটা বোধ হয় গেন্ডারিয়া থেকে ফতুল্লা আসছে। পাগলার কাছে আসতেই একটা আলোর জ্যোতি ছড়িয়ে যাচ্ছে। আমার ঠাকুমা ভয় পেয়ে বাড়ির ভেতরে এসে বলছেন, 'দ্যাখ দ্যাখ মাটিতে কী রকম আলো ছড়িয়ে গেল। একবার তো আকাশে ধূমকেতুর আলো দেখেছিলাম কয়েক দিন ধরে। মাটিতে তো দেখিনি।' বলতে বলতে পাড়ার ছোট-বড় ও পাড়ায় চন্দবাড়ির বোসেদের রায়তবাড়ির সবাই রেললাইনের ধারে এসে দাঁড়িয়ে গেল। আলো ক্রমেই ছড়িয়ে লাইনের দুধারের মাঠে পড়ল। তখন বোঝা গেল এটা ট্রেনের নতুন বাতি-সার্চ লাইট, যেমন স্টীমারে থাকে আর বর্ষার স্টীমার ঘুরলে আমাদের বাড়ির দোতলার বারান্দা আলোকিত হয়। এই আলোটা স্টেশনে এলে দিনের মতো আলো হয়ে গেল। তখন কোয়ার্টার থেকে স্টেশন মাস্টার বললেন, 'এটা সার্চ লাইট, রাতে যাতে কেউ কাটা না পড়ে কোনো রকম দুর্ঘটনা না ঘটে।''
অলৌকিক এই আলোর টানে ট্রেনের শব্দ কানে এলেই তিনি স্টেশনে ছুটতেন, আর ছিল রহস্যময় ছায়া। ট্রেন থামলে ছায়া থেমে যায়, ট্রেন চললে ছায়া চলে। ট্রেনের গতি বাড়লে ছায়াগুলোও দৌড়ে চলে, আলো-ছায়ার এই সিনেমা বালিকাকে মুগ্ধ করত। নারায়নগঞ্জ-চাষাড়া-ফতুল্লা-গেন্ডারিয়া-ফুলবাড়িয়া এই লাইনের রেলগাড়ি শুরুটা ১৮৮৫-র ৪ জানুয়ারি।
ভানু বন্দোপাধ্যায়ের নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা এক্সপ্রেস ট্রেন
কলকাতার গুলবাজ বললেন, বর্ধমান থেকে দ্রুতগামী ট্রেনটা যখন কলকাতা হাওড়া স্টেশনে আসছিল, গতি এত বেশি ছিল যে মাইলপোস্টগুলোকে মনে হয়েছে ঠিক চিরুনির দাঁত।
ঢাকার ভানু মোটের ওপর বাঙ্গাল, সহজে ছাড়ার লোক নন। তিনি দ্রুতগামী নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা ট্রেনের কথা বললেন। জেঙ্কিন্স সাহেব নারায়ণগঞ্জ স্টেশনে ট্রেনে উঠে ইংরেজের প্রথা অনুযায়ী স্ত্রীকে বিদায় চুম্বন দিলেন। কিন্তু ট্রেনটা এতই দ্রুতগামী ছিল যে চুমোটা গিয়ে পড়ল ঢাকা রেলস্টেশনে অপেক্ষমাণ ইসমাইলের গালে।
কিন্তু ইসমাইলটা কে?
ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেটের চাপরাশি।
জেঙ্কিস সাহেব ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেটের সাথে সাক্ষাৎ করতেই এসেছেন। তাকে রিসিভ করতে চাপরাশি ইসমাইল স্টেশনে অপেক্ষা করছিল। বলাই বাহুল্য ভানু বন্দোপাধ্যায়ের ঢাকার ট্রেনই জিতে গেল।
- পাদটীকা:
রেলওয়ের নিজস্ব শব্দ 'শান্টিং'-এর আজকাল ঢালাও ব্যবহার হচ্ছে। যেমন এমপি সাহেব কলেজের প্রিন্সিপালকে হেভি শান্টিং দিয়েছেন। ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশনে এই শব্দটি প্রথম শুনেছিলাম ৫৫ বছর আগে। ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশন নেই, শান্টিং ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে।