হন্যে হয়ে পাইলট খুঁজছে বিমান সংস্থাগুলো
বিমান পরিবহন খাতে তীব্র পাইলট সংকট ও বিশ্বব্যাপী বাড়তে থাকা ভ্রমণ চাহিদার কারণে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নিজস্ব পাইলট নিয়োগের সবচেয়ে সহজ ও সুনিশ্চিত পথ বেছে নিয়েছে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স।
সম্প্রতি দেশের বৃহত্তম বেসরকারি এই এয়ারলাইনস ২৩ জন ক্যাডেট পাইলটকে ফার্স্ট অফিসার হিসেবে দেশের বাইরে প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য নির্বাচিত করা হয়েছে। প্রত্যেকের পেছনে ৬০ হাজার থেকে ৭০ হাজার মার্কিন ডলার ব্যয় করবে প্রতিষ্ঠানটি। সাধারণত ফ্লাইং লাইসেন্স পেতে পাইলটদের নিজেদেরই প্রশিক্ষণের ব্যয়ভার বহন করতে হয়।
মহামারির পর ফ্লাইট সংখ্যা বাড়তে থাকায় গুরুতর পাইলট সংকট দেখা দেয়। পাইলট অ্যাসোসিয়েশনের মতে, একই সময় দায়িত্বরত পাইলটরাও অতিরিক্ত কাজের চাপ নিয়ে অভিযোগের পাশাপাশি নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগের কথা জানান।
দেশে পাইলটদের প্রশিক্ষণের জন্য তিনটি ফ্লাইং স্কুল ও ক্লাব থাকলেও এরমধ্যে দুটি বন্ধ হয়ে গেছে। বিমান পরিবহন খাতে বছরে ৫০ জন পাইলটের চাহিদা থাকলেও চালু থাকা একমাত্র ফ্লাইং স্কুলটি থেকে প্রতিবছর মাত্র ৮ থেকে ১০ জন প্রশিক্ষিত পাইলট বের হয়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলাদেশ ফ্লাইং একাডেমি এবং আরিরাঙ ফ্লাইং স্কুল দুটো এখন বন্ধ আছে। অন্যদিকে গ্যালাক্সি ফ্লাইং একাডেমির পাইলট তৈরির যথাযথ সক্ষমতা নেই।
এই অবস্থায় ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট পরিচালনার জন্য ফার্স্ট অফিসার তৈরি করতে একটি ফ্লাইট স্কুল স্থাপনের পরিকল্পনা করছে বলে জানান প্রতিষ্ঠানটির সিইও ক্যাপ্টেন লুৎফর রহমান। তবে বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (সিএএবি)-র সঙ্গে স্কুল স্থাপনের সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে সময় লাগবে বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, বড় সমস্যা হলো তিন ফ্লাইট স্কুলের মধ্যে দুটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় গত দুই বছরে খুব কম পাইলট বাণিজ্যিক ফ্লাইট পরিচালনার লাইসেন্স পেয়েছেন।
ক্যাপ্টেন লুৎফর আরও বলেন, ইউএস-বাংলার ব্যবসা সম্প্রসারণের পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২৩ থেকে ২০২৬ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর ২০ থেকে ৩০ জন পাইলট প্রয়োজন হবে। এয়ারলাইনটি শিগগিরই আরও বিমান যুক্ত করার পরিকল্পনা করছে। আর তাই চাহিদা পূরণে পাইলটদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।
এদিকে গ্যালাক্সির কাছে মাত্র তিনটি বিমান রয়েছে। তবে তারা আরও বিমান আনার চেষ্টা করছে কারণ প্রশিক্ষণের জন্য ইতোমধ্যে ২০০ জন শিক্ষার্থী নাম লিখিয়েছেন।
জাতীয় বিমান সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সেরও পাইলট সংকট কাটিয়ে উঠতে হিমশিম খাচ্ছে।
বৃহৎ ও সর্বাধুনিক সব বিমান থাকা সত্ত্বেও পাইলট স্বল্পতার কারণে সংস্থাটি বিমানগুলো ব্যবহার করতে পারছে না। বোয়িং ৭৮৭ বিমান পরিচালনার জন্য আরও ২০ জন পাইলটের প্রয়োজন।
এদিকে ঘাটতির বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স পাইলটস অ্যাসোসিয়েশন (বাপা) সম্প্রতি বিমান ব্যবস্থাপনা কমিটিকে দেওয়া এক চিঠিতে জানায়, অতিরিক্ত কাজ পাইলটদের চাপে ফেলেছে এবং তারা মানসিক ও শারীরিকভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।
এমনকি নির্ধারিত সীমার বাইরেও তাদের বাড়তি ফ্লাইট পরিচালনা করতে হয়। কর্মঘণ্টা কমবেশি হলেও সব এয়ারলাইন্সই পাইলটদের কাজের সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণে একমত।
নিরাপত্তা উদ্বেগ প্রকাশ করে অ্যাসোসিয়েশন জানায়, অতিরিক্ত দায়িত্বপালনের কারণে বিমান চলাচলে নিরাপত্তার বিষয়টি অবহেলিত হচ্ছে যার ফলে সংস্থাগুলোর বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি রয়েছে।
এ অবস্থায় বিমান বেশি বেতনে বিদেশি পাইলট নিয়োগের উদ্যোগ নেয়।
বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. জাহিদ হোসেন বলেন, পাইলট স্বল্পতার কারণে তারা বোয়িং ৭৮৭ বিমান সক্ষমতা অনুযায়ী ব্যবহার করতে পারছে না। একটি বোয়িং ৭৮৭ প্রতিদিন ১৪ থেকে থেকে ১৫ ঘণ্টা চলতে পারলেও যখন বিমান এটি ১১ থেকে ১২ ঘণ্টা ধরে পরিচালনা করছে।
তিনি বলেন, ফ্লাইট ফ্রিকোয়েন্সি বৃদ্ধির কারণে পাইলটরা চাপের মধ্যে রয়েছেন, তবে বিমান কর্মঘণ্টা সংক্রান্ত কোনো নিয়ম লঙ্ঘন করছে না।
'আমরা বাংলাদেশের একমাত্র এয়ারলাইন যারা যথাযথভাবে নিরাপত্তা ব্যবস্থা বজায় রাখার কারণে ইন্টারন্যাশনাল এভিয়েশন সেফটি অ্যাসেসমেন্ট (আইএএসএ)-র সনদ পেয়েছি', বলেন তিনি।
তিনি বর্তমানে কর্মরতদের ওপর চাপ কমাতে তারা নতুন পাইলট নিয়োগের চেষ্টা করছেন।
এমডি জানান, বিমান স্থানীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে বোয়িং ৭৮৭-এর জন্য ১৮ জন পাইলট নিয়োগের জন্য আবেদন করেছে।
জুলাই থেকে মাত্র তিন মাসে বিমান ৮ লাখ যাত্রী পরিবহন করেছে, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় চার গুণ বেশি বলে জানিয়েছে সংস্থাটি।
বিমানের গুরুতর পাইলট সংকট
সূত্র জানায়, গত ২০ অক্টোবর কক্সবাজার থেকে ঢাকায় ফেরার পথে ফ্লাইটে অজ্ঞান হয়ে পড়েন এক নারী ক্রু সদস্য। অতিরিক্ত কাজের কারণে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে বলে জানা গেছে।
হজ ফ্লাইট নির্বিঘ্নে পরিচালনার জন্য ঘাটতিকালে ছুটি, সাপ্তাহিক ছুটি ও অন্যান্য ব্যক্তিগত বিষয়াদি উপেক্ষা করে কাজ করে যাওয়ায় পাইলটদের আত্মচেষ্টার উল্লেখ করে গত ১০ অক্টোবর বাপা বলে, 'হজ ফ্লাইট আগেই শেষ হয়ে গেছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এখনও ফ্লাইটের সময়সূচির কোনো উন্নতি হয়নি। ফ্লাইট টাইম লিমিটেশন (এফটিএল) সম্পর্কিত সিভিল অ্যাভিয়েশন ডিরেক্টিভ (সিএডি) নিয়মিত লঙ্ঘন, অতিরিক্ত সময় ধরে দায়িত্বপালন, ছুটি বা বন্ধ না পাওয়া এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মাসিক রোস্টার না থাকা ইত্যাদি সমস্যাগুলো এখনও চলমান। অথচ সমস্যাগুলো কমানোর কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ছে না।'
'এর ফলে ক্রুরা ক্লান্ত, মানসিক ও শারীরিকভাবে তারা অবসাদগ্রস্তত। আমাদের পারিবারিক এবং সামাজিক জীবন ব্যাপকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো সবাই বিমান চলাকালীন নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে অবহেলা করছে'।
বাপা আরও জানায়, বিমান নিয়মিত পাইলট ইউটিলাইজেশন কমিটির (পিইউসি) সভা করছে না।
বাপার তথ্যমতে, প্রতিমাসে বিশেষ করে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে পিইউসি সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা।
'পিইউসি মিটিংয়ে আমরা ফ্লাইং ঘন্টা, ফ্লাইং সেক্টর, ফ্লাইট ডিউটি, ডে অফ, ছুটি, অসুস্থ থাকাকালীন ছুটি ইত্যাদি ঠিকঠাকমতো ভাগ-বাটোয়ারা করে নিতে পারি। নিয়মিতভাবে এই মিটিং হলে অসঙ্গতিগুলো দূর করে আমরা স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনতে পারি,' জানায় বাপা।
এই বিষয়ে বিমানের ফ্লাইট অপারেশন ডিরেক্টর ক্যাপ্টেন মো. সিদ্দিকুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, পাইলটদের শিডিউলের কারণে তারা মিটিং করতে পারেননি। নিজে ফ্লাইট ডিরেক্টর হওয়া সত্ত্বেও তিনি পাইলট স্বল্পতার কারণে ফ্লাইট পরিচালনা করছেন বলেও জানান।
পাইলট স্বল্পতার বিষয়ে জানতে চাইলে, সিএএবি-র চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম মফিদুর রহমান বলেন, ফ্লাইট স্কুল ও ক্লাবগুলোর কার্যক্রম বন্ধ থাকায় পাইলট সংকট তৈরি করছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ ফ্লাইং একাডেমিকে পাইলট প্রশিক্ষণের জন্য সরকার আগে ভর্তুকি দিলেও এখন না দেওয়ায় তা বন্ধ রয়েছে।
সিএএবি একাডেমি পরিচালনার জন্য একটি কমিটি গঠন করলেও তা যথাযথ ছিল না। ফলে ভর্তুকি বন্ধ হয়ে যায়।
তিনি বলেন, পাইলট প্রশিক্ষণ অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং পাইলট তৈরি করা সিএএবি-র দায়িত্ব নয়। সিএএবি বড়জোর নীতি সহায়তা প্রদান করতে পারে। উচ্চ ঝুঁকি থাকার পাশাপাশি ব্যয়বহুল হওয়ায় বেসরকারি খাতের ফ্লাইট স্কুলের সংখ্যা বাড়েনি বলেও জানান তিনি।
তবে ইউএস-বাংলা এবং বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর অধীনে পাইলট প্রশিক্ষণ স্কুল প্রতিষ্ঠা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে, যা ঘাটতি পূরণে সাহায্য করবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।