কোরিয়া যুদ্ধ আসলে কখনোই শেষ হয়নি! কেন?
২৫ জুন, ১৯৫০; দক্ষিণ কোরিয়া ওপর আচমকা আক্রমণ করে বসে উত্তর কোরিয়া। কোরিয়া উপদ্বীপের নিয়ন্ত্রণ নিতে পুঁজিবাদীদের (ক্যাপিটালিস্ট) ওপর সমাজতন্ত্রীদের (কমিউনিস্ট) সেই আক্রমণই ইতিহাসে কোরিয়া যুদ্ধ নামে পরিচিত। ১৯৫০ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত ৩ বছরব্যাপী যুদ্ধে মারা যায় কয়েক লাখ মানুষ, স্থায়ীভাবে বিভক্ত হয়ে পড়ে উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া।
তবে যুক্তরাষ্ট্রে দুই কোরিয়ার এই সংঘাতকে এখন 'ফরগটেন ওয়ার' (যে যুদ্ধের কথা ভুলে গেছে মানুষ) হিসেবে অভিহিত করা হয়। এর প্রধান কারণ হল, যুদ্ধের শুরুতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এটি যে পরিমাণ মনযোগ আকর্ষণ করতে পেরেছিল, তা সময়ের সঙ্গে ধীরে ধীরে কমে যেতে থাকে। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, কোরিয়া যুদ্ধের 'লিগ্যাসি' বা সময়ের গভীরতা ব্যাপক। আজ সাত দশক পরে এসেও দুই কোরিয়ার এই দ্বন্দ্ব বিশ্ব অঙ্গনে একেবারে স্পষ্ট। প্রায়ই দুই দেশের মধ্যে ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা দেখা যায়। এমনকি আজও (২ নভেম্বর, ২০২২) দক্ষিণ কোরিয়ার দিকে অন্তত ১০টি মিসাইল ছুঁড়েছে উত্তর কোরিয়া। এরমধ্যে একটি দক্ষিণ কোরিয়ার জল সীমানার একেবারে কাছাকাছি এসে পড়েছে।
উত্তর কোরিয়ার এমন আক্রমণাত্বক মনোভাব নতুন নয়। বলতে গেলে, পঞ্চাশের দশকের সেই কোরিয়া যুদ্ধ শেষ হয়নি এখনও। কংগ্রেসের সম্মতি ছাড়াই আমেরিকার প্রেসিডেন্টদের যুদ্ধ করার এক নজির স্থাপন করেছে কোরিয়া উপদ্বীপের এই যুদ্ধ, এমনটিই মত বিশ্লেষকদের।
কীভাবে ৭২ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলে আসছে এই সংঘাত তা জানতে হলে ফিরে যেতে হবে দ্বন্দ্বের মূলে। ১৯১০ থেকে ১৯৪৫ সালের ভিতরে জাপানের কোরিয়া দখলের মধ্যেই লুকিয়ে আছে এই যুদ্ধের মূল শিকড়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে যখন মিত্রশক্তি জাপানের সাম্রাজ্য ভাঙতে শুরু করলো, তখন দেশটির অধীনে থাকা কোরিয়া উপদ্বীপ হয়ে পড়লো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তৎকালীন ইউএসএসআর (বর্তমান রাশিয়া)-এর মধ্যে দর কষাকষির বিষয়। সাবেক মিত্রশক্তির প্রত্যেকেই প্রত্যেককে অবিশ্বাস করতে শুরু করলো। এরই ফলশ্রুতিতে ১৯৪৮ সালে ৩৮তম অক্ষরেক্ষায় সীমানা চিহ্নিত করে কোরিয়া উপদ্বীপকে ভাগ করে দেওয়া হলো। জন্ম হলো যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত পুঁজিবাদী দক্ষিণ এবং ইউএসএসআর সমর্থিত কমিউনিস্ট উত্তর কোরিয়ার। উত্তর কোরিয়ার নেতৃত্বে আসলেন কিম ইল-সাং এবং যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে দক্ষিণ কোরিয়ার ক্ষমতায় বসলেন সিংম্যান রী।
আশা ছিল, বিভক্তির পর পূর্ব এশিয়ায় ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা হবে; শান্তিতে থাকবে দুই কোরিয়ার সাধারণ মানুষ। তবে দ্রুতই সেই ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো। কারণ দুই কোরিয়ার কেউই কাউকে আজ পর্যন্ত বৈধ হিসেবে গ্রহণ করতে পারেনি। একের পর এক সীমান্ত সংঘর্ষের পর, ১৯৫০ সালে শেষমেশ প্রতিবেশীকে আক্রমণ করে বসে উত্তর কোরিয়া। এই আক্রমণের ফলে দুই পারমাণবিক শক্তি, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউএসএসআরের মধ্যে শুরু হয় প্রক্সি যুদ্ধ। এই যুদ্ধকেই স্নায়ুযুদ্ধের প্রথম 'আগুন' বলে থাকেন বিশেষজ্ঞরা।
দক্ষিণ কোরিয়াকে সাহায্যে শক্তি প্রয়োগের অনুমোদন দিতে তখন নবগঠিত জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদকে চাপ দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। কারণ তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান কংগ্রেসের অনুমোদন না নিয়েই সৈন্য পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সেখানে। এর মাধ্যমে প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা ছাড়াই কোনো বড় আকারের বিদেশি সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে যুক্তরাষ্ট্র।
মার্কিনীদের ধারণা ছিল, দ্রুতই তারা জয়ী হবে, কিন্তু সে ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো শীঘ্রই। সংঘাতের শুরুর দিকেই উত্তর কোরিয়ার প্রায় ৩ মিলিয়ন সৈন্যের কাছে হিমশিম খেতে থাকে জাতিসংঘের বাহিনী। ইতোমধ্যেই ইউএএসআর এবং চীন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় উত্তর কোরিয়ায়। সৈন্য পাঠানো থেকে শুরু করে, তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা এবং সামরিক সরঞ্জাম দিতে শুরু করে।
১৯৫১ সালের গ্রীষ্মে, উভয় দিকের সেনারা ৩৮তম অক্ষরেখার কাছাকাছি চলে আসে, তৈরি হয় এক বিপজ্জনক অচলাবস্থা। হতাহতের সংখ্যাও বাড়তে থাকে ক্রমেই। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে, জুলাই মাসে নেওয়া হয় আলোচনার উদ্যোগ; তবে সেখানে দেখা দেয় আরেক বিপত্তি। যুদ্ধবন্দীদের বিষয়ে সিদ্ধান্তে একমত হতে ব্যর্থ হয় উভয়পক্ষ। যদিও আমেরিকান বাহিনীর হাতে আটক অনেক যুদ্ধবন্দী তাদের নিজ দেশে আর ফিরে যেতে চাননি বলে দাবি পুঁজিবাদীদের, কিন্তু উত্তর কোরিয়া এবং চীন উভয়ই শান্তির শর্ত হিসেবে তাদের প্রত্যাবাসনের ওপর জোর দিয়েছিল।
১৯৫৩ সালের ২৭ জুলাই উত্তর কোরিয়া, চীন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। তবে সেই চুক্তিতে আপত্তি জানায় দক্ষিণ কোরিয়া। কোরিয়া উপদ্বীপের বিভাজনে আপত্তি জানিয়ে যুদ্ধবিরতির আনুষ্ঠানিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করেনি দেশটি। অর্থাৎ, রণক্ষেত্রে লড়াই থামলেও বলতে গেলে, পঞ্চাশের দশকের সেই কোরিয়া যুদ্ধ আসলে শেষ হয়নি আজও।
৩ বছরের ওই সংঘাতে কতজন মারা গিয়েছিল সেই হিসাবও এখন পর্যন্ত স্পষ্ট নয়। ধারণা করা হয়, প্রায় ৪০ হাজার আমেরিকান সৈন্য এবং আনুমানিক ৪৬ হাজার দক্ষিণ কোরিয়ার সৈন্য নিহত হয়েছিল সে সময়। উত্তরের দিকে হতাহতের সংখ্যা ছিল আরও বেশি। ধারণা করা হয়, ২ লাখ ১৫ হাজার উত্তর কোরিয়ান সেনা এবং চীনের ৪ লাখ সেনা মারা গিয়েছিল যুদ্ধে। তবে নিহতদের মধ্যে অধিকাংশ, প্রায় ৭০ শতাংশই ছিল বেসামরিক নাগরিক। ধারণা করা হয়, প্রায় ৪ মিলিয়ন বেসামরিক লোক নিহত হয়েছিল সংঘাতে। উত্তর কোরিয়ায় বিশেষ করে, বোমা হামলা এবং রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের ফলেই ব্যাপক সংখ্যক মানুষ মারা গিয়েছিল।
যুদ্ধ শেষে অনেকেই নিখোঁজ ছিল, এখনও হদিস মেলেনি তাদের; অনেক সেনাই ছিল আনুষ্ঠানিক হিসাবের তালিকায় হিসাবহীন। দক্ষিণ কোরিয়ার প্রায় ৮০ হাজার সৈন্য ধরা পড়েছিল উত্তর কোরিয়ায়। তবে বন্দীদের কথা কথা স্বীকার করেনি উত্তর কোরিয়া। অন্যদিকে, দক্ষিণ কোরিয়ার অভিযোগ, আটকে পড়া সেনাদের বাধ্যতামূলক শ্রমিকের কাজ করানো হয়েছিল। এই যুদ্ধবন্দিদের অধিকাংশেরই দেহাবশেষের কোনো হদিস মেলেনি কখনো।
২০২০ সালের জুনে দক্ষিণ কোরিয়ার ১৪৭ যুদ্ধবন্দীকে চিহ্নিত করে যুক্তরাষ্ট্র, যাদের দেহাবশেষ ২০১৮ সালেই হস্তান্তর করেছে উত্তর কোরিয়া। এদিকে, সাড়ে ৭ হাজারেরও বেশি মার্কিন সেনা এখনও নিখোঁজ রয়েছে।
যুদ্ধ শুরু হওয়ার ৭২ বছর পরেও দুই কোরিয়া এখনও বিভক্ত। পুনঃএকত্রীকরণের একটি আশা অবশ্য জেগেছিল ২০০০ সালে; তখন উভয় দেশ যৌথ ঘোষণা জারি করে জানিয়েছি, তারা পুনরায় একত্রিত হওয়ার জন্য 'চেষ্টা' করবে। ২০১২৮ সালে উভয় দিকের শীর্ষ নেতারা এক সম্মেলনে মিলিত হয়ে সেই আশায় আরও আলো জ্বালালেও ধীরে ধীরে তা আবারও ম্লান হয়ে যায়। বিভিন্ন সময়ে উত্তর কোরিয়া আক্রমণাত্বক মনোভাব এবং উভয়পক্ষের মধ্যে অবিশ্বাসের কারণে দুই কোরিয়া এক হওয়ার আলোচনা আর এগোতে পারেনি।
এদিকে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং ভিয়েতনাম যুদ্ধের মাধ্যমের আমেরিকানদের স্মৃতি থেকে কোরিয়া যুদ্ধ ম্লান হয়ে গেলেও কোরিয়ায় ট্রুম্যানের কর্মকাণ্ড বিশ্বজুড়ে পাশ্চাত্যের প্রক্সি যুদ্ধের ক্ষেত্রে এক ধরনের বৈধতার নজির সৃষ্টি করেছে। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ ভিয়েতনাম, ইরাক এবং আফগানিস্তানে মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপ এবং বসনিয়া ও হাইতিতে জাতিসংঘের মিশন। শুরু থেকেই এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়ে বিতর্ক চলে আসছে। তারপরেও বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দ্বন্দ্ব-সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সংশ্লিষ্টতা স্পষ্ট। একইভাবে অঘোষিত, অমীমাংসিত এবং অনেকাংশে 'ভুলে যাওয়া' কোরিয়া যুদ্ধের অস্থিরতা আজও বেঁচে আছে উভয় কোরিয়ায়।
(ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকে প্রকাশিত মার্কিন সাংবাদিক এরিন ব্লেকমোরের আর্টিকেল অবলম্বনে)