আসছে ডেঙ্গুর নতুন ভ্যাকসিন, তবে এখনই কেনার বিষয়ে ভাবছে না বাংলাদেশ
কয়েক বছরের গবেষণার পর, জাপানের ফার্মাসিউটিক্যাল জায়ান্ট তাকেদা ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি 'কিউডেঙ্গা' নামে একটি ভ্যাকসিন তৈরি করেছে। ডেঙ্গুর এই ভ্যাকসিন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য দেখাচ্ছে আশার আলো।
ইন্দোনেশিয়া ইতোমধ্যেই ভ্যাকসিনটির অনুমোদন দিয়েছে। এছাড়া, যুক্তরাষ্ট্রসহ আরও বেশ কয়েকটি দেশ অনুমোদন দেওয়ার কথা ভাবছে। আশা করা হচ্ছে, আগামী ২০২৩ সালেই এটি বাজারে আসবে।
তবে, দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়লেও এই মুহূর্তে ভ্যাকসিনের প্রতি তেমন আগ্রহী নয় বাংলাদেশ। মশাবাহিত এই রোগ মোকাবেলায় এখনও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার ওপরেই জোর দেওয়া দেশে।
কর্তৃপক্ষ বলছে, ডেঙ্গুর এই ভ্যাকসিনটি বাংলাদেশ আপাতত পর্যবেক্ষণ করছে; বিভিন্ন দেশে দেওয়ার পর কী হয় সেটি বুঝে এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) অনুমোদনের পরই ভ্যাকসিনটি নিয়ে চিন্তা করবে বাংলাদেশ।
এদিকে, চলতি বছর সবচেয়ে ভয়াবহ ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বুধবার (৯ নভেম্বর) পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ১৮৭ জন, যা গত ২২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের (ডিজিএইচএস) অতিরিক্ত মহাপরিচালক প্রফেসর ড. আহমেদুল কবীর দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "এখন পর্যন্ত আমরা ডেঙ্গু মোকাবেলায় প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার ওপর জোর দিচ্ছি। যেকোনো নতুন ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে খরচসহ অন্যান্য অনেক বিবেচনার বিষয় রয়েছে; যেমন- ভ্যাকসিনটি কতদিন সুরক্ষা দেবে। ধরুন, যদি চার বছর সুরক্ষা দেয়, তাহলে চার বছর পর পর এই ভ্যাকসিন বিপুল সংখ্যক মানুষকে দিতে হলে এটিকে ভ্যাকসিনেশন প্ল্যানে ঢোকানোর ব্যবস্থা করতে হবে, যা সময় সাপেক্ষ বিষয়।"
"এই মুহূর্তে এটি সহজ হবে না। ভ্যাকসিনটি যেহেতু কিছু সময়ের মধ্যেই বাজারে আসবে, বিভিন্ন দেশে আগে দেওয়া হোক, বিষয়টি আমরা পর্যবেক্ষণ করি, তারপর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে," যোগ করেন তিনি।
ডিজিএইচএসের কমিউনিকেবল ডিজিজ কন্ট্রোল ইউনিটের পরিচালক অধ্যাপক ড. নাজমুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, "ডেঙ্গু ভ্যাকসিন নিয়ে এখন পর্যন্ত অনুষ্ঠানিকভাবে কোনো ফোরামে কোনো ধরনের আলোচনা হয়নি। আমরা যেহেতু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে স্ট্যান্ডার্ড হিসেবে ধরি, তাই ডেঙ্গুর ভ্যাকসিন বিষয়ে সংস্থাটি থেকে কোনো গাইডলাইন দেওয়া হলে বিষয়টি আলোচনায় আনা হবে।"
তিনি বলেন, "ভ্যাকসিন সম্পর্কে সমস্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে ভ্যাকসিনটির কার্যকরিতা শতভাগ কিনা তা নিশ্চিত হতে হবে আগে। ডব্লিউএইচও'র কাছ থেকে তথ্য পাওয়ার পর আমরা পরবর্তী পদক্ষেপ নেবো। এই ভ্যাকসিন ডেঙ্গুর ৪টি ধরনের সেরোটাইপের বিরুদ্ধে কাজ করে কিনা তা জানতে হবে।"
চলতি বছরের আগস্টেই তাকেদার কিউডেঙ্গা অনুমোদন করেছে ইন্দোনেশিয়া। কোম্পানিটি জানিয়েছে, আগামী বছরের শুরুর দিকেই তারা দেশটিতে ভ্যাকসিন বিক্রি শুরু করবে।
অক্টোবরে ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি উপদেষ্টা প্যানেল বলেছে, ৪ বছরের কম বয়সী শিশুদের ওপর কিউডেঙ্গা ভ্যাকসিন পরিচালনা করা যেতে পারে। আশা করা অচ্ছে, কয়েক মাসের মধ্যেই এ সুপারিশটি ইইউ'র সম্মতি পাবে। এছাড়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ প্রায় ডজনখানেক অন্যান্য দেশে এই ভ্যাকসিনের অনুমোদন চাইছে কোম্পানিটি।
নাজমুল ইসলাম বলেন, "ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুরসহ যেসব দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি, সেসব দেশের তুলনায় বাংলাদেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব কম। ডেঙ্গুর একটি বড় অংশ এখনো শুধু মেট্রোপোলিটন সিটিতেই। তাই ভ্যাকসিনের বিষয়ে আমাদের আরও চিন্তা করার সুযোগ রয়েছে।"
পরিস্থিতি ও ডেঙ্গু রোগ নিয়ন্ত্রণে আনতে তিনি বর্ষাকালে মশার বংশবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের ওপর জোর দেন।
১৯৯৭ সালে ফরাসি বহুজাতিক ফার্মাসিউটিক্যাল এবং স্বাস্থ্যসেবা সংস্থা সানোফি একটি ডেঙ্গু ভ্যাকসিন নিয়ে কাজ শুরু করে; ২০১৫ সালে 'ডেঙ্গভ্যাক্সিয়া' নামে ওই ভ্যাকসিনটি মেক্সিকোতে অনুমোদন পায়।
এরপর শীঘ্রই ১৯টি দেশে চালু হয় ওই ভ্যাকসিন। কিন্তু পরে সানোফির আরেক গবেষণায় দেখা যায়, কিছু বিরল ক্ষেত্রে ডেঙ্গভ্যাক্সিয়া উল্টো বিপর্যয় ঘটাতে পারে। যাদের কখনও ডেঙ্গু হয়নি তাদেরকে টিকা দেওয়ার পর তারা যদি ডেঙ্গু আক্রান্ত হন, তবে ভ্যাকসিনটি অনেকক্ষেত্রেই রোগটিকে আরও গুরুতর করে তুলতে পারে।
২০১৩ সালে ইনভিরাজেন ইনক নামে কলোরাডোর একটি কোম্পানি কিনে নেয় তাকেদা। এই কোম্পানিই কিউডেঙ্গা নিয়ে কাজ শুরু করে। এর কার্যকারিতা এবং সুরক্ষাব্যবস্থা প্রমাণ করা বেশ জটিল ছিল, কারণ ডেঙ্গুর চারটি আলাদা আলাদা ধরন রয়েছে; ভ্যাকসিনটি স্বতন্ত্র চার ধরনের বিরুদ্ধেই সুরক্ষা দিতে পারে কিনা তা জানা ছিল আবশ্যক। কিছুক্ষেত্রে আবার যে সমস্ত রোগী একাধিকবার ভিন্ন স্ট্রেইনে (ধরন) সংক্রমিত হন, তাদের মাঝে আরও গুরুতর উপসর্গ দেখা দিতে পারে। কারণ প্রথম সংক্রমণ থেকে তৈরি নিরপেক্ষ অ্যান্টিবডিগুলো ভাইরাসের সঙ্গে নিজেদের আবদ্ধ করে ফেলে কোষে প্রবেশের ক্ষমতা বাড়াতে পারে।
যদিও এটি স্পষ্ট নয়, কিছু গবেষক বলেছেন, একই রকম বিষয় ঘটতে পারে টিকা দেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যেও। সম্ভবত এটিই ডেঙ্গভ্যাক্সিয়ার বিপর্যয় ঘটানোর মূল কারণ।
তাকেদার দুইডোজের ভ্যাকসিনটি সেরোটাইপ ২ ভেরিয়েন্টের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে। তবে এখানে অন্য তিনটি ধরনের উপাদানও যুক্ত রয়েছে। ডোমিনিকান রিপাবলিক, পানামা এবং ফিলিপাইনে ১ হাজার ৮০০ জন তরুণ-তরুণীর ওপর চালানো হয়েছে এই ভ্যাকসিনের পরীক্ষা। গবেষণায় দেখা গেছে, ভ্যাকসিনটি নেওয়ার পর এটি ডেঙ্গুর চার ধরনের বিরুদ্ধে অন্তত চার বছর সুরক্ষা দেয়।
এই ফলাফলের পর এশিয়া ও লাতিন আমেরিকার ২০ হাজারেরও বেশি স্বেচ্ছাসেবীর ওপর আরেকটি পরীক্ষা চালায় তাকেদা। দেখা যায়, ভ্যাকসিন গ্রহীতাদের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার হার প্ল্যাসিবোর তুলনায় ৮৪ শতাংশ কম এবং এটি ৬১ শতাংশ পর্যন্ত রোগ প্রতিরোধে কাজ করে। এর পাশাপাশি তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো নিরাপত্তা ঝুঁকিও পাওয়া যায়নি পরীক্ষায়।
যদিও এই ভ্যাকসিনটি ডেঙ্গুর চারটি স্ট্রেইনের বিরুদ্ধেই সমানভাবে কার্যকর নয়, তাকেদার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ক্রিস্টোফ ওয়েবার বলেছেন, "এখানে গুরুত্বপূর্ণ হলো, সামগ্রিক কার্যকারিতার দিকে নজর দেওয়া"।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার টিবিএসকে বলেন, তাকেদার এই ভ্যাকসিনটি ডেঙ্গভ্যাক্সিয়া-এর চেয়ে আলাদা।
"ভ্যাকসিনটি এখনো ডব্লিউএইচও'র অনুমোদন পায়নি। তবে, এখন না কিনলেও এটিকে পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে এবং পাশাপাশি তাকোদার সঙ্গেও যোগাযোগ রাখতে হবে," যোগ করেন তিনি।