লুই ফন গাল: নেদারল্যান্ডসের ‘সত্তরোর্ধ সংস্কারক’
টানা দুই বিশ্বকাপ ফাইনালে খেলার অভিজ্ঞতা আছে নেদারল্যান্ডসের। তবে সেটা অনেক আগে; ১৯৭৪ ও ১৯৭৮ সালে ইয়োহান ক্রুইফদের সময়ে। এরপর ২০১০ বিশ্বকাপে রানার্সআপ এবং ২০১৪ বিশ্বকাপে আশা জাগিয়েও শেষ পর্যন্ত ছিটকে যেতে হয়েছে সেমিফাইনাল থেকে। ২০১৮ বিশ্বকাপ তো দেখতে হয়েছে দর্শক হয়ে। দীর্ঘ আট বছর পর আজ আবার দেখা যাবে কমলা জার্সির ঝলক!
বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন দেখছেন দলটির অভিজ্ঞ কোচ লুই ফন গাল। তার মতে সর্বশেষ ব্রাজিল বিশ্বকাপে তৃতীয় হওয়া ডাচ দলটির চেয়ে বর্তমান দলের খেলোয়াড়দের গড় মান ভালো। তাইতো এতটা আত্মবিশ্বাসী তিনি।
বিশ্বকাপে এতদূর পর্যন্ত আসতে ফন গালের মতো এতটা পথ পাড়ি দেননি কেউ।
১৯৮৭ সালের জানুয়ারিতে ডাচ ম্যাগাজিন ভোয়েটবল ইন্টারন্যাশনালকে দেখা এক সাক্ষাৎকারই সম্ভবত ছিল তার প্রথম সাক্ষাৎকার। তখন তিনি ডাচ ক্লাব এজেড আলকমারের তত্ত্বাবধায়ক কোচ ছিলেন। সে সাক্ষাৎকারের শিরোনাম ছিল, 'কোচ হিসেবে সফল হব বলে আমি মনে করি।'
হয়েছেনও বটে। ফুটবলের ইতিহাসে ৭১ বছর বছর বয়সী লুই ফন গালের অবদান অনেক। তিন দফায় নেদারল্যান্ডস জাতীয় দলের কোচ হয়েছেন, ডাচ পেশাদার ফুটবল ক্লাব আয়াক্সের হয়ে ১৯৯৪-৯৫ মৌসুমে জিতেছেন চ্যাম্পিয়নস লিগ সহ ক্লাব পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ সকল শিরোপা। বার্সেলোনা, বায়ার্ন মিউনিখ ও ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের মতো ক্লাবের কোচ হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন তিনি। ডাচ লিগ জিতিয়ে এজেড আলকমারের মতো অখ্যাত ক্লাবকে এনেছিলেন সবার নজরে।
ক্যান্সারের সাথে লড়েই কাতার বিশ্বকাপে নেদারল্যান্ডসকে নেতৃত্ব দেবেন তিনি। ডাচ টিভি অনুষ্ঠান উমবের্তোতে ফন গাল জানিয়েছেন, তিনি প্রোস্টেট ক্যানসারের সঙ্গে লড়ছেন। এর মধ্যে ২৫ বার রেডিয়েশন থেরাপিও নেওয়া হয়ে গেছে তার!
লড়াকু এ জীবনযোদ্ধার নানা অজানা গল্প নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ব্রিটিশ দৈনিক ফাইনান্সিয়াল টাইমস।
রাজধানী আমস্টার্ডামে আয়াক্স স্টেডিয়াম থেকে কয়েকশো মিটার দূরে বেড়ে উঠেছিলেন তিনি। ৬০-এর দশকের বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যায় আয়াক্সের কোচ রাইনাস মিশেলসের তত্বাবধান দেখতে কিশোর ফন গাল সাইকেলে চেপে চলে যেতেন প্রশিক্ষণ মাঠে।
কিন্তু ফুটবলের জন্য পাগল তরুণ ফন গাল আয়াক্সের মূল একাদশে থাকতে পারেননি। ফুটবল নিয়ে গভীর জ্ঞান থাকা স্বত্বেও লিকলিকে 'আনঅ্যাথলেটিক' শরীরের জন্য আটকে যেতে হয়েছিল তাকে। একজন দর্শকের কাছে মনে হবে, তিনি এমনভাবে দৌড়ান যেন তিনি 'একটি ছাতা গিলে ফেলেছেন!' ১৫ বছর ধরে ছোট ছোট ক্লাবের প্লেমেকার হয়ে থাকার পাশাপাশি কারিগরি স্কুলে শরীরচর্চা শেখানোর কাজ করতেন তিনি।
ফাইনান্সিয়াল টাইমস-এর ভাষায়, 'অকপট, সোজাসাপটা কথা বলা এবং চ্যাপ্টা মুখমণ্ডলধারী' ফন গাল কোচ হিসেবে প্রথম দর্শনে কোচ হিসেবে খুব একটা ভালো ছাপ ফেলতেন না।
তবে কোচ হিসেবে দুটো জিনিসের প্রয়োজন: নেতৃত্বের গুণাবলী এবং খেলা সম্পর্কিত অন্তর্দৃষ্টি। বিনীতভাবে ফন গাল বলেন, 'আমার যে এ দুটো গুণাবলি আছে - তা নাকচ করে দিতে পারি না।'
কোন পরিস্থিতিতে কোন খেলোয়াড়কে ঠিক কোন স্থানে খেলতে হবে তিনি তা বেশ ভালোমতোই জানেন। এমনকি খেলোয়াড়দের দক্ষতাকে শাণিত করতেও পটু তিনি। লেফট-ব্যাকে কে ভালো করবে কিংবা কাকে আউটসাইড-রাইটে রাখবেন-সবকিছুই যেন তার কাছে পরিষ্কার!
২০১৬ সালে ম্যানচেস্টার তাকে ছাঁটাই করলে ফুটবল বিশ্ব থেকে অনেকটা সরে যান তিনি। এরপর গত বছর আবার কমলা দলকে নেতৃত্ব দিতে দায়িত্বে ফেরেন তিনি।
প্রথম দিকে ক্যান্সার ধরা পড়ার ব্যাপারটিকে গোপন রেখে চলছিলেন ফন। চলতি বছর এক প্রামাণ্যচিত্রে তার স্ত্রী জানান, 'পাকস্থলীতে ক্যাথেটার (মূত্রনিষ্কাশনযন্ত্র) আর পায়ে মূত্রের ব্যাগ ছিল ঝোলানো। তবুও খেলোয়াড়দের কেউই কোনো কিছু টের পাননি।'
কেমোথেরাপির জন্য ক্যাম্প থেকে চুপিসারে বেরিয়ে যেতেন। পাঁজরের হাড় ভাঙায় কিছুদিন হুইলচেয়ারে করেও কোচের দায়িত্ব পালন করে গেছেন তিনি।
প্রামাণ্যচিত্রটিতে তার বর্তমান অবস্থা সামনে আনেন ফন। এক দৃশ্যে দেখা যায়, ডাক্তার তাকেই ভয়ঙ্কর রোগটির কথা জানাচ্ছেন। ফন চেয়েছিলেন ক্যান্সারকে মানসিকভাবে মেনে নিতে। ব্যাপারটি তার জন্য অনেক পীড়াদায়ক ছিল। কারণ ক্যান্সারের জন্যেই ৩৯ বছর বয়সে প্রথম স্ত্রীকে হারাতে হয়েছিল তার।
ডাচ দলকে কোচ করতে তাকে সবচেয়ে বেশি খুশি দেখা যায়। চলমান কাতার বিশ্বকাপকে তিনি 'তার জীবনের সবচেয়ে বড় উপহার' বলে মনে করেন। তাই এমন শারীরিক অবস্থার মাঝেও প্রিয় দলকে নিয়ে আশায় বুক বাঁধতে ভোলেননি তিনি। তার অসুস্থতার খবর শুনে ডাচ মিডফিল্ডার স্টিভেন বার্গুইজ সুস্থতা কামনা করে হোয়াটঅ্যাপে বার্তা পাঠিয়েছিলেন। উত্তরে ফন গাল বলেছিলেন, 'ধন্যবাদ। আশা করি আপনি বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হতে প্রস্তুত।'
তিনি ফুটবল, তার দলের খেলোয়াড় এবং নিজেকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেন। কথা বলেন অকপটভাবে, ছলছাতুরী ছাড়াই নিজের মতামত স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিতেও দ্বিধা করেন না। আয়োজক হিসেবে কাতারের নাম ঘোষণার পর বলেছিলেন, 'শুধু আর্থিক ও বাণিজ্যিক দিক বিবেচনা করে মধ্যপ্রাচ্যে বিশ্বকাপের মতো একটি বড় টুর্নামেন্ট আয়োজন করতে যাচ্ছে ফিফা।' কোনো এক কথায় বিরক্ত হয়ে এক সাংবাদিককে তো বলেই বসেছিলেন, 'আমি বেশি বুদ্ধিমান নাকি তুমি এতটাই বোকা?'
তবে শেখার যাত্রা এখনও শেষ হয়নি তার। কোচ হিসেবে নিজেকে আরও অগ্রসর করছেন তিনি, প্রতিনিয়ত শিখে নিচ্ছেন নতুন কৌশল। ডাচ দৈনিক ভোল্কস্ক্রান্ট তাকে উপাধি দিয়েছে 'সত্তরোর্ধ সংস্কারক'!
মাঠে ঠিক সময়ে ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে অখ্যাত ফুটবলারদের বিশ্বকাপ ফাইনাল পর্যন্ত যাওয়ার 'রীতি' আছে ডাচদের; ১৯৭৮ ও ২০১০ সালের বিশ্বকাপ তার প্রমাণ। কিন্তু তখনকার দলগুলোতে চমৎকার সব খেলোয়াড় ছিলেন। অন্যদিকে বর্তমান দলটির সবচেয়ে ভালো খেলোয়াড় মেম্ফিস ডিপে ইনজুরির কারণে আজ খেলছেন না।
খেলোয়াড়দের ব্যক্তিগত দক্ষতার তুলনা করে ফল গাল স্বীকার করেন, 'ডাচ দলের চেয়ে ইংল্যান্ড, জার্মানি, ফ্রান্স এবং স্পেইন অনেক উর্ধ্বে।'
তবে হাল ছেড়ে দিয়ে বসে থাকতে মোটেও রাজি নন তিনি। নেদারল্যান্ডসের অন্যতম প্রভাবশালী ফুটবল-ব্যক্তিত্ব এবং দেশটির 'জাতীয় সম্পদ' লুই ফন গালের কাছে ফুটবলে সাফল্য অর্জনই তার 'পৃথিবীতে বেঁচে থাকার একমাত্র উদ্দেশ্য।'