আর্জেন্টিনার শেষ ষোলোর পথ কতোটা কঠিন করলো সৌদি আরব?
এ যন ক্ষীপ্র গতিতে ছুটে চলা যুদ্ধ বিমানের হঠাৎ ভূপাতিত হওয়ার গল্প! ২০১৯ সালের জুনে কোপা আমেরিকার সেমি-ফাইনালে ব্রাজিলের বিপক্ষে হেরে বিদায়। সেই হারে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়েছিল একটি শিরোপা আশায় চাতক পাখির মতো চেয়ে থাকা আর্জেন্টিনার, মাতম নামে লিওনেল মেসির শিবিরে।
যদিও সেই মাতম শক্তিতে রূপান্তর হয়েছিল। লিওনেল স্কালোনির ছোঁয়ায় বদলে যাওয়া আর্জেন্টিনা ছুটতে শুরু করে দুর্বার গতিতে। প্রতিপক্ষ যেই হোক, শাসন কেবল আলবিসেলেস্তেদের। চোখ জুড়ানো ফুটবলে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠা আর্জেন্টিনা ভুলে যায় হারের স্বাদ কেমন। টানা ৩৬ ম্যাচে অপরাজিত থাকার মিশনের মাঝে লাতিন অঞ্চলের দলটি ঘরে তোলে কোপা আমেরিকা ও ফিনালিসিমিয়ার শিরোপা।
বোঝাপড়ায় দারুণ দলটি আত্মবিশ্বাসে টইটুম্বুর থেকে অংশ নেয় কাতার বিশ্বকাপে। কিন্তু বিশ্বচ্যাম্পিয়নের মুকুট জেতার যাত্রার শুরুতেই জোরেশোরে ধাক্কা খেতে হলো। শক্তি, সামর্থ্য, সাফল্যে যোজন যোজন পিছিয়ে থাকা সৌদি আরবের দাপুটে ফুটবলে থেমে গেল আর্জেন্টিনার জয়রথ। আর এই এক হারেই কঠিন হয়ে উঠলো তাদের শেষ ষোলোর পথ।
সৌদি আরবকে শক্তিশালী প্রতিপক্ষ হিসেবে না নিলেও প্রথম ম্যাচ নিয়ে সতর্ক ছিলো আর্জেন্টিনা। বারবার বলা হচ্ছিল প্রথম ম্যাচটি 'ট্রিকি' হতে পারে, তেমনই হলো। লম্বা জয়রথ থামলো, বিশ্ব জয়ের স্বপ্নে লাগলো হোঁচট। পরের রাউন্ডে যেতে আর ভুল করার সুযোগ নেই মেসিদের। 'সি' গ্রুপে পরের দুই ম্যাচের প্রতিপক্ষ মেক্সিকো ও পোল্যান্ড বাধা পেরিয়ে তাদেরকে জায়গা করে নিতে হবে শেষ ষেলোয়।
প্রথমে গোল দিলে আর্জেন্টিনা হারে না, এই রীতি জারি ছিল ৬৪ বছর। সর্বশেষ ১৯৫৮ বিশ্বকাপে প্রথমে গোল করে জার্মানির বিপক্ষে হেরেছিল তারা। দীর্ঘদিন পরে এসে সেই তিক্ত স্বাদ নিতে হলো আর্জেন্টিনাকে। এ পথে আবার অনুপ্রেরণা নেওয়ারও সুযোগ আছে। ১৯৯০ বিশ্বকাপে হার দিয়ে শুরু করা আর্জেন্টিনা খেলেছিল ফাইনালে।
এই অনুপ্রেরণা নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। পরের দুই ম্যাচের একটিতে হারলেই বিদায় ঘণ্টা বেজে যেতে পারে। কারণ এক ম্যাচে জিতে পরের রাউন্ডে যাওয়ার সুযোগ তো আর নেই। এখন তাই অগ্নিপরীক্ষার সামনে আর্জেন্টিনা। প্রথম পরীক্ষাটা মেক্সিকোর বিপক্ষে। আগামী ২৬ নভেম্বর বাংলাদেশ সময় রাত ১টায় টিকে থাকার লড়াইয়ে মেক্সিকোর মুখোমুখি হবেন মেসি-দি মারিয়ারা।
এই ম্যাচের আগে সুখস্মৃতির কথা মনে করতে পারে আর্জেন্টিনা। বিশ্বকাপে মেক্সিকোর বিপক্ষে তিনবারের সাক্ষাতে তিনবারই জয় নিয়ে মাঠ ছেড়েছে তারা। প্রথম বিশ্বকাপেই (১৯৩০) দেখা হয় দুই দলের। প্রথম রাউন্ডের ম্যাচে মেক্সিকোকে ৬-৩ গোলে হারায় আর্জেন্টিনা। পরের সাক্ষাত ২০০৬ সালে, শেষ ষেলোয় আর্জেন্টিনা জেতে ২-১ গোলে। সর্বশেষ ২০১০ সালে শেষ ষোলোয় ৩-১ গোলের জয় তুলে নেয় আর্জেন্টিনা।
সব মিলিয়েও আর্জেন্টিনা এগিয়ে। মেক্সিকোর বিপক্ষে ৩৫ ম্যাচ খেলে ১৬টিতে জিতেছে তারা। মেক্সিকোর জয় ৫ ম্যাচে, ড্র হয় ১৮ ম্যাচ। এ ছাড়া নিজেদের প্রথম ম্যাচে ড্র করে মেক্সিকোও এখন চাপে। মঙ্গলবার রাতে পোল্যান্ডের বিপক্ষে গোলশূন্য ড্র করেছে তারা। অবশ্য ম্যাচটি হেরে যেতে পারতো তারা। কিন্তু গোলরক্ষক গুইলের্মো ওচোয়ার বীরত্বে হারতে হয়নি। পোল্যান্ডের তারকা ফরোয়ার্ড রবার্ট লেভানডোভস্কির নেওয়া পেনাল্টি শট ফিরিয়ে দেন তিনি।
গ্রুপ পর্বে আর্জেন্টিনার শেষ প্রতিপক্ষ পোল্যান্ডের শুরুটাও ভালো হলো না। দলের সেরা ফুটবলারের পেনাল্টি মিসের কারণে জয় তো পাওয়া হলোই না, পয়েন্ট হারানোর সঙ্গে সঙ্গে আত্মবিশ্বাসেও লাগলো ধাক্কা। তবে বিশ্বকাপের লড়াইয়ে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে সুখস্মৃতি আছে পোলিশদের। দুইবারের সাক্ষাতে আর্জেন্টিনার মতো তারাও একটি ম্যাচ জিতেছে। ১৯৭৪ বিশ্বকাপে প্রথম রাউন্ডে আর্জেন্টিনাকে ৩-২ গোলে হারায় পোল্যান্ড। পরের সাক্ষাতে ১৯৭৮ বিশ্বকাপে দ্বিতীয় রাউন্ডে আর্জেন্টিনা জেতে ২-০ গোলে।
প্রথম ম্যাচে হেরে গেলেও তাই শেষ ষোলোর আশা ভালোভাবেই টিকে আছে আর্জেন্টিনার। আবার মেক্সিকো-পোল্যান্ডের ড্রতেও কিছুটা সুবিধা হয়েছে তাদের। দুই দলেরই পয়েন্ট ১ করে। কোনো দল জিতে গেলে পয়েন্ট পেতো ৩, আরেকটি জয়েই শেষ ষোলো নিশ্চিত হতে পারতো তাদের। একইভাবে সৌদি আরব আরেকটি জিতলে তাদের পয়েন্টও ছয় হবে। তখন শেষ দুই ম্যাচ জিতেও যথেষ্ট নাও হতে পারে মেসিদের।
মেক্সিকো, পোল্যান্ডের কেউ যদি আর একটি ড্র করে, তাহলেই তাদের শেষ ষোলোর স্বপ্ন বিবর্ণ হয়ে উঠবে। বাকি ম্যাচটি জিতলেও পয়েন্ট দাঁড়াবে চার, যা যথেষ্ট নাও হতে পারে। কারণ দুটি দল দুটি কয়ে ম্যাচ জিতলেই তারা পড়ে যাবে বাদের কাতারে। সেই হিসেবে এই ড্রটি কাজে লাগতে পারে আর্জেন্টিনার। আবার বিপদও হতে পারে। কারণ কোনো দল জিতলে আরেক দল পিছিয়ে পড়তো। পরের দুই ম্যাচের একটিতে হারলেই তাদের বিদায় নিশ্চিত হতো। সব মিলিয়ে শেষ ষোলোয় উঠতে কয়েকটি সমীকরণ এখন আর্জেন্টিনার সামনে, তবে সেখানে ভুল করার কোনো সুযোগ নেই।