মেসির পেনাল্টি মিসের ম্যাচ জিতে শেষ ষোলোয় আর্জেন্টিনা
দলের সেনাপতি তিনি, দল বিপদে পড়লেই কাণ্ডারী হয়ে দেখা দেন। অনেক উপলক্ষ্যেই তিনি দলকে বাঁচিয়েছেন খাদের কিনার থেকে। সেই লিওনেল মেসিই করলেন পেনাল্টি মিস। কাণ্ডারীর এমন মিস, সঙ্গে অবিরত আক্রমণের পরও গোল না পাওয়া; হতাশায়ই প্রথমার্ধ শেষ হয় আর্জেন্টিনার। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে অন্য গল্প, আক্রমণের ধারা জারি রেখে শাসন করতে থাকা আর্জেন্টিনাকে এগিয়ে দিলেন আলেক্সিস ম্যাক আলিস্টার। পরে ব্যবধান দ্বিগুণ করলেন পুরো ম্যাচে চোখ ধাঁধানো পারফরম্যান্স করা হুলিয়ান আলভারেস। দাপুটে জয়ে শেষ ষোলোতে উঠলো আলবিসেলেস্তেরা।
বুধবার রাতে কাতারের ৯৭৪ স্টেডিয়ামে 'সি' গ্রুপের ম্যাচে পোল্যান্ডকে ২-০ গোলে হারিয়েছে আর্জেন্টিনা। এই জয়ে ৬ পয়েন্ট নিয়ে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠলো লাতিন আমেরিকা অঞ্চলের দেশটি। ম্যাচ হেরেও এই গ্রুপের দ্বিতীয় দল হিসেবে শেষ ষোলোয় উঠলো পোল্যান্ড। ৩৬ বছর পর দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠলো তারা, সর্বশেষ উঠেছিল ১৯৮৬ বিশ্বকাপে। সৌদি আরবের বিপক্ষে ২-০ গোলে জিতেও পোলিশদের সমান পয়েন্ট নিয়ে বাদ পড়লো মেক্সিকো, ৪৪ বছর পর দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠতে ব্যর্থ হলো তারা।
প্রথমার্ধে অনেক আক্রমণ সাজিয়ে গোল না পাওয়ার আক্ষেপ, সঙ্গে প্রাণভোমরা মেসির পেনাল্টি মিসের হতাশা; এরপরও দুর্বার ছিল আর্জেন্টিনা। রক্ষণাত্মক ফুটবল খেলা পোল্যান্ডকে দ্বিতীয়ার্ধে আরও শাসন করে গোল আদায় করে নেয় তারা। ছড়ি ঘোরানো আর্জেন্টিনা ম্যাচে ৭৪ শতাংশ সময় বল নিজেদের পায়ে রাখে। তাদের নেওয়া ২৩টা শটের ১২টি ছিল লক্ষ্যে। দুটির বেশির গোল হয়নি পোলিশ গোলরক্ষক ভয়চেক শেজনির দারুণ দক্ষতার কারণে। ড্রয়ের জন্য খেলা পোল্যান্ড সেভাবে আক্রমণই করেনি, নিজেদের জালই সামলাতে চেয়েছে তারা। রবার্ট লেভানডোভস্কিদের নেওয়া ৪টি শটের একটিও লক্ষ্যে ছিল না।
প্রথম ম্যাচে সৌদি আরবের বিপক্ষে হেরে কোণঠাসা হয়ে পড়ে আর্জেন্টিনা। পরের দুই ম্যাচ হয়ে ওঠে অগ্নি-পরীক্ষা। মেসি জাদুতে মেক্সিকো বাধা পেরনো পরও ছিল শঙ্কা, মেলানো হচ্ছিল কতো সমীকরণ! এমন ম্যাচে পোল্যান্ডের বিপক্ষে চারটি পরিবর্তন নিয়ে মাঠে নামে আর্জেন্টিনা। বাদ দেওয়া হয় লাউতারো মার্তিনেস, লিসান্দ্র মার্তিনেস, মন্তিয়েল ও গিদো রদ্রিগেজ। শুরুর একাদশে সুযোগ দেওয়া হয় ক্রিশ্চিয়ান রোমেরো, নাহুয়েল মলিনা, এনসো ফার্নান্দেস ও হুলিয়ান আলভারেসকে। কোচ লিওনেল স্কালোনির পরিবর্তনের পরিকল্পনা কাজে দেয় শুরু থেকেই।
ম্যাচ শুরুর বাঁশি বাজতেই আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলতে শুরু করে আর্জেন্টিনা। দ্বিতীয় মিনিটেই আর্জেন্টিনার আক্রমণ। ডান প্রান্ত থেকে ডি-বক্সে ডি মারিয়াকে বল দেন মেসি। আস্তে করে বল তুলে দেন তিনি, ছোট বক্সের বাঁ পাশ থেকে লাফিয়ে উঠে হেড করেন নিকোলাস ওতামেন্দি। কিন্তু লক্ষ্যে রাখতে পারেননি, বল বেশ দূর দিয়ে বেরিয়ে যায়। সপ্তম মিনিটে ডি-বক্সের বাইরে থেকে মেসির নেওয়া ডান পায়ের দুর্বল শট সহজেই গ্লাভসবন্দি করেন পোল্যান্ডের গোলরক্ষক শেজনি।
নবম মিনিটে ডি-বক্সের বাইরে থেকে ডি মারিয়ার শট গায়ে লেগে ফিরে আসে। পরের মিনিটে ডান প্রান্ত দিয়ে আক্রমণে গিয়ে বাঁ পাশে মেসিকে বাড়ান মারিয়া। এগিয়ে গিয়ে কোণা থেকে শট নেন মেসি, কর্নারের বিনিময়ে দলকে বিপদমুক্ত শেজনি। ১৫তম মিনিটে পাল্টা আক্রমণে সতীর্থের পাস থেকে ডি-বক্সে একটুর জন্য বলের ছোঁয়া পাননি আলভারেস। ১৭তম মিনিটে দূর থেকে মেসির বাড়ানো বল পেয়ে ডি-বক্সে জোরালো শট নেন আকুনা, কিন্তু বারপোস্টের উপর দিয়ে চলে যায়।
১৯তম মিনিটে আবারও আলবিসেলেস্তেদের আক্রমণ। মেসির উঁচু করে বাড়ানো পাসে দুর্বল হেড দেন আকুনা, যা গ্লাভসবন্দি করতে কোনো বেগই পেতে হয়নি শেজনিকে। তবে আকুনা হেডে ডি-বক্সের মাঝে বল বাড়ালে বিপদ হতে পারতো পোল্যান্ডের। ২১তম মিনিটে পাল্টা আক্রমণে গিয়ে সম্ভাবনা তৈরি করতে পারেনি পোলিশরা।
২৯তম মিনিটে অসাধারণ আক্রমণ করে আর্জেন্টিনা। ডান প্রান্ত দিয়ে গিয়ে কাট ব্যাক করেন ডি মারিয়া, বল পেয়ে গোলে শট করেন আলভারেস। কিন্তু পোল্যান্ডের রক্ষণভাগের খেলোয়াড়ের গায়ে লেগে ফিরে আসে। ফিরতি বলে আকুনার নেওয়া জোরালো শট একটুর জন্য লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। ৩৩তম মিনিটে ডি মারিয়ার নেওয়া বাঁকানো কর্নার শট জালে জড়িয়ে যাচ্ছিল, শেষ মুহূর্তে ঝাঁপিয়ে কর্নারের বিনিময়ে পোল্যান্ডকে বাঁচান শেজনি।
চার পয়েন্ট থাকায় ড্রয়ের লক্ষ্যে খেলা পোল্যান্ড রক্ষণাত্মকই খেলতে থাকে, আক্রমণ যা করার আর্জেন্টিনাই করছিল। যে কারণে বল বেশিরভাগ সময় পোল্যান্ডের সীমানাতেই ঘুরপাঁক খাচ্ছিল। ৩৬তম মিনিটে সূবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করেন আলভারেস। তার নেওয়া শট ফিরিয়ে দেন শেজনি। ফিরতি বলে মেসি হেড নেন, এ সময়ে সেজনির হাত মেসির মুখে লাগলে ভিএআরের সাহায্যে নিয়ে পেনাল্টি দেন রেফারি। কিন্তু ত্রাতা মেসিই পেনাল্টি মিস করেন। তার নেওয়া শট দারুণ দক্ষতায় ঝাঁপিয়ে ফিরিয়ে দেন শেজনি। এবারের আসরে এটা তার দ্বিতীয় পেনাল্টি সেভ।
৪৩ তম মিনিটে ডি-বক্সের বাইরে থেকে শট নেন আলভারেস। তার শট পাঞ্চ করে ফেরান সেজনি, তবে পুরোপুরি বিপদমুক্ত করতে পারেননি। বল গিয়ে লাগে অপ্রস্তুত ডি পলের গায়ে, এবার বলের নিয়ন্ত্রণ নেন শেজনি। দাপুটে ফুটবল খেলেও হতাশা নিয়ে প্রথমার্ধ শেষ করেন মেসিরা। এই অর্ধে ৬৬ শতাংশ সময় বল পায়ে রাখে আর্জেন্টিনা। একের পর এক আক্রমণ করা আলবিসেলেস্তেরা গোলমুখে ১৭টি শট নেয়, যার ৭টি ছিল লক্ষ্যে। কিন্তু দেয়াল তুলে দাঁড়িয়ে থাকা পোল্যান্ডের গোলরক্ষককে ফাঁকি দেওয়া যায়নি। পোল্যান্ডের নেওয়া ২টি শটের একটিও লক্ষ্যে ছিল না।
আরও জেদ নিয়ে দ্বিতীয়ার্ধে খেলতে নামে আর্জেন্টিনা। শুরুতেই পোলিশদের ওপর চড়ে বসে তারা। ৪৭তম মিনিটে মিলে যায় কাঙ্খিত গোলের দেখা। ডান প্রান্ত দিয়ে আক্রমণে গিয়ে ডি মারিয়া বল বাড়ান মলিনাকে। ডান পায়ের বাঁকানো ক্রস করেন তিনি, ডি-বক্সে থাকা ম্যাক আলিস্টার আলতো টোকায় দিক বদলে বল জালে জড়ান। গোল হজম করে দুই মিনিট পরই পাল্টা আক্রমণে যায় পোল্যান্ড। কিন্তু সতীর্থের বাড়ানো ক্রসে কামিল গ্লিকের নেওয়া হেড একটুর জন্য লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়।
৫৩তম মিনিটে মাঝমাঠ থেকে বল নিয়ে গিয়ে ডি-বক্সে ঢুকে পড়েন মেসি, কিন্তু এবারও হতাশ করেন তিনি। তার নেওয়া শট ফসকে অনেক দূর দিয়ে চলে যায়। ৫৭তম মিনিটে ডি-বক্স থেকে মেসির নেওয়া শট পোলিশ ডিফেন্ডারের গায়ে ফিরে আসলে শট নেন আলভারেস, তার শটও রুখে দেয় পোল্যান্ড। ৫৯তম মিনিটে ডি মারিয়া ও আকুনাকে তুলে পারেদেস ও তাগলিয়াফিকোকে নামায় আর্জেন্টিনা।
৬১তম মিনিটে ফের হানা দেয় আর্জেন্টিনা। মেসির পাস থেকে বাঁ পাশ দিয়ে গিয়ে ক্রস করেন তাগলিয়াফিকো। বল পেয়ে শট নেন গোলদাতা আলিস্টার, কিন্তু তার শট সহজেই নিয়ন্ত্রণে নেন সেজনি। ৬৭তম মিনিটে আর আলবিসেলেস্তেদের দমিয়ে রাখা যায়নি, দারুণ খেলতে থাকা আলভারেস এগিয়ে নেন দলকে। ডি-বক্সের মুখ থেকে পাস দেন এনসো ফার্নান্দেস, বল নিয়ন্ত্রণে নিয়ে একজনকে ফাঁকি দিয়ে ডান পায়ের প্লেসিং শটে বল জালে জড়ান আলভারেস।
৭১তম মিনিটে অসাধারণ আক্রমণ সাজায় স্কালোনির দল। বাঁ প্রান্ত দিয়ে এগিয়ে গিয়ে ছোট বক্সে কাটব্যাক করেন তাগলিয়াফিকো। সেখান থেকে মেসির নেওয়া শট ফিরিয়ে দেন শিজনি। দুই মিনিট পর মেসির রক্ষণচেড়া পাস থেকে বল পেয়ে ছুটে গিয়ে শট নেন আলভারেস। দলের দ্বিতীয় গোলদাতার নেওয়া শট বারপোস্ট ঘেঁষে বেরিয়ে যায়।
৮৬তম মিনিটে সূবর্ণ সুযোগ সুযোগ নষ্ট করেন বদলি হিসেবে নামা লাউতারো মার্তিনেস। প্রতিপক্ষের ভুলে বল পেয়ে ডি-বক্সে শেজনিকে একা পেয়েও সুযোগ কাজে লাগাতে পারেননি তিনি। যোগ করা সময়ের দ্বিতীয় মিনিটে তাগলিয়াফিকোর চিপ-ইন ঝাঁপিয়ে ফেরান শেজনি। বাকি সময়ে আর তেমন সম্ভাবনা জাগেনি। ২-০ গোলের মধুর জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে আলবিসেলেস্তেরা।