বিশ্বকাপে মেসির সঙ্গী হয়ে দ্যুতি ছড়াচ্ছেন তরুণ হুলিয়ান আলভারেজ
চলতি বছরের শুরুতেই ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের অন্যতম সেরা ক্লাব ম্যানচেস্টার সিটির সঙ্গে চুক্তি পাকাপাকি হয়ে গিয়েছিল আর্জেন্টিনার ২২ বছর বয়সী তরুণ ফরোয়ার্ড হুলিয়ান আলভারেজের। মাত্র ২১ মিলিয়ন পাউন্ডে এই উদীয়মান তারকাকে দলে টেনে যে বড় রকমের লাভ হয়েছে তা নিশ্চয়ই বিশ্বকাপ মৌসুমে আরও ভালোভাবে টের পাচ্ছে ম্যানসিটি। কারণ বিশ্বকাপে এরই মধ্যে আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে মেসির সঙ্গে একই মাঠে দ্যুতি ছড়াচ্ছেন হুলিয়ান আলভারেজ। পরপর দুই ম্যাচে দুই গোল করে আর্জেন্টাইন ভক্তদের জন্য হয়ে উঠেছেন ভরসার নাম।
ম্যানচেস্টার সিটিতে আর্লিং হালান্ডের ছায়ায় নিজের ফুটবলীয় দক্ষতাকে ঝালাই করতে থাকা হুলিয়ান আলভারেজ কাতার বিশ্বকাপে সুযোগ পেয়েছেন সর্বকালের অন্যতম সেরা ফুটবলার লিওনেল মেসির সঙ্গী হয়ে খেলার। দুজনের কাছ থেকেই যে সেরা ফুটবলার হওয়ার তালিম নিচ্ছেন তিনি তাতে কোনো সন্দেহ নেই। গত ৩০ নভেম্বর গ্রুপ পর্বের তৃতীয় ম্যাচে যখন পোল্যান্ডের বিপক্ষে জয় ছাড়া কোনো বিকল্প ছিল না আর্জেন্টিনার, তখনই বিশ্বকাপে নিজের প্রথম গোলটি করেন এই ম্যানসিটি তারকা। এরপর শনিবার (৩ ডিসেম্বর) নকআউট পর্বে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে করেন দ্বিতীয় গোল। মাঠে মেসি-আলভারেজের উল্লাস ও উদযাপনের দৃশ্য ইতোমধ্যেই সমর্থকদের নজর কেড়েছে।
নিজের প্রথম বিশ্বকাপে দুর্দান্ত গতিতে যাত্রা শুরু করেছেন আলভারেজ। কোপা লিবার্তাদোরেসে এক ম্যাচেই ছয় গোল করা আলভারেজকে দেখে মনে হবে, বিশ্বকাপের মতো বড় মঞ্চে নিজেকে প্রমাণ করতেই তার জন্ম! আর এই মুহূর্তে তিনি খেলছেন স্বপ্নের তারকা লিওনেল মেসির সাথে একই মাঠে! গোল করতেই মেসি জড়িয়ে ধরছেন আলভারেজকে, এর চেয়ে সুন্দর অনুভূতি আর কী হতে পারে একজন উদীয়মান তারকার জন্য!
শনিবার অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ২-১ গোলে জিতে কোয়ার্টার ফাইনাল নিশ্চিত করার পর আলভারেজ বলেন, "এটা আমার জন্য ভীষণ আনন্দের। আমি যেখানেই খেলি না কেন, সবসময় দলকে সাহায্য করতে নিজের সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করি। আমরা এই জয়ের ধারা অব্যাহত রেখেই আর্জেন্টাইনদের খুশি করতে চাই।"
কাতার বিশ্বকাপে আর্জেন্টাইন তারকা লাউতারো মার্তিনেজ সেন্টার ফরোয়ার্ড হিসেবে শুরুর একাদশে জায়গা করে নিতে ব্যর্থ হওয়ায় মাঠে নামার সুযোগ পেয়েছেন আলভারেজ। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে বদলি হিসেবে লাউতারো মার্তিনেজকে নামানোর পর এই দুজনের পারফরমেন্সের পার্থক্যও সবার স্পষ্ট চোখে পড়েছে। ম্যাচে দারুণ দুটি সুযোগ মিস করেছেন মার্তিনেজ এবং শেষের দিকে প্রায় ড্র হওয়ার চাপে পড়েছিল আর্জেন্টিনা। অন্যদিকে, আলভারেজ অস্ট্রেলিয়ার গোলকিপারকে বোকা বানিয়ে সুযোগ কাজে লাগিয়ে ঠিকই গোল করেছেন। তার এই গোলই প্রমাণ করে দিয়েছে তিনি কোন মাপের খেলোয়াড়।
অস্ট্রেলিয়ার গোলকিপার ম্যাথিউ রায়ান যখন গোলবারের ঠিক সামনে থেকে তার দলের খেলোয়াড়কে বল পাস দিতে যাচ্ছিলেন, সেই মুহূর্তে ডি পলের প্রেশারে কিছুটা বেসামাল হয়ে পড়ায় তার পা থেকে বল কেড়ে নিয়ে নিখুঁত ফিনিশিংয়ে গোল দিয়ে বসেন আলভারেজ।
বিশ্বকাপের সেমি-ফাইনালেও ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে দাপট দেখিয়েছে আর্জেন্টিনা, ৩-০ গোলে উড়িয়ে দিয়েছে মদরিচ-পেরিসচদের। আর এখানেও আর্জেন্টিনার জয়ের অন্যতম নায়ক হুলিয়ান আলভারেজ। জাদুকর মেসির অনবদ্য পারফরমেন্স এবং সাথে আলভারেজের নৈপুণ্য, ক্রোয়াটদের জালে রীতিমতো গোল উৎসব করেছেন তারা।
প্রথমার্ধেই দুই গোলে এগিয়ে যায় আর্জেন্টিনা। হুলিয়ান আলভারেজ বল নিয়ে ক্রোয়েশিয়ার গোলকিপার দমিনিক লিভাকোভিচের প্রায় সামনে চলেই এসেছিলেন, শুধু গোল দেওয়ার অপেক্ষা। এমন সময় তাকে ফাউল করে বসেন মাতেও কোভাসিচ এবং লিভাকোভিচ দুজনেই। ফলে দুজনেই হলুদ কার্ড দেখেন এবং পেনাল্টি পায় আর্জেন্টিনা। ম্যাচের ৩৪ মিনিটে পেনাল্টি থেকে গোলটি করেন মেসি। এর পাঁচ মিনিট পরেই ব্যবধান দ্বিগুণ করেন হুলিয়ান আলভারেজ। কোনোরকম পাসের ধার ধারেননি, ৩৯ মিনিটে একাই ছুটে গিয়ে ক্রোয়েশিয়ার একাধিক ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে, গোলরক্ষক লিভাকোভিচকে ফাঁকি দিয়ে বল জালে জড়ান তিনি। ইতোমধ্যেই আলভারেজের এই গোলকে টুর্নামেন্টের অন্যতম সেরা গোল হিসেবে বিবেচনা করছেন অনেকে।
এরপর ৬৯ মিনিটে মেসি তার একক কৃতিত্বে ক্রোয়েশিয়ান ডিফেন্ডার ভার্দিওলকে রীতিমতো নাকানিচুবানি খাইয়ে, বল নিয়ে ডি-বক্সে ঢুকে পাস দেন আলভারেসকে, আলতো টোকায় ব্যবধান ৩-০ করেন ম্যানসিটি তারকা।
ট্যাপ-ইন, কার্লার, লিং-আপ প্লে, প্রেসিং করে খেলা- সব মিলিয়ে ২২ বছর বয়সী আলভারেজের মধ্যে রয়েছে ভালো খেলার ও জয়ের ক্ষুধা। তাই পেপ গার্দিওলা যে রত্ন চিনতে ভুল করেননি তা বলাই যায়। আর সে কারণেই হালান্ডের পরেই স্ট্রাইকার হিসেবে তিনি দ্বিতীয় স্থানে রাখেন এই তরুণ আর্জেন্টাইনকে, এমনকি গ্যাব্রিয়েল জেসুস বিদায় নিলেও তার কোনো সমস্যা ছিল না!
আলভারেজ এবং ব্রাজিলিয়ান তারকা গ্যাব্রিয়েল জেসুসের মধ্যে অবশ্য একটি মিল রয়েছে, তা হলো এরা দুজনই ডিফেন্ডারদের এক সেকেন্ডের জন্যও ফুসরত দেন না। কিন্তু পার্থক্য হচ্ছে দুজনের গোল স্কোরের ক্ষমতায়, যেখানে আলভারেজের ফিনিশিং জেসুসের চেয়ে ভালো বলে প্রতীয়মান হয়েছে।
এদিকে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচে আর্জেন্টাইন ভক্তদের বেশ হতাশ করেছেন লাউতারো মার্তিনেজ। গোলবারের কাছাকাছি এসে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছেন, চমৎকার অ্যাসিস্ট পাওয়া সত্ত্বেও গোল করতে পারছেন না। তার এই পারফরমেন্সের কারণে আর্জেন্টিনার স্কোর সংখ্যা বড় হতে পারেনি, অস্ট্রেলিয়াও তাই কোয়ার্টার ফাইনালে যাওয়ার স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছিল। এমনকি শেষ মিনিটে আর্জেন্টিনার ডিফেন্স ভেঙে অস্ট্রেলিয়ার জোরাল আক্রমণ যদি গোলকিপার এমিলিয়ানো মার্তিনেজ না ঠেকাতেন, তাহলে কাতারের আহমাদ বিন আলী স্টেডিয়ামে উল্লাস করতে পারতো না আর্জেন্টিনা।
তবে সমালোচকদের সুরে তাল মেলাননি আর্জেন্টিনার কোচ লিওনেল স্কালোনি। ম্যাচ শেষে তিনি বলেন, "লাউতারো আমাদের অনেকবার সাহায্য করেছে, তাই এক ম্যাচের জন্য আমি তার নিন্দা করাটা ঠিক হবে না। সে অবশ্যই দলকে সাহায্য করবে এবং আমাদের খুশি করবে।"
স্কালোনির কথায় যে যুক্তি আছে তা পরিসংখ্যান দেখলেই বোঝা যায়। নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে টাইব্রেকারে শেষ জয়সূচক গোলটি করেছেন লাউতারোই। ২০১৮ বিশ্বকাপের পর আর্জেন্টিনার দায়িত্ব নেন স্কালোনি, এরপর থেকে এক নতুন আর্জেন্টিনাকে দেখতে পেয়েছে ভক্তরা। তখন থেকে লাউতারো ছিলেন স্কালোনির অন্যতম তুরুপের তাস। ২১ গোল করে মেসির পর কোচের ভরসার জায়গা ছিলেন এতদিন মার্তিনেজই, গত কোপা আমেরিকায়ও দুর্দান্ত পারফরমেন্স দেখিয়েছেন তিনি।
তবে এবার পাশার দান উল্টে গেছে, এবার নিজেকে প্রমাণের সুযোগ পাচ্ছেন তরুণ হুলিয়ান আলভারেজ। আর্জেন্টিনাকে তাদের তৃতীয় বিশ্বকাপ শিরোপা জেতাতে আর মেসির সর্বকালের সেরা হওয়ার বিতর্ক থামিয়ে দিতে আলভারেজই এখন নেতৃত্বের সম্মুখ সারিতে।
"আমরা সবসময় তাকে (মেসি) তার স্বপ্ন পূরণের জন্য সর্বোচ্চ সহায়তা করবো। এখানের পরিবেশে আমাদের ঘরের অনুভূতি বোধ হয়। যতগুলো স্টেডিয়ামে খেলেছি, বেশিরভাগ দর্শকই ছিল আর্জেন্টিনার। পুরো নব্বই মিনিটই তারা আর্জেন্টিনার জন্য গান গায়, এত এত সমর্থকদের নিঃশ্বাসের শব্দও আমরা অনুভব করি!" বলেন হুলিয়ান আলভারেজ।
- সূত্র: এপি