ঢাকার মেয়ে ফারিয়াতে তপ্ত ইউরোপের ফুটবল ও ইংল্যান্ড দলের কোচ-কাহিনি!
১৭৫৭ সালে প্রকাশিত একটি ডাইরেক্টরি ৩০ বছর লন্ডনের বেস্ট সেলার্স লিস্টে অবস্থান করেছে। এটি ছিল যৌনকর্মীদের ডাইরেক্টরি। ম্যানুয়েল ডেরিক নামের একজন কবি কাব্যচর্চায় তেমন খ্যাতি অর্জন করতে না পেরে প্রকাশ করেন 'হ্যারিস লিস্ট অব কভেন্ট গার্ডেন লেডিস'—এই নারীদের বড় অংশ লন্ডনের সেক্সডিস্ট্রিক্ট হিসেবে খ্যাত কিংবা কুখ্যাত সোহো অঞ্চলের। ১৮৩৫ সালে ক্যাথেরিন আর্নল্ডস লিখলেন 'সিটি অব সিন: লন্ডন অ্যান্ড ইটস ভাইসেস'। তার গবেষণায় উঠে এল লন্ডন শহরের ৪০০ ব্যক্তি যৌনকর্মী বানানোর উদ্দেশ্যে বিশেষ করে সোহো অঞ্চলে নিয়োগ করার উদ্দেশ্যে ১১ থেকে ১৫ বছর বয়সী মেয়েদের জোগাড় করে থাকেন। 'সেক্স ডিস্ট্রিক্ট' নাম ঘোচাতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। পুরোনো সব স্থাপনা ভেঙে লন্ডনে বহুতল স্থাপনা প্রতিষ্ঠিত করতে হয়।
এমনি এক স্থাপনা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের (এফএ) সদর— দপ্তর ২৫ নম্বর সোহো স্কোয়ার, ২১ নম্বর সোহো স্কোয়ার হচ্ছে ম্যানর হাউস, যৌনবাণিজ্যের অন্যতম পুরোনো ভবনটি লিস্টেড বিল্ডিং হিসেবে সংরক্ষণ করা হয়েছে। এই অঞ্চলটি ঘুরে দেখার সুযোগ নিবন্ধকারের হয়েছে।
২০০৪-২০০৫ সোহো মাতিয়ে তোলেন কিংবা সোহোকে আবার আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে আসেন ঢাকার মেয়ে ফারিয়া। অবশ্যই যৌনকর্মী হিসেবে নয়, প্রেমিকা হিসেবে, শয্যাসঙ্গিনী।
ইউরোপিয়ান ফুটবলের অন্যতম ঘাঁটি এফএ কার্যালয়। ইংল্যান্ড ফুটবলের প্রাণকেন্দ্র। বিশ^সেরা ফুটবলার কোচ ও ব্যবস্থাপকদের যৌন অনাচার ও কেলেঙ্কারি নিয়ে ২০২১ সালে ৭০০ পৃষ্ঠার একটি অভ্যন্তরীণ তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল হয়েছে। এতে এরিকসন ফারিয়া সেক্স স্ক্যান্ডালের কথা কেবল সূত্র হিসেবে বলা হয়েছে।
বর্ণনার জন্য নির্ভর করতে হয়েছে ২০০৪-২০০৫ এবং পরবর্তী সময়ের কিছু বিলেতি পত্রিকার ওপর।
ফারিয়ার জন্ম ঢাকাতে ১৯৬৬ সালে। বাবা ছিলেন ব্যাংকার। ১৯৭০ সালে অভিবাসী হয়ে ব্রিটেন গমন করেন। সাথে স্ত্রী, দুই পুত্রসন্তান এবং কন্যা ফারিয়া আলম। তারা ব্র্যাডফোর্ড এবং নর্থাম্বারল্যান্ডে অনেক বছর কাটান। ধর্মীয়ভাবে রক্ষণশীল মুসলমান পরিবার। অল্প বয়সেই ফারিয়াকে একজন বাংলাদেশি ব্যবসায়ীর সাথে বিয়ে দেওয়া হয়। বিয়েটা সুখকর ছিল না। ফারিয়া বৈবাহিক সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসেন। এদিকে ফারিয়ার মাও তার বাবাকে তালাক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে সিয়াটল চলে যান।
সংবাদপত্রের ভাষ্য, ফারিয়া লন্ডনে আসেন এবং বেপরোয়া পার্টি জীবনে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন। তিনি কিছু কম গুরুত্বপূর্ণ মডেলিংয়ের কাজেও অংশ নেন। ২০০৩ সালে তিনি চাকরির সন্ধানে সোহো ডিস্ট্রিক্টে অবস্থিত এফএ হেডকোয়ার্টারে আবেদন করেন। ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাহী পরিচালক ডেভিড ডেভিসের পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট বা ব্যক্তিগত সহকারীর চাকরি পেয়ে যান। অত্যন্ত সুদর্শনা ফারিয়া আলম নিজের জায়গা করে নেন এফএ-তে।
এফএর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মার্ক প্যালিউস তার প্রেমে পড়েন। ফারিয়া তাতে সাড়া দেন। এর মধ্যে প্রধান ব্রিটিশ ফুটবল কোচ স্ভ্নে গোরান এরিকসনও তার প্রতি আকৃষ্ট হতে শুরু করেন। নাম না বললেও একটি সম্পর্কে জড়িয়ে আছেন বলে ফারিয়া তাকে জানান। এরিকসনের তাতে আগ্রহে ঘাটতি দেখা দেয়নি। ফারিয়াও অধিকতর আবেদনময় এবং অধিকতর পরিচিত এরিকসনের সাথে সম্পর্কটি ক্রমেই উষ্ণতর করে তোলেন। এফএ সদর দপ্তরের আরও কেউ কেউ তার প্রতি দুর্বল হয়ে থাকতে পারে কিংবা তিনি আরও কাউকে কাউকে হয়তো প্রশ্রয় দিতে শুরু করেছেন। এরকম এক অবস্থায় ফারিয়ার ফোন হ্যাকড হতে থাকে। এফএর অভ্যন্তরীণ একটি দলাদলিও তখন তুঙ্গে। ডেভিড ডেভিসের সাথেও এরিকসনের সম্পর্ক ভালো যাচ্ছিল না। ফারিয়া এরিকসনের সাথে সেইমুর হোটেলে ক্রমাগত যে রাত কাটাচ্ছেন, তা-ও হ্যাকারদের জানা হয়ে যায়।
গরম খবর তৈরি করতে পারঙ্গম 'নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড' পত্রিকার হাতে ফারিয়ার বহুমুখী সম্পর্কের বিশেষ করে কোচ এরিকসনের সাথে সম্পর্কের অনেক প্রমাণ এসে যায়।
তারা ফারিয়ার সাক্ষাৎকার নিতে চায়, তিনি অস্বীকার করেন। তারা ডেভিড ডেভিসের কাছে প্রমাণসহ হাজির হয়। ডেভিড তার একান্ত সহকারী ফারিয়া আলমকে হুকুম দেন, সবকিছু পত্রিকাকে বিষদভাবে জানিয়ে দাও। ফারিয়া অস্বীকৃতি জানালে তিনি ডেভিডের মৌখিক 'অ্যাবিউজের' শিকার হন। ততক্ষণে মধ্যবর্তী মিডিয়া এক্সপার্ট দালালের আবির্ভাব ঘটে। শারীরিক সম্পর্কের বিবরণসহ সাক্ষাৎকার বিস্তারিতভাবে দিলে 'নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড' তাকে হ্যান্ডসাম অ্যামাউন্ট দেবে, এ প্রস্তাব আসে।
বসের আদেশ না শুনলেও টাকা পাবার সম্ভাবনা ফারিয়াকে প্রলুব্ধ করে। সাক্ষাৎকারের আগেই প্রথম কিস্তিতে তিনি দেড় লক্ষ পাউন্ড পেয়েছেন বলে মনে করা হয়। তার প্রাপ্য অর্থ পাঁচ লক্ষ পাউন্ড বলে প্রচারিত হলেও পরবর্তী সময়ে মোট অর্থের পরিমাণ ৪ লক্ষ ১০ হাজার পাউন্ড বলে তিনি নিজেই উল্লেখ করেন।
সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হবার পর পরই মার্ক পলিউস এবং অপর একজন পদত্যাগ করেন। মার্ক পলিউস বলেন, তিনি পাঁচ সন্তানের জনক। এই কলঙ্কিত পরিচিতি নিয়ে এখানে তিনি থাকতে চান না।
ফারিয়ার সংকটকালে এরিকসন তার কাছ থেকে সরে যান। ফারিয়া 'নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড'কে এরিকসনের সাথে তার সহবাসের গ্রাফিক বর্ণনা দেন। তিনি নিজে এফএ থেকে পদ্যাগ করেন এবং এরিকসনেরও পদত্যাগ করা উচিত বলে মন্তব্য করেন। কিন্তু এরিকসন পদত্যাগে সম্মত হননি। তিনি প্রধান কোচের পদটি শেষ পর্যন্ত হারান।
২০০৭ সালে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জনের জন্য তিনি লন্ডন ছেড়ে কানাডা চলে যান। তবে পেছনের কারণটি আর একটু রসাল। একটি পত্রিকা ফারিয়াকে সবচেয়ে দামি যৌনকর্মীদের একজন বলে বর্ণনা করে এবং তার রেট রাতপ্রতি ৮০০০ পাউন্ড বলে উল্লেখ করে। ফারিয়া যাবার আগে গণমাধ্যমকে বলে যান, এরিকসনসহ সকলেই তাকে ব্যবহার করেছেন, তিনি বুঝতে পারেননি যে ব্যবহৃত হচ্ছেন। তিনি বলেন, যার সাথেই আমার সম্পর্ক থাকুক, সেটা তার-আমার মধ্যকার ব্যাপার। কিন্তু এটাকে স্ক্যান্ডাল বানিয়েছে ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন। এ ধরনের বিষয় হ্যান্ডেল করার দক্ষতা তাদের নেই।
তিনি এরিকসনের নির্লিপ্ততাকে অপৌরষেয় বলে বর্ণনা করেন। স্টার অব দ্য ওয়ার্ল্ড সাক্ষাৎকারে তিনি মুম্বাইয়ের চিত্রনায়ক সালমান খানের সাথে প্রেমের সম্পর্কের দাবি করেন। সালমান উল্টো জিজ্ঞেস করে, ফারিয়া কে? কোন ফারিয়া?
ফারিয়া-এরিকসনের অ্যাফেয়ার শুধু লন্ডন নয়, গোটা ইউরোপের মাঠ গরম করে দিয়েছিল।
ফারিয়া এখন কানাডাতে বসবাস করছেন। দুটি শহরে থাকেন, চ্যারিটিতে কাজ করেন। ধর্মকর্মে ফিরে গেছেন। তিনি লন্ডনে আর ফিরতে চান না। তবে ঢাকা থেকে সোহো পর্বটি যেকোনো বাঙালি নারীর জন্য বিশাল চ্যালেঞ্জ।