ক্রোয়েশিয়া: ফুটবল যেখানে যুদ্ধের সমান
কাতার বিশ্বকাপে খেলা দেশগুলোর মধ্যে জনসংখ্যার দিক থেকে চতুর্থ ক্ষুদ্রতম ক্রোয়েশিয়া। ২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলা দলটি এবারও উঠে গেছে সেমি-ফাইনালে। শেষ আটে সবথেকে বড় ফেভারিট ব্রাজিলকে টাইব্রেকারে হারিয়ে পরপর দুই বিশ্বকাপের সেমি-ফাইনাল নিশ্চিত করেছে বলকান দেশটি।
২০১৮ বিশ্বকাপে ক্রোয়েশিয়ার ফাইনালে উঠাকে অনেকেই 'ঝড়ে বক মরা' হিসেবে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু কাতারেও সেমি-ফাইনালে পৌঁছে নিজেদের শক্তি-সামর্থ্যের প্রমাণ আরো একবার দিয়েছেন লুকা মদ্রিচরা। আর্জেন্টিনাকে হারাতে পারলে পরপর দুই বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলার কৃতিত্ব অর্জন করবে ক্রোয়াটরা।
অবশ্য বিশ্বকাপের সেমি-ফাইনাল ক্রোয়েশিয়ার জন্য ২০১৮ তেও নতুন কিছু ছিল না। ১৯৯৮ বিশ্বকাপে প্রথমবার খেলতে এসেই ৩য় হয়েছিল তারা, সেই দলের প্রাণ ছিলেন কিংবদন্তি ডেভর সুকার।
বর্তমান কোচ জলাতকো দালিচ দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই ক্রোয়েশিয়ার ধারাবাহিকতা চোখে পড়ার মতো। দালিচের সময়ে ফিফা র্যাংকিংয়ে তার দল কখনোই ১৫ এর নিচে নামেনি। নিয়মিতই বিশ্বকাপ, ইউরোর মতো বড় আসরের নক-আউট পর্ব খেলেছে ক্রোয়েশিয়া।
২০১৮ বিশ্বকাপ দলের মারিও মান্দজুকিচ, সুবাসিচরা নেই এবার। তবে যোগ হয়েছেন লিভাকোভিচ, গাভারদিওলের মতো তরুণেরা। আর চিরসবুজ লুকা মদ্রিচ তো ছিলেন প্রতিবারই। তাই ক্রোয়েশিয়াকে ছোট দল হিসেবে মনে করে ভুল করার কিছু নেই। ফুটবলের নিয়মিত খোঁজ-খবর যারা রাখেন, পেরিসিচ, কোভাচিচ, ব্রোজোভিচদের তারা খুব ভালো করেই চিনে থাকবেন।
সার্বিয়ার অংশ থাকাকালীন গৃহযুদ্ধ ছিল ক্রোয়েশিয়ার নিত্যসঙ্গী। এই ক্রোয়েশিয়া দলের বেশিরভাগ খেলোয়াড়েরাই সেই যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে জন্মেছেন। অনেকে সরাসরি যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখেছেন, তাদেরই একজন, ক্রোয়েশিয়া অধিনায়ক লুকা মদ্রিচ।
১৯৯০ সালে সার্বিয়া থেকে স্বাধীনতা লাভ করে ক্রোয়েশিয়া, অত্যাচারি সার্বদের বিপক্ষে যুদ্ধ দেখেই বড় হয়েছেন মদ্রিচ। রিফিউজি ক্যাম্প থেকেই একদিন ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। তবে তিনি যে এত বড় মাপের খেলোয়াড় হবেন আর ক্রোয়েশিয়ার সর্বকালের সেরা হিসেবে তার নাম উচ্চারিত হবে, তা নিশ্চয়ই ভাবেননি মদ্রিচ।
২০১৮ বিশ্বকাপে ব্যক্তিগতভাবে দুর্দান্ত খেলে দলকে ফাইনালে নিয়ে গিয়েছিলেন, সেখানে ফ্রান্সের বিপক্ষে পেরে উঠেননি। তবে মদ্রিচই জিতেছিলেন সেই বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার। ক্লাব ফুটবলে রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতায় ব্যালন ডি'অর পান তিনি।
তার অর্জনটা কত বড় সেটি বুঝতে একটি তথ্যই যথেষ্ট। মেসি এবং রোনালদোর বাইরে ২০০৮ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ব্যালন ডি'অর জেতা একমাত্র খেলোয়াড় মদ্রিচ। কোনো ক্রোয়াট একদিন বিশ্বের সেরা খেলোয়াড় হবেন, সেটি কী একজন ক্রোয়াটও ভেবেছিলেন?
ফুটবলকে ক্রোয়াটরা দেখে জাতীয়তাবাদের অংশ হিসেবে। নিজেদের ঘরোয়া ক্লাব ফুটবলের প্রতিটি ম্যাচও যেন তাদের জন্য উৎসবের মতোই। বিভিন্ন দলের সমর্থকেরা নিজ নিজ দলের সমর্থনে হেন কাজ নেই যা তারা করেন না।
কথিত আছে, গৃহযুদ্ধের শুরুটাও হয়েছিল একটি ফুটবল ম্যাচকে কেন্দ্র করেই! সেই ম্যাচে মুখোমুখি হয়েছিল দিনামো জাগরেব, যারা তৎকালীন তো বটেই, এখন পর্যন্ত ক্রোয়েশিয়ার সবথেকে সফল ক্লাব এবং রেড স্টার বেলগ্রেড, সার্বিয়ার অন্যতম সফল ক্লাব।
দুই দলের খেলোয়াড়েরা খেলতে নেমেছিলেন দুই ভিন্ন জাতীয়াবাদকে সামনে রেখে। নিজ নিজ জায়গা থেকে নিজ জাতীয়তাবাদ রক্ষার লড়াইও যেন ছিল সেই ম্যাচটি। সেখানেই শুরু হয় গন্ডগোলের।
ম্যাচের এক পর্যায়ে জাগরেবের ক্রোয়াট খেলোয়াড় জোভোনির বোবান একজন নিরাপত্তাকর্মীকে লাথি মেরে বসেন! লাথি মারার পেছনে বোবান কারণ দেখিয়েছিলেন নিরাপত্তাকর্মীর সার্বিয়া প্রীতি। যে লাথির পরই পরিস্থিতি উত্তেজিত হয়ে শুরু হয় এক যুদ্ধের।
আজ পর্যন্ত বোবানের সেই বিখ্যাত লাথির ছবি দেখিয়ে বলা হয়, 'যে লাথি একটি যুদ্ধের সূচনা ঘটিয়েছিল'।
ক্রোয়েশিয়াতে একেকজন খেলোয়াড় যেন একেকজন যোদ্ধার মতোই। তাদেরকে দেখাও হয়ে সেই চোখে, তারা প্রত্যেকেই ক্রোয়াট জাতীয়তাবাদ ধারণকারী। ক্রোয়াটদের কাছে তাই তাদের দেশের ফুটবলাদের স্থান সবথেকে উপরে।
এমন একটি দেশ থেকে উঠে এসে বিশ্বমঞ্চে নিজেদের নাম সবার চূড়ায় স্থাপন করার থেকে আর মাত্র দুই ধাপ দূরে মদরিচ-লিভাকোভিচরা। ২০১৮ তে খুব কাছে এসেও অল্পের জন্য হয়নি, এবার সেই আক্ষেপ ঘুচিয়ে ক্রোয়েশিয়ান পতাকাকে সর্বোচ্চ উচ্চতায় তুলে ধরতে চাইবেন দালিচ এবং তার দল।