যে দল হারতে নারাজ: আর্জেন্টিনা কি পারবে ক্রোয়েশিয়াকে হারাতে?
জলাতকো দালিচ জানতেন যে কিছু পরিবর্তন করতে হবে। ক্রোয়েশিয়ার কোচ দালিচ যদিও ঠিক নিশ্চিত ছিলেন না, ঐ মুহূর্তে ঠিক কী পরিবর্তন করতে হবে। ব্রাজিল চাপ বাড়াতে শুরু করেছে, তাদের উজ্জ্বল হলুদ জার্সিগুলো ঢেউয়ের মতো সামনে এগোচ্ছে। ক্রোয়েশিয়া দল আক্রমণ প্রতিহত করতে মরিয়ে হয়ে উঠলেও তিনি দেখতে পাচ্ছিলেন তার খেলোয়াড়রা একেবারে নেতিয়ে পড়েছে।
তার মাথায় প্রথমেই যে জিনিস আসলো, তা হলো তার তাজা পা দরকার। বিশেষ করে তার সবচেয়ে মূল্যবান মিডফিল্ড - লুকা মদ্রিচ আর তার দুই অদম্য সহকারী, মার্সেলো ব্রোজোভিচ আর মাতেও কোভাসিচ, ইতিমধ্যেই নিজেদের শক্তির সীমা ছাড়িয়ে মাঝমাঠ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে। তিনি এবং তার স্টাফরা বুঝেছিলেন যদি তাজা পা আনাও হয়, তাতে শক্তি বাড়লেও গুণমান কমে যাবে।
খেলার বিরতিতে, দালিচ ক্রোয়েশিয়ার অধিনায়ক মদ্রিচকে সাইডলাইনে ডেকে পাঠিয়ে জানালেন তিনি মিডফিল্ডে বদলি খেলোয়াড় নামানোর কথা ভাবছেন। তিনি কী ভেবেছিলেন? মদ্রিচের উত্তর কী হতে পারে তা দালিচের জানা উচিত ছিল। ৩৭ বছর বয়সী মদ্রিচ হাল ছাড়তে নারাজ।
মদ্রিচ লেগে রইলেন। সময় যখন অতিরিক্ত সময়ের গড়ালো, তিনি সেখানে ছিলেন। খেলাকে পেনাল্টি পর্যন্ত পাঠানো ব্রুনো পেতকোভিচ সমতা আনার সময়েও তিনি সেখানে ছিলেন। এবং ছিলেন তৃতীয় স্পট-কিকের সময়ও, যখন পেনাল্টি থেকে গোল করে চার মিলিয়নেরও কম জনসংখ্যার দেশকে টানা দ্বিতীয়বার বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে নিয়ে গেলেন।
'এটাই ক্রোয়েশিয়া, যখন সবকিছু কঠিন হয়ে পড়বে, তখনই তারা এগিয়ে আসবে,' বলে জানান দালিচ।
এই অদম্যতা, এই হাল না ছাড়া মনোভাব ক্রোয়েশিয়ার মূল হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। ২০১৮ সালে বিশ্বকাপের ফাইনাল ছাড়া আর্জেন্টিনার বিপক্ষে সেমিফাইনাল খেলার আগ পর্যন্ত গত দুই বিশ্বকাপে ক্রোয়েশিয়া পাঁচটি নকআউট ম্যাচ খেলেছে। পাঁচটিই গিয়েছে অতিরিক্ত সময়ে, যার মধ্যে চারটি গিয়েছে পেনাল্টি পর্যন্ত। ক্রোয়েশিয়া জিতেছে সবগুলো। এটি এমন এক দলে পরিণত হয়েছে যেটি তার প্রতিপক্ষকে হারাতে না পারলেও টিকে থাকার দৌড়ে প্রতিপক্ষকে ছাড়িয়ে যায়।
ডিফেন্ডার বোর্না সোসা জানালেন, "আমরা জানি কেউ আমাদের বিরুদ্ধে খেলতে পছন্দ করে না। আমাদের ভাল খেলোয়াড় ছাড়াও ভালো মানসিকতাও রয়েছে। তাই আমাদের বিরুদ্ধে জেতা সবসময়ই কঠিন। আমরা শেষ পর্যন্ত যেতে প্রস্তুত।"
এই অদম্যতার উৎসের পেছনে বিভিন্ন ব্যাখ্যা রয়েছে। মদ্রিচ এবং গোলরক্ষক ডোমিনিক লিভাকোভিচ উভয়ই টুর্নামেন্ট চলাকালীন বিভিন্ন সময়ে স্পষ্টভাবে তাদের দেশের সাম্প্রতিক স্বাধীনতার সংগ্রামের কথা বলেছেন, যা তাদের দুজন চাহড়া হাতেগোনা কয়েকজনই সরাসরি দেখার অভিজ্ঞতা রয়েছে।
"আমরা একটি জাতি হিসাবে আমাদের স্বাধীনতার জন্য অনেক লড়াই করেছি, এবং আমরা শেষ বিন্দুর জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি," মদ্রিচ জানালেন। তার বয়স যখন মাত্র ৬ বছর, যুদ্ধ থেকে বাঁচতে তার পরিবার তখন ক্রোয়েশিয়া থেকে পালিয়ে যায়। তার দাদাকে সার্বিয়ান সৈন্যরা হত্যা করেছিল। তার ছোট সতীর্থরাও যুদ্ধের ছায়ায় বড় হয়েছে। "আমাদের এভাবেই বড় করা হয়েছে," লিভাকোভিচ বলেছেন।
স্বাধীন জাতি হিসেবে ক্রোয়েশিয়ার প্রথম বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ ১৯৯৮ সাল, ডেভর সুকার, রবার্ট প্রোসিনেকি, জভোনিমির বোবানের মতো খেলোয়াড়রা ক্রোয়েশিয়াকে প্রথম সুযোগেই নিয়ে যান সেমিফাইনাল পর্যন্ত। বোবান বলেন, এই অর্জন কেবল আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে ক্রোয়েশিয়ার প্রথম আত্ম-প্রকাশ হিসেবেই কাজ করেনি, এটি নিশ্চিত করেছে যে আমাদের মূল্যবোধ অনেক গভীর।
"ক্রোয়েশিয়ান সমাজ ফুটবলের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। এটি আমাদের সংস্কৃতির এতটাই গভীরে যে এটি ক্রোয়েশিয়ান সমাজের মূল জিনিস। আমাদের প্রজন্ম একটা কাল্ট তৈরি করেছে এবং পরবর্তী প্রজন্ম সেটাকে অনুসরণ করেছে।"
ক্রোয়েশিয়ার রেকর্ডও সেটিই বহন করে। ১৯৯৮ এবং ২০১৮ সালের মধ্যে ক্রোয়েশিয়া কখনোই বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্বের বাইরে যেতে পারেনি, সাথে ইউরোপীয় চ্যাম্পিয়নশিপেও তারা কখনো নকআউট খেলা জেতেনি। যদিও ২০০০ সালের ইউরো এবং ২০১০ সালের বিশ্বকাপ ছাড়া, তারা এই সময়ের প্রতিটি বড় টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করেছে। আপাতদৃষ্টিতে সাফল্য মনে না হলেও তুলনা করলে ক্রোয়েশিয়ার আকারের অন্যান্য দেশের তুলনায় তারা বেশ এগিয়ে রয়েছে।
নরওয়ে এই শতাব্দীতে বিশ্বকাপে যেতে পারেনি। আয়ারল্যান্ডও ২০০২ সালের পর তা করতে পারেনি। দুটো দেশেই ক্রোয়েশিয়ার চেয়ে এক মিলিয়ন বেশি লোকের বাসস্থান। এমনকি ২০০৪ সালে ইউরোজয়ী দল গ্রিসের জনসংখ্যাও ক্রোয়েশিয়ার দ্বিগুণেরও বেশি এবং গত আটটি বিশ্বকাপের মধ্যে মাত্র তিনটিতে তারা অংশ নিতে পেরেছে।
বিপরীতে, ক্রোয়েশিয়া কেবলই একটি নিয়মিত দল হয়ে ওঠেনি, বরং একটি সত্যিকারের শক্তি হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। পুরনো খেলোয়াড় নয়, নতুন খেলোয়াড়দেরকে নিয়েই আবারো তারা নিজেদের প্রমাণ করেছে। "আমাদের ১৮ জন নতুন খেলোয়াড় আছে, অনেকেই প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ খেলছে। এটা মোটেও কোনো পার্থক্য গড়ে দেয়নি," বলে জানিয়েছেন সোসা।
এটি শুধু দেশের একাডেমি থেকে উঠে আসা খেলোয়াড়দের নিয়মিত প্রবাহের প্রমাণ নয়, এটি জেনেটিক্স, পরিবেশ বা ভূগোলের প্রভাবও হতে পারে, তবে আমাদের দলে প্রচুর প্রতিভা আছে," জানান বোবান।
ক্রোয়েশিয়ার প্রায় প্রতিটি তরুণ খেলোয়াড় তাদের ক্যারিয়ারের প্রথম দিকে ক্রোয়েশিয়ার দুটো দুর্দান্ত ক্লাব, ডায়নামো জাগরেব কিংবা হাজদুক স্প্লিটে সময় কাটায়। যার অর্থ জাতীয় দলে তারা পরিচিত মুখগুলোরই দেখা পান।
দলের মধ্যে কোন র্যাংকিং চোখে পড়ে না, এমনকি একেবারেই নতুন খেলোয়াড়দেরও নেতৃত্ব দিতে উৎসাহিত করা হয়। দালিচও কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম-রীতি ঠিক করে দেননি, তবে মদ্রিচ এবং অন্যান্য সিনিয়র খেলোয়াড়দের উদাহরন দেখিয়ে তরুণ খেলোয়াড়দের কাছ থেকে কী চাওয়া হচ্ছে তা প্রচ্ছন্নভাবে বুঝিয়ে দেওয়া হয়।
এই প্রত্যাশাগুলো এত বেশি যে সোসা জানান, "দলটির লক্ষ্য 'গোল উদযাপন নয়, বরং জয় উদযাপন করার' নীতি গ্রহণ করেছে।" বোবানের মতে, এটাই ক্রোয়েশিয়ার সাফল্যের চূড়ান্ত উপাদান।
এখন, চার বছরে দ্বিতীয়বারের মতো ক্রোয়েশিয়া অসম্ভবকে সম্ভব করার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে। আর্জেন্টিনার বিপক্ষে জয় দেশটিকে নিয়ে যাবে টানা দ্বিতীয় বিশ্বকাপের ফাইনালে। বিশ্বকাপে যে দল হারতে নারাজ, তারা কি শেষ পর্যন্ত আবারও তা করে দেখাবে?
সূত্র: দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস