মেসিই কি সর্বকালের সেরা? বিতর্কের অবসান ঘটবে কাতার বিশ্বকাপে?
কে সর্বকালের সেরা ফুটবলার? বহু ধরে তুলনাটা হতো শুধু ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি পেলে ও আর্জেন্টাইন কিংবদন্তি দিয়েগো ম্যারাডোনার মধ্যে। তারপর সময় গড়ালো, ফুটবলের জাদুতে দুনিয়ার কোটি কোটি মানুষকে মুগ্ধ করতে লাগলেন পর্তুগিজ সুপারস্টার ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো এবং আর্জেন্টাইন ক্ষুদে জাদুকর লিওনেল মেসি। গত ১৫ বছর ধরে এই দুজনের ক্যারিশমায় বুঁদ ফুটবল বিশ্ব, ফুটবলকে খেলাটা তাদের পায়ের ছোঁয়ায় হয়ে গেছে শিল্প। তাই তুলনাটাও এখন তাদের নিয়েই। কে সর্বকালের সেরা? মেসি নাকি রোনালদো? মেসি কি পারবেন তার পূর্বসূরীকে ছাড়িয়ে যেতে? বিশ্বকাপ জিতে আর্জেন্টিনার ৩৬ বছরের শিরোপা খরা ঘোচাতে?
তবে এই মুহূর্তে আলোচনাটা যে শুধুই মেসি-কেন্দ্রিক তা অনেকেই স্বীকার করবেন। কারণ মরক্কোর কাছে কোয়ার্টার ফাইনালে হেরে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে গেছে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর পর্তুগাল; রোনালদো নিজেও উল্লেখযোগ্য কোনো পারফরমেন্স দেখাতে পারেননি টুর্নামেন্টে। অন্যদিকে, মেসি প্রতি ম্যাচেই দেখাচ্ছেন অতিমানবীয় সব চমক। গোল, অ্যাসিস্ট, পেনাল্টি, বিপদের মুহূর্তেই দলের ত্রাণকর্তা হয়ে ওঠা- কী করেননি মেসি এই বিশ্বকাপে? এবার শুধু আর একটা ম্যাচের অপেক্ষা। ১৮ ডিসেম্বর বিশ্বকাপ ফাইনালেই নির্ধারিত হয়ে যাবে আর্জেন্টিনার ভবিষ্যৎ।
কাতার বিশ্বকাপের আগপর্যন্তও নক-আউট পর্বে কোনো গোল ছিল না মেসি-রোনালদো দুজনেরই। কিন্তু এবার অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সেই গোল খরা ঘুচিয়েছেন সাবেক বার্সেলোনা তারকা। এর আগে ২০১০ বিশ্বকাপে নক-আউট পর্বে মেক্সিকোর বিপক্ষে ৩-১ গোলের জয়ের সময় কার্লোস তেভেজের গোলে অ্যাসিস্ট করেছিলেন মেসি। এরপর ২০১৪ বিশ্বকাপে সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে আর্জেন্টিনার ১-০ গোলের জয়ে আনহেল দি মারিয়ার গোলটিতে অ্যাসিস্ট ছিল মেসির। ২০১৮ সালে ফ্রান্সের বিপক্ষে ৪-৩ গোলে হেরে গেলেও, মার্কাডো ও আগুয়েরওর দুটি গোলে অ্যাসিস্ট ছিল মেসির। তবে এবার অ্যাসিস্টের পাশাপাশি নিজেও গোল করতে পিছপা হননি পিএসজি ফরোয়ার্ড।
তাহলে পরিবর্তনটা কোথায়? আগের টুর্নামেন্টগুলোর চাইতে কাতার বিশ্বকাপে মেসি আর্জেন্টিনা দলে তার গুরুত্ব নিয়ে অনেক বেশি মনোযোগী। আর্জেন্টিনা দলকে যদি কেউ ক্লকওয়ার্ক পারফর্ম করতে শেখান, তিনি মেসি। তার শুধু প্রয়োজন নিবেদিতপ্রাণ কিছু খেলোয়াড়। এমন নয় যে আর্জেন্টিনার আগের প্রজন্মের খেলোয়াড়েরা ভালো ছিলেন না; কিন্তু কোপা আমেরিকা জয়ের সময় থেকে লিওনেল স্কালোনির গড়া টিম যেন আর্জেন্টিনার পুনর্জন্মকে নির্দেশ করে!
কিন্তু বুধবার ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে হুলিয়ান আলভারেজের করা দ্বিতীয় গোলে মেসি যে অনবদ্য অ্যাসিস্ট করেছেন, তাও আবার বিশ্বকাপের সেরা ডিফেন্ডার ভার্দিওলকে কাটিয়ে, তাতে সমালোচকদের মুখও বন্ধ হয়ে গেছে! এই ম্যাচে মেসির পারফর্মেন্সের সাথে পেলে ও ম্যারাডোনার নিজ নিজ বিশ্বকাপ পারফরমেন্সের তুলনা চলে শুধু।
১৯৮৬ বিশ্বকাপের কথা যদি ধরা হয়, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দিয়েগো ম্যারাডোনার গোল, কিংবা ১৯৫৮ বিশ্বকাপের ফাইনালে সুইডেনের বিপক্ষে পেলের সেই অবিশ্বাস্য গোল... ঠিক এমনই একটি মুহূর্ত গতকাল রাতে মেসি তৈরি করেছেন। নিজের বাঁ পায়ের জাদুতে ম্যারাডোনাসুলভ একটি অ্যাসিস্টই করেছেন তিনি, আর হুলিয়ান আলভারেজও পা বাড়িয়ে গোল দিতে ভুল করেননি।
কিন্তু এতেই কি মেসির সর্বকালের সেরা'র বিতর্ক থেমে গেছে? না, তা হবে না, যতক্ষণ না পর্যন্ত আর্জেন্টিনার হয়ে বিশ্বকাপ জিততে পারছেন তিনি! যদিও, একাধিক কিংবদন্তি ফুটবলার এরই মধ্যে লিওনেল মেসিকে শ্রেষ্ঠত্বের খেতাব দিয়ে দিয়েছেন। বহু ভক্তদের মতে, মেসির সর্বকালের সেরা হওয়ার জন্য বিশ্বকাপের দরকার নেই, এযাবতকালে তার পারফরমেন্সই বলে দেয় তিনি কোন পর্যায়ের। আর্জেন্টিনার বিপক্ষে গোল করার মাধ্যমে তিনি বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার হয়ে সর্বোচ্চ গোলদাতা গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতার রেকর্ড (১০ গোল) ভেঙেছেন। বিশ্বকাপে মেসির গোলসংখ্যা এখন ১১।
তাইতো বুধবারের ম্যাচের পর মেসি-বন্দনায় মেতেছেন ফুটবল পন্ডিতেরা। আলভারেজের দ্বিতীয় গোলের পর সাবেক ইংলিশ ফুটবলার গ্যারি লিনেকার টুইটারে লিখেছেন, "এখনও কি কোনো বিতর্ক আছে? সর্বকালের সেরা ফুটবলারের কথা বলছি!"
ইংলিশ ধারাভাষ্যকার জেমি কারায়ের লিনেকারের সাথে সংযুক্ত করেন- "তিনি (মেসি) সবার সেরা!"
আবার ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো ভক্ত এবং নিজের বন্ধু পিয়ার্স মর্গানকে ইঙ্গিত করে জেফ স্টেলিং লিখেছেন, "তাহলে এখন মেসি-রোনালদো বিতর্কের কোন পর্যায়ে আছি আমরা?"
ইংলিশ ধারাভাষ্যকার গ্যারি নেভিল বলেছেন, "আমি বুঝতেই পারছি না এই বয়সে সে (মেসি) এরকম গতিতে খেলে কিভাবে! ১২ বছর আগেও সে এভাবে দৌড়াত, এখন বয়স হয়ে গেলেও সে ক্যারিয়ারের এই পর্যায়ের সাথে মানিয়ে নিয়েছে। এখন সে চাইলে ১০-১৫ মিনিট ঘুমিয়েও নিতে পারে, কারণ এই আর্জেন্টিনা দলের সবাই মেসির স্বপ্ন পূরণের জন্য মরিয়া!"
সূত্র: মার্কা, ডেইলি মেইল