দেশের জনসংখ্যার বড় একটি অংশ এখনও ডিজিটাল সেবা থেকে বঞ্চিত: বিশেষজ্ঞরা
বিগত দশকে দেশে ডিজিটালাইজেশনের লক্ষ্যে ডিজিটাল অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যাপক বিনিয়োগ করা হলেও অ্যাক্সেস বা প্রাপ্যতার ক্ষেত্রে জনসংখ্যার একটি বিশাল অংশ এখনও বঞ্চিত রয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলছেন, ডিজিটাল ডিভাইস কেনার ক্ষেত্রে অনেকেরই সক্ষমতা নেই। ফলে অসাম্যতা ব্যাপক আকারে বিদ্যমান, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে। ইন্টারনেটের গতি গ্রামাঞ্চলে এখনও শ্লথ এবং এর খরচ গ্রামীণ জনগণের নাগালের বাইরে। মোবাইল ফোন অপারেটরদের ডাটা প্যাকেজগুলো জনবান্ধব নয়।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ ইভালুয়েশন সোসাইটির আয়োজনে 'ডিজিটাল ট্রানসফরমেশন এন্ড ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট ইন বাংলাদেশ' বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে বিশেষজ্ঞরা একথা বলেন।
বইটির লেখক ও বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক ড. মনজুর হোসেন বলেন, 'গ্রামীণ জনগণের নাগালের মধ্যে ডিজিটাল ডিভাইস ও ইন্টারনেট ব্যবহারের সক্ষমতা বাড়াতে উভয় পক্ষের জন্য যথাযথ প্রণোদনার ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রতিটা গ্রামে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফ্রী ওয়াইফাই হটস্পট স্থাপন করা যেতে পারে। ডিজিটাল অটোমেশনের ক্ষেত্রে উৎপাদনশীল শিল্পখাত ও এসএমই খাত অনেকটাই পিছিয়ে আছে। তাদেরকে অটোমেশন এবং ইনোভেশনের জন্য যথাযথ প্রণোদনা দেয়া প্রয়োজন। তাহলেই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আরো বেগবান হবে।'
প্রকাশিত বইটি বাংলাদেশের ডিজিটাল রূপান্তরের উপর প্রথম আন্তর্জাতিক একটি প্রকাশনা যেখানে বাংলাদেশে বিগত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ঘটে যাওয়া ডিজিটাল রূপান্তর ও এর অর্থনৈতিক প্রভাব পর্যালোচনা করা হয়েছে। ১৪টি অধ্যায়ে ডিজিটাল বাংলাদেশ ভিশন, ডিজিটালাইজেশনের সাথে অর্থনৈতিক উন্নয়নের যোগসূত্র, ডিজিটালাইজেশনের বর্তমান অবস্থা, ডিজিটালাইজেশন সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়ন ও প্রতিষ্ঠান গঠন, আইটি ইন্ডাস্ট্রি উন্নয়ন, গ্রামাঞ্চলে ডিজিটালাইজেশনের অবস্থা, মানবসম্পদ ও স্কিল গ্যাপ, বিভিন্ন সেক্টরে ডিজিটালাইজেশনের রূপান্তরের প্রভাব, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ডিজিটালাইজেশনের প্রভাব এবং টেকসই উন্নয়নে ডিজিটালাইজেশনের ভূমিকা আলোচনা করা হয়েছে।
ডিজিটালাইজেশনের সুফল আরো বেগবান করার লক্ষ্যে বইটিতে বেশ কয়েকটি সুপারিশ করা হয়েছে। তথ্য উপাত্তের ঘাটতির বিষয়টি বিশেষভাবে তুলে ধরা হয়েছে। যেমন, আইটি খাতে মোট কত রপ্তানি হয়, ফ্রিল্যান্সারদের আয় কত, দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর প্রকৃত সংখ্যা কত ইত্যাদি বিষয়ে তথ্যের ঘাটতি রয়েছে। তাই বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোকে (বিবিএস) দিয়ে প্রতি পাঁচ বছর অন্তর আইটি সংক্রান্ত দেশব্যাপী জরিপ করানোর প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
অনুষ্ঠানে টেকনোহেভেন কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও হাবিবুল্লাহ এন করিম বলেন, 'আইটির মাধ্যমে দেশের প্রবৃদ্ধি ২% বৃদ্ধি করা সম্ভব। প্রাইভেট সেক্টরে আইটি নিয়ে বেশ কাজ হচ্ছে কিন্তু সরকারের মধ্যে সেই বিষয়টি এখনও আসেনি। সরকারি প্রতিটি দপ্তরে আইটি নিয়ে বিভিন্ন প্রকল্প চলছে কিন্তু তেমন এসেসমেন্ট হচ্ছে না।'
তিনি বলেন, 'আমরা আইটি প্লাটফর্ম তৈরীর মাধ্যমে বিনিয়োগ বাড়িয়ে আইটি সেক্টর শক্তিশালী করতে পারি। তবে সকল ক্ষেত্রেই আমাদের হার্ড ডাটা দরকার। আর হার্ড ডাটা সংগ্রহ করতে হলে প্রকৃত জরিপ করতে হবে। স্যাম্পল সার্ভে দিয়ে সম্ভব নয়। ২০৩১ সালে কিংবা ২০৪১ সালে আমরা কোথায় পৌঁছাতে চাই সে বিষয় ঠিক করার আগে আমাদের বেইজলাইন ডাটা ঠিক করা উচিত।'
বিডিজবসের সিইও এ কে এম ফাহিম মাশরুর বলেন, 'আমাদের বিভিন্ন সেক্টরের অনেক ডাটা আছে কিন্তু ডাটা নিয়ে বিভ্রান্তি বেশি। সরকারি সংস্থাগুলো তাদের সুবিধা মতো ডাটা পাবলিশ করছে। এক্ষেত্রে একটি কেন্দ্রীয় ডাটা সেন্টার থাকা জরুরি, যেখান থেকে সঠিক তথ্য পাওয়া যাবে।'
এটুআইয়ের প্রকল্প পরিচালক ড. দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ুন কবির বলেন, 'ভবিষ্যতে একটি ওয়েবসাইটে গিয়ে সকল ধরনের ডাটা পাওয়া যাবে এমন একটি সরকারি ওয়েবসাইটের কাজ চলছে। ইন্টারনেটের গতি ও যোগাযোগ ব্যবস্থা ডিজিটাইলেশনের কারণে গ্রামের ও শহরের সাথে কোনো দূরত্ব থাকবে না। ইন্টারনেটের দাম কমিয়ে আনা হয়েছে, ভবিষ্যতে আরও কমানো হবে।'
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন, 'দেশ ডিজিটালে অনেক এগিয়েছে কিন্তু শিক্ষায় অনেক পিছিয়ে গেছে। গত ৬০-৭০ বছর আগের শিক্ষা এখন আর নেই। আমাদের শিক্ষা, সংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে।'
ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিলুর রহমান বলেন, 'সব জায়গায় একই সময়ে ইন্টারনেটের গতি দ্রুত করে দিবো সেটা সম্ভব নয়। আমাদের কাছে যে তথ্য আছে সেখানে দেখতে পেয়েছি ইন্টারনেট ভালো কাজে ব্যবহার করে না অধিকাংশ কর্মকর্তাই। পর্যায়ক্রমে কাজ হচ্ছে। আগামী বছর বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ যাওয়ার পরে আমাদের আরও পরিবর্তন আসবে। প্রযুক্তির সাথে ব্যবসা বাণিজ্য সম্পর্কিত। আমরা বেশকিছু স্থানে ফাইভ জি দিয়েছি কিন্তু সেটি ব্যবহার করছে না। এতো ব্যয়বহুল ইন্টারনেট তাহলে কেন দিবো?'
প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান বলেন, 'একসাথে অনেকগুলো ক্লাস্টার তৈরির মতো সক্ষমতা আমাদের নেই। ট্রেনিং দেওয়ার মতো প্রশিক্ষক নেই। আমাদের যে পরিসংখ্যান আছে সেগুলো ততো খারাপ না। শুধু আমরা যা চাই সেটার সাথে না মিললেই বলি তথ্য সঠিক না।'
পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, 'প্রধানমন্ত্রী আমাদের দেশের ভবিষ্যত আরও একটি ধাপ এগিয়ে নিয়েছেন। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে আমাদের সামনে ২০৩১ ও ২০৪১ সালের লক্ষ্য নিয়ে কাজ এগিয়ে নিচ্ছি।'