হুলিয়ান আলভারেজ: দৌড় থামাতে জানেন না যিনি
কাতার বিশ্বকাপ শুরুর আগে মেসির পাশে আর্জেন্টিনার মূল স্ট্রাইকার হিসেবে কে খেলবেন, সেই প্রশ্নে প্রায় নিশ্চিতই ছিল লাউতারো মার্টিনেজের নাম। ইতালিয়ান ক্লাব ইন্টার মিলানের হয়ে দারুণ মৌসুম কাটাচ্ছিলেন লাউতারো, জাতীয় দলেও মেসির পরে গোল করার ক্ষেত্রে তারই অবদান বেশি। তাই দলে জায়গা পাকাই ছিলো লাউতারোর।
সৌদি আরবের বিপক্ষে আর্জেন্টিনার হয়ে মেসির পাশে নেমেছিলেন লাউতারোই। তার দুইটি গোল বাতিল হয় অফসাইডের জন্য। কিন্তু মেক্সিকো ম্যাচেও গোল না পাওয়ার পর পোল্যান্ডের বিপক্ষে লাউতারোর জায়গায় হুলিয়ান আলভারেজকে নামান স্কালোনি। আর সেই আলভারেজই এখন মেসি-এমবাপ্পেদের সঙ্গে গোল্ডেন বুট জেতার লড়াইয়ে আছেন।
সুযোগ পেলে কীভাবে সেটি কাজে লাগাতে হয় তা বোধোহয় হুলিয়ান আলভারেজের থেকেই শেখা উচিত। কদিন আগেও খেলতেন আর্জেন্টিনার ঘরোয়া লিগের ক্লাব রিভারপ্লেটে। সেখানে এক ম্যাচে ৬ গোল করার পর নজরে পড়েন পেপ গার্দিওলার। ম্যানচেস্টার সিটি কোচের ইতিহাস সম্পর্কে সবারই জানা। লিওনেল মেসির আজকের মেসি হয়ে উঠার পেছনে গার্দিওলার অবদানই যে সবথেকে বেশি।
সেই পাকা জহুরির চোখ খুঁজে নিল আলভারেজকেও। মাত্র ১৮ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে তাকে ম্যানচেস্টার সিটিতে নিয়ে আসেন গার্দিওলা। সেখানেও এরলিং হালান্ডের পরে দলের দ্বিতীয় স্ট্রাইকার হিসেবেই খেলছেন আলভারেজ। কিন্তু তারপরেও ইতোমধ্যে করেছেন ৭ গোল। তাই আলভারেজকে বিশ্বকাপের দলে নিতে দ্বিতীয়বার ভাবতে হয়নি স্কালোনিকে।
খেলার ধরণের জন্য তাকে তুলনা করা হচ্ছে সার্জিও আগুয়েরোর সঙ্গে, যিনি নিজেও ম্যানচেস্টার সিটিতে গার্দিওলার অধীনে জিতেছেন একাধিক শিরোপা। যদিও বিশ্বকাপের ম্যাচগুলোর মূল একাদশে সুযোগ পাবেন কিনা সেটি নিয়ে আলভারেজ নিজেও সন্দিহান ছিলেন। হয়তো অপেক্ষা করছিলেন সুযোগ পাওয়ার।
সেই সুযোগও এসে গেল পোল্যান্ডের বিপক্ষে। আগের দুই ম্যাচে বদলি নেমে কিছুক্ষণ খেললেও পার্থক্য গড়ার মতো সুযোগই পাননি তিনি। কিন্তু পোলিশদের বিপক্ষে শুরু থেকে খেলার সুযোগ পেয়ে দেখালেন, কী করতে পারেন তিনি।
পোল্যান্ডের বিপক্ষে দলের দ্বিতীয় গোলটি করে আর্জেন্টিনার জয় সহজ করার পাশাপাশি গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হওয়া নিশ্চিত করেন আলভারেজ। বক্সের ভেতরে দারুণ দক্ষতায় বল নিয়ন্ত্রণে নিয়ে জোরালো শটে বল জালে জড়ান তিনি।
শেষ ষোলোর ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে তো দেখালেন নিজের সবথেকে বড় গুণ, হাল না ছেড়ে দেওয়ার মানসিকতা। বল পান আর না পান, বলের পেছনে ছুটতে আপত্তি নেই আলভারেজের। সেই নিরন্তর ছুটে চলার পুরস্কার হিসেবেই অজি গোলরক্ষককে বাধ্য করেন ভুল করতে। তার থেকে বল কেড়ে নিয়ে আলতো করে জালে ঠেলে দেন আলভারেজ।
কোয়ার্টার-ফাইনালেও ডাচ রক্ষণকে এক মুহূর্তে জন্য স্বস্তি দেননি তিনি। সবসময় আলভারেজের উপস্থিতি তটস্থ্য করে রেখেছিল নেদারল্যান্ডসের রক্ষণভাগকে।
আর ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে সেমি-ফাইনালে যা করলেন, তাতে আলভারেজ যে কত বড় মাপের খেলোয়াড় হতে যাচ্ছেন সেটির ঝলকানিই যেন দেখালেন বিশ্বকে। আর্জেন্টিনার করা ৩ টি গোলেই যে অবদান ছিলো তার। পেনাল্টি থেকে করা মেসির প্রথম গোলের ফাউলটা আলভারেজকেই করেছিলেন ক্রোয়েশিয়া গোলরক্ষক লিভাকোভিচ।
দ্বিতীয় গোলের আগে নিজেদের ডি-বক্সের সামনে থেকে মেসির পাস রিসিভ করে টানা দৌড়ে ঢুকে গেলেন ক্রোয়াটদের সীমানায়, সেখানে একটু ভাগ্যের ছোঁয়া পেলেও নিজের কাজটা ঠিকমতোই করলেন আলভারেজ। তৃতীয় গোলের পুরো কৃতিত্বই যদিও মেসির, কিন্তু তার দুর্দান্ত অ্যাসিস্ট লুফে নিতে জায়গামতো দাঁড়িয়ে ছিলেন আলভারেজ।
আলভারেজের এই অফুরন্ত প্রাণশক্তি এবং পুরো মাঠ দৌড়ে বেড়ানোর ফলেই লিওনেল মেসি দিতে পারছেন তার সেরাটা। সাধারণত মেসি নিজে তার পুরো ক্যারিয়ারে একজন দুর্দান্ত 'প্রেসার' ছিলেন। কিন্তু বয়স এখন আর তাকে সেটি করতে দেয় না। আলভারেজ যেন মেসির সেই অভাবটাই পুষিয়ে দিচ্ছেন কানায় কানায়।
প্রতিপক্ষ দলের রক্ষণভাগ এখন সবসময়ই ভীতসন্ত্রস্ত থাকে, এই বুঝি আলভারেজ এসে বল কেড়ে নিলেন! লাউতারো মার্টিনেজের মতো স্ট্রাইকারকে পেছনে ফেলে এখন তিনিই আর্জেন্টিনার আশা-ভরসার জায়গা।
লিওনেল মেসির সাথেসাথে আলভারেজের জ্বলে উঠা আর্জেন্টিনাকে নিয়ে এসেছে স্বপ্ন ছোঁয়া থেকে এক ম্যাচ দূরত্বে। মেসির ৫ গোলের পাশাপাশি আলভারেজও করেছেন ৪ গোল। তাই আর্জেন্টিনাকে এখন শুধু মেসির দল বলাটা অন্যায়ই বটে।
গোল্ডেন বুটের লড়াইয়ে আছেন বেশ ভালোভাবেই। ফাইনালে যদি টপকে যেতে পারেন লিওনেল মেসি এবং কিলিয়ান এমবাপ্পেকে, গোল্ডেন বুট হারিয়ে মেসির চেয়ে খুশি আর কেউ হবেন না, তা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।
ফ্রান্সের রক্ষণভাগে আলভারেজের মুহূর্মুহূ হানা দেখতে প্রস্তুত হয়ে যান। হুলিয়ান আলভারেজ আসছেন, সব ছিনিয়ে নিতে।