পালকি ইভিই কি আগামী দিনের বৈদ্যুতিক অটোরিকশা?
প্রযুক্তির আধুনিকায়নের সাথে সাথে বিশ্বের বহু দেশই এখন বৈদ্যুতিক গাড়ি ব্যবহারের দিকে ঝুঁকছে। টেসলা, রিভিয়ান, নিসানসহ বিশ্বের বড় বড় কোম্পানি ইতোমধ্যেই এটি নিয়ে কাজ করছে। তাহলে বাংলাদেশই বা পিছিয়ে থাকবে কেন? স্থানীয় পর্যায়ে অটোমোবাইল উৎপাদনের মাধ্যমে দেশে বৈদ্যুতিক গাড়ি শিল্পে নতুন বিপ্লব ঘটানোর লক্ষ্যে 'পালকি মোটরস' নামে একটি স্টার্টআপ কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছেন বাংলাদেশের মোস্তফা আল মমিন (সিইও) ও আরিফুর রহমান (সিওও)।
বর্তমানে পালকির চারটি আলাদা আলাদা মডেল প্রি-অর্ডার করা যাচ্ছে। এই লেখাটির জন্য আমাদের দেওয়া হয়েছিল 'সিটি বয় এলএফপি' নামক মাঝারি শ্রেণির একটি বৈদ্যুতিক গাড়ি। গাড়ির মডেলের ছবি দেখেই বোঝা গিয়েছিল এর আকার হবে বেশ ছোট। কিন্তু গাড়িটি যে আক্ষরিক অর্থেই একটি পালকির আকারের, তা ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারিনি!
গাড়িটির সামনে দিক দেখলে একে বেশ বড়সড়ই মনে হয়, অনেকটা ফোর্ডের তৈরি র্যাপ্টর ও ট্রানজিট থেকে অনুপ্রাণিত, যদিও ইচ্ছা করেই গাড়ির সামনের অংশের ডিজাইন এমন রাখা হয়েছে।
গাড়ির সামনের দিকে হেডলাইটসহ একটি বিশাল জাফরি রয়েছে, যার মধ্যে আছে ডিআরএলসহ ডুয়াল প্রজেকশন। একেবারে ওপরের দিকে সানরুফের মতো দেখতে অদ্ভুত ধরনের একটি ভেন্টিলেটর যা তোলা যায়। এর মধ্যে ১২০ এমএম কম্পিউটার ফ্যান ব্যবহার করা হয়েছে যা গাড়ির বাইরে থেকে দৃশ্যমান—এমনটা আমি আগে কখনো দেখিনি। গাড়ির ছাদে আবার লাগেজ রাখার জন্য র্যাকও রয়েছে।
কালো ক্ল্যাডিংস ও পেছনে স্পেয়ার হুইল রেখে বাইরে থেকে গাড়িটিকে 'রাফ অ্যান্ড টাফ' দেখানোর চেষ্টা করেছে পালকি। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমার কাছে গাড়িটিকে ছোটবেলায় কেনা স্প্রিং লোড করা খেলনা গাড়ির চেয়ে কিছু কম মনে হলো না; বিশেষ করে ১৪৫/৭০/১২ টায়ারগুলোতে ১২ ইঞ্চির স্টিল বা সংকর ধাতুতে মোড়ানো রিম দেখার পর।
বাইরে থেকে গাড়িটি দেখতে একটা সিএনজি অটোরিকশার চেয়েও ছোট। কিন্তু তারপরেও গাড়ির ভেতরে যথেষ্ট জায়গা আছে বলতে হবে। ২+২ চারজনের বসার জন্য ফক্স লেদারে মোড়ানো আসন এবং গড়পড়তা বাংলাদেশিদের স্বচ্ছন্দে হাত-পা ছড়িয়ে বসার মতো জায়গা তো আছেই। ফুল সাইজের একটি স্টিয়ারিং হুইল আছে গাড়িতে, তবে দুর্ঘটনার সময় এখান থেকে কোনো এয়ারব্যাগ বের হবে না।
তবে আমাকে যা সবচেয়ে অবাক করেছে, তা হলো ড্যাশবোর্ডের এসি ভেন্টগুলো। প্রচলিত থ্রি হুইলারের চেয়ে এগুলোর সুবিধা বেশি। গাড়ির ইন্টেরিয়রে রয়েছে তিনটি রঙের সংমিশ্রণ এবং প্লাস্টিক ডোর প্যানেল। তবে ড্যাশবোর্ডটি ফাইবার দিয়ে তৈরি এবং এতে যথাযথ অলংকরণের অভাব রয়েছে।
ড্যাশবোর্ডের মাঝখানে ব্লুটুথ সংযোগ, ইউএসবি চার্জিং এবং রিভার্স ক্যামেরা ডিসপ্লেসহ একটি সাত ইঞ্চির তথ্যপ্রযুক্তি সিস্টেম রয়েছে। ডিসপ্লে ইউনিট এবং প্রধান এসি ভেন্টের (ছিদ্র) একটি ভলিউম রেগুলেটর রয়েছে, গিয়ার নবের মতো; এর মধ্যে শুধু তিনটি অপশন আছে: রিভার্স, নিউট্রাল ও ড্রাইভ। গাড়িটি পার্ক করতে চাইলে ব্যবহারকারীকে প্রথমে গাড়িটি নিউট্রালে দিয়ে তারপর হ্যান্ডব্রেক তুলতে হবে।
হাইব্রিড ও অন্যান্য বৈদ্যুতিক গাড়ির মতো এই গাড়িটিও কোনো ইনডিকেশন ছাড়াই চালু হয়। কী পরিমাণ ভোল্টেজ ব্যবহার হয়েছে তা বোঝার জন্য একটিমাত্র ইনডিকেটর রয়েছে। সত্যি বলতে, গাড়িটি গিয়ারে রেখে প্রথমবারের মতো এক্সেলেটরে চাপ দিয়ে একে সাধারণ অটোরিকশার চেয়ে ভিন্ন কিছু মনে হয়নি।
অন্য যেকোনো বৈদ্যুতিক গাড়ির মতো পালকির এই গাড়িটিতেও একটি লিনিয়ার টর্ক আছে, কিন্তু সিটি বয় ৪৫০-এর সর্বোচ্চ গতিসীমা ঘণ্টায় ৪৫ কিলোমিটারে সীমাবদ্ধ থাকায় এটি খুব শীঘ্রই নিঃশেষ হয়ে যায়। বেজ মডেলটি ঘণ্টায় ৩৫ কিলোমিটারে লক করা এবং এর সর্বোচ্চ ভেরিয়েন্টটি সর্বোচ্চ ৮০ কি.মি/ঘণ্টায় চলতে পারবে।
পালকির মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার অপল সাহা বলেন, 'আমরা বৈদ্যুতিক অটোরিকশায় যেমন পাওয়া যায়, তেমনই একটি মোটর ব্যবহার করেছি—কিন্তু পালকির এই মোটরের শক্তি আরো বেশি।'
চেসিসের ওপরে রিয়ার হুইলের পেছনে রাখা মোটরের শক্তি ৩,০০০ ওয়াট। সেই সঙ্গে একটি ৭২ভি ১০০এএইচ ব্যাটারিযুক্ত সিটি বয় ৪৫০ দক্ষতার সাথে ১০০-১২০ কিলোমিটার চালিয়ে নেওয়া সম্ভব এবং এটি পুরোপুরি চার্জ হতে ২ থেকে ৪ ঘণ্টা সময় লাগে। সামনের সিটের নিচে রাখা ব্যাটারিটি সহজেই গাড়ির ভেতর থেকে বের করে নেওয়া যায়।
অন্য যেকোনো সাধারণ গাড়ির ক্ষেত্রে যেমনটা হয়, সিটি বয় ৪৫০-এর ক্ষেত্রে আমি ততটা আত্মবিশ্বাসী ছিলাম না। গাড়িটির ওজনের ভারসাম্যে অসামঞ্জস্য রয়েছে এবং এবড়োখেবড়ো রাস্তায় চলার সময় অপ্রত্যাশিতভাবে গাড়িটি চারপাশে ঝাঁকুনি দেয়। সম্ভবত ১২ ইঞ্চির ছোট রিমগুলো এর জন্য দায়ী। যদিও পালকি জানিয়েছে, আমরা যে মডেলটি পেয়েছি সেটি একটি প্রোটোটাইপ এবং এখনও পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। তবে আর যা-ই হোক, গাড়িতে থাকা চার চাকার ডিস্ক ব্রেকগুলো ভালোই কার্যক্ষমতা দেখিয়েছে।
সিটি বয় ৪৫০ নামক যে গাড়িটিতে আমরা উঠেছি, পালকির ওয়েবসাইটে সেটির প্রি-অর্ডার নেওয়া হচ্ছে এবং এর দাম পড়বে ৬ লাখ ৬ হাজার টাকা। সঙ্গে থাকবে পাঁচ বছরের ব্যাটারি রিপ্লেসমেন্ট ওয়ারেন্টি এবং গাড়ির সার্ভিস ওয়ারেন্টিসহ এক বছরের মোটর ওয়ারেন্টি। গাড়িটি বিআরটিএ অনুমোদিত এবং এর নিবন্ধন করা যাবে।
পালকি জানিয়েছে, গাড়ি বাজারে ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এর খুচরা যন্ত্রাংশগুলো থ্রিএস সেন্টারে (বিক্রয়, পরিষেবা ও খুচরা যন্ত্রাংশ) পাওয়া যাবে এবং ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সারা দেশে খুচরা যন্ত্রাংশ ডেলিভারি দেওয়ার ব্যবস্থা থাকবে। এছাড়াও, এই মডেলের গাড়ি কেনার তিন বছরের মধ্যে পালকির শোরুমে ভিন্ন মডেলের গাড়ির সঙ্গে এটি অদলবদল করা যাবে।
বাংলদেশে বৈদ্যুতিক গাড়ির বাজার এখনও পুরোপুরি বিকশিত না হলেও, বাংলাদেশিরা এই প্রযুক্তির গাড়িগুলোকে ভালোভাবেই গ্রহণ করেছেন। ঢাকাসহ দেশের গ্রামাঞ্চলেও বৈদ্যুতিক অটোরিকশা খুঁজে পাওয়া কঠিন কিছু নয়; আর পালকি ঠিক এই বাজারটিকেই ধরতে চাইছে।
আরিফুর রহমান বলেন, 'বিস্তৃত গবেষণার পর দেখেছি যে আমরা যে মডেলগুলো বানাতে চাইছি, সেগুলো স্থানীয়ভাবে বানাতে কোনো সমস্যা হবে না। আর এভাবেই আমরা এই খাতে প্রথম হওয়ার পরিকল্পনা করছি।'
পালকি পরবর্তী প্রজন্মের বৈদ্যুতিক অটোরিকশা হবে কি না, তা এখনই বলা যাচ্ছে না। তবে পালকির প্রতিষ্ঠাতাদের প্রত্যাশা, দৈনন্দিন কাজে ব্যবহার, রাইড শেয়ারিং কিংবা শহরের অভ্যন্তরে পণ্য ডেলিভারির মতো কাজের জন্য যারা সাশ্রয়ী মূল্যের গাড়ি খুঁজছেন, পালকির বৈদ্যুতিক গাড়ি তাদের চাহিদা পূরণ করতে পারবে।