স্প্যানিশ ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদ কেন ব্রাজিলিয়ান ফুটবলারদের দলে ভেড়াতে এত আগ্রহী?
ফুটবলের সূচনালগ্ন থেকে এই খেলাটিকে একটি শিল্পে পরিণত করেছে দক্ষিণ আমেরিকার দুই দেশ ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা। এই দুটি দেশের প্রতিভাবান ফুটবলারদের দলে ভেড়াতে আগ্রহের কমতি থাকে না ইউরোপিয়ান ও ইংলিশ ক্লাবগুলোর। তবে ক্লাব ফুটবলে রাজত্ব করার ক্ষেত্রে রিয়াল মাদ্রিদের নামটা একটু বিশেষভাবেই উল্লেখ করতে হয়। শুধুমাত্র তাদের চ্যাম্পিয়নস লিগ ট্রফির সংখ্যা বিবেচনায় নয়, বরং বিভিন্ন দেশের সবচেয়ে সেরা খেলোয়াড়দেরই বাছাই করে ক্লাবকে শক্তিশালী করে তোলার ক্ষেত্রেও রিয়াল মাদ্রিদের জুড়ি নেই। তরুণ প্রতিভা খুঁজে বের করতে কাড়ি কাড়ি টাকা ঢালতেও আপত্তি নেই স্পেনের এই ক্লাবটির। সে কারণেই তো রিয়াল মাদ্রিদ তার সমর্থকদের কাছে হয়ে উঠেছে 'রয়্যাল মাদ্রিদ'!
কিন্তু বেশ কয়েক বছর ধরেই দেখা যাচ্ছে, ব্রাজিলের খেলোয়াড়দের দলে নিয়ে আসার দিকে রিয়াল মাদ্রিদের ঝোঁক সবচেয়ে বেশি। আর পাকা জহুরির মতোই সঠিক রত্ন চিনতে যে তারা ভুল করে না, এর প্রমাণ সদ্য সমাপ্ত কাতার বিশ্বকাপেই দেখা গিয়েছে। ক্যাসেমিরো, ভিনিসিয়ুস জুনিয়র, রদ্রিগোর মতো খেলোয়াড়দের সমন্বয়ে ব্রাজিল ছিল বিশ্বকাপের সবচেয়ে দুর্ধর্ষ দল! আর এই তারকাদের সবাই রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে খেলেন। কোয়ার্টার ফাইনালে টাইব্রেকারে দুর্ভাগ্যজনকভাবে ক্রোয়েশিয়ার কাছ হেরে বিদায় নিলেও, ব্রাজিলের খেলার গতি ছিল প্রতিপক্ষকে আতঙ্কিত করার মতো।
আবারও রিয়াল মাদ্রিদের প্রসঙ্গে ফেরা যাক। সম্প্রতি ১৬ বছর বয়সী ব্রাজিলিয়ান ফুটবলার এনড্রিককে ৭০ মিলিয়ন ইউরোতে দলে নিয়েছে রিয়াল মাদ্রিদ, যদিও অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার কারণে তিনি ২০২৪ সাল থেকে মাঠে নামতে পারবেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ব্রাজিলিয়ান খেলোয়াড়দের প্রতি রিয়াল মাদ্রিদের এই আকর্ষণের কারণ কি? ২০১৩ সালে ব্রাজিলিয়ান তারকা নেইমারকে দলে আনতে চেয়েছিল রিয়াল মাদ্রিদ। কিন্তু তাদের সবরকম চেষ্টা ব্যর্থ করে নেইমারকে দলে নিয়ে নেয় নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাব বার্সেলোনা। ফলে মেসি-নেইমার-সুয়ারেজ হয়ে ওঠে বার্সেলোনার সবচেয়ে বড় অস্ত্র। 'এমএসএন ত্রয়ী'র কল্যাণে ওই সময়টা সফলতার শিখরে ছিল বার্সেলোনা। তাহলে কি নেইমারকে না কিনতে পারার জেদ থেকেই একের পর এক ব্রাজিলিয়ান তারকাদের দলে নিয়ে আসছেন ক্লাব প্রেসিডেন্ট ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ?
আট বছরে মোট পাঁচটি চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপা জিতেছে রিয়াল মাদ্রিদ। অন্যদিকে, ইউরোপিয়ান ফুটবলে এক দশক খেলে মাত্র একটি চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপা জিতেছেন নেইমার। তাই শুধুমাত্র নেইমারকে না পাওয়ার প্রতিশোধ থেকেই রিয়ালের এই 'ট্যালেন্ট হান্ট' তা বিশ্বাস করা অসম্ভব! কারণ ক্লাব ফুটবলে রিয়াল মাদ্রিদ সবচেয়ে অভিজাত দল এবং তাদের টিম ম্যানেজমেন্টই তা প্রমাণ করে।
সম্ভাবনাময় খেলোয়াড়
সম্ভাবনাময় খেলোয়াড় শব্দদ্বয় কিছুটা অনিশ্চিত শোনালেও, সহজ ভাষায়- ব্রাজিলিয়ান ফুটবলারদের কিশোর বয়সের প্রতিভার ওপর ভিত্তি করেই তাদের ভবিষ্যতের সম্ভাবনা যাচাই করা হয়। এ বিষয়ে সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও, গত ৫ বছরে রিয়াল মাদ্রিদ ব্রাজিলিয়ান ফুটবলারদের পেছনে যে প্রায় ২০০ মিলিয়ন ইউরো বিনিয়োগ করেছে এবং যা ফলাফল পেয়েছে, সেদিকে তাকালেই বোঝা যাবে কথাটি মিথ্যা নয়। রিয়াল মাদ্রিদের স্কাউট জুনি কালাফাত ও তার টিমের অন্যদের কাছে হয়তো ডেটা আছে কিংবা তাদেরও এরকম মনে হয় যে ব্রাজিলিয়ান ফুটবলাররা বড় ক্লাবগুলোতে এসে সবচেয়ে দ্রুত খেলার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে।
ফুটবলারের 'আসল মূল্য'
কখনো কখনো ব্রাজিলিয়ান টিনেজার ফুটবলারদের এত টাকা দিয়ে দলে নিয়ে আসাকে বাড়াবাড়ি মনে হলেও, রিয়াল মাদ্রিদের কাছে তা আসলে এসব ফুটবলারদের 'যোগ্যতার তুলনায় কম'! অর্থাৎ, রিয়াল ঠিকই জানে আগামী বছরগুলোতে তাদেরকে খেলানোর ফলে ক্লাবের কতখানি লাভ হবে।
উদাহরণ হিসেবে ভিনিসিয়ুস জুনিয়র ও রদ্রিগোর কথাই ধরা যাক, যারা ইতোমধ্যেই তাদের পেছনে বিনিয়োগের তুলনায় বেশি দিয়েছেন ক্লাবকে। এই তরুণ খেলোয়াড়দের সাধারণত ছয় বছর মেয়াদী চুক্তিতে দলে আনা হয়- যেমন, ভিনিসিয়ুসকে কেনা হয়েছিল ৪৫ মিলিয়ন ইউরোতে। চার মৌসুম পরে এখন তারা সহজেই ভিনিসিয়ুসকে ১০০ মিলিয়ন ইউরোর বেশি দামে বিক্রি করতে পারবে।
দিনশেষে দেখা যায় ব্রাজিলের ক্লাবগুলো টাকার বিনিময়ে তাদের তরুণ প্রতিভাদের বিক্রি করে দেয়। যেমন- মাত্র ৪৫ মিলিয়ন ইউরোতে ভিনিসিয়ুসকে কেনা হলেও ব্রাজিলিয়ান ক্লাবগুলোর নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে, দেনা পরিশোধ করতে এবং ক্লাবের অবকাঠামোগত উন্নয়ন করতে এই টাকাটা দরকার। রিয়াল মাদ্রিদ যেমন আর্থিক ঝুঁকি নিতে পারবে, ব্রাজিলের ক্লাবগুলো তা পারবে না। কারণ এই ঝুঁকিটা সবসময়ই থাকে যে ৪৫ মিলিয়ন ইউরোর খেলোয়াড় ছয় বছর পরে গিয়ে ৫ মিলিয়ন ইউরোর খেলোয়াড়েও পরিণত হতে পারে!
ইউরোপের ক্লাবগুলো, বিশেষ করে চ্যাম্পিয়নস লিগে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে যারা, তাদের হয়তো ওই একই পরিমাণ নগদ টাকা দরকার নেই, কারণ তারা খেলোয়াড়ের থেকে ভবিষ্যতে কী লাভ হবে তা বিবেচনা করে।
অভিযোজন ক্ষমতা ও সংস্কৃতি
ব্রাজিলের ফুটবলের সংস্কৃতি অন্যদের চেয়ে বেশ আলাদা। ইউরোপের সুশৃঙ্খল একাডেমির মতো করে ব্রাজিলে ফুটবল শেখানো হয় না। ব্রাজিলের বেশিরভাগ প্রতিভাবান খেলোয়াড়ই রাস্তায় কিংবা সমুদ্রসৈকতে ফুটবল খেলতে খেলতে বেড়ে ওঠে। তাদের সত্যিকার প্রতিভা, পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি এবং ফুটবলের মাঠে ডিফেন্ডারদের মোকাবিলার কৌশল ইউরোপীয়দের চেয়ে তুলনায় কম মেকানিক্যাল। ব্রাজিলিয়ানরা যান্ত্রিক ফুটবল খেলে না, বরং তারা ফুটবলে সৌন্দর্য্য খোঁজে।
ব্রাজিলের এসব 'অপক্ব' প্রতিভাবান খেলোয়াড়দের যথাযথ নির্দেশনা পেলে জ্বলে ওঠার ক্ষমতা রয়েছে। এখান থেকেই সেই 'সম্ভাবনাময় খেলোয়াড়' টার্মটি এসেছে।
নেইমারকে না পাওয়ার ক্ষোভে রিয়াল মাদ্রিদ ব্রাজিলিয়ান খেলোয়ারদের দলে ভেড়াতে ব্যস্ত তা হয়তো শুধুই একটা মজার জোক। যতদিন পর্যন্ত দলবদলের বাজারে বস্তুগত পরিবর্তন না আসছে, রিয়াল মাদ্রিদ তাদের ব্রাজিলিয়ান প্রতিভা অন্বেষণ চালিয়েই যাবে। কারণ ব্রাজিলের ফুটবল সংস্কৃতি, ফুটবল নিয়ে তাদের উন্মাদনা এবং ফুটবলকে ঘিরেই তরুণদের স্বপ্ন এই দেশটির খেলোয়াড়দের মধ্যে এমন প্রতিভা ও সম্ভাবনার জন্ম দিয়েছে যে, তারা তাদের ওপর আরোপিত বাজারমূল্যকে ছাড়িয়ে গিয়ে পারফরমেন্স দেখায়।
সূত্র: ম্যানেজিং মাদ্রিদ