রাশিয়াকে যেভাবে জয় করেছিল ম্যাকডোনাল্ডস, তারপর যেভাবে সব হারাল!
১৯৯০-এর দশকে রাশিয়ার রাজধানীর পুশকিন স্কয়ারের প্লাজায় তাদের প্রথম আউটলেটটি চালু করে বিশ্বখ্যাত ফাস্টফুড রেস্তোরাঁ চেইন ম্যাকডোনাল্ডস। প্লাজাটি তখনও সোভিয়েত সরকারের মালিকানাধীন। কিন্তু কালের আবর্তে সোভিয়েত ইউনিয়ন না থাকলেও, রয়ে যায় ম্যাকডোনাল্ডস। তাদের প্রথম এই আউটলেটটি ঐতিহাসিক গুরুত্বের বিচারেও হয়ে ওঠে পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। ২০২০ সালে ৩০ বছরপূর্তি উপলক্ষে আউটলেটটি নতুন রূপে সাজানোও হয়। তখনও কেউ জানত না, সাজসজ্জায় এই বিনিয়োগ বিফলে যেতে চলেছে, অচিরেই। ব্লুমবার্গ অবলম্বনে
পুনঃসজ্জা করার সময় নকশাকারীরা নিরপেক্ষতাকে তুলে ধরতে চেয়েছেন। যেমন লাল ও হলুদ রঙে রাঙানো চিরচেনা ম্যাকডোনাল্ডসের অন্দরসজ্জা সরিয়ে ফেলা হয়। তার বদলে জায়গা করে নেয় ধূসররঙা কংক্রিট, ইস্পাত ও কাঠের সাজ। যুক্ত করা হয় দুই ফুট দৈর্ঘ্যের কাঁচের দেওয়াল, যাতে রেস্তোরাঁ ও চত্বরের দৃশ্যও দেখতে পেতেন পথচারীরা। এভাবে একক দৃশ্য সৃষ্টির মাধ্যমেই নিরপেক্ষতা ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল বলে জানান নকশাকারীরা।
তবে করোনাভাইরাস মহামারির কারণে নির্মাণ কাজ যায় পিছিয়ে, শেষ হয় ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে। আর ঠিক ওই মাসেই ইউক্রেনে আগ্রাসন চালায় রাশিয়া। তারপরের মাসেই রাশিয়াতে নিজেদের সকল কার্যক্রম বন্ধ করে ম্যাকডোনাল্ডস। আর মে নাগাদ দেশটির বাজার থেকে পুরোপুরি বেড়িয়ে আসে। রাশিয়ায় তাদের সকল সম্পত্তি বিক্রি করে দেয় খনিশিল্পের ধনকুবের আলেক্সান্ডার গভরের কাছে।
পুশকিন স্কয়ারের রেস্তোরাঁটির নাম এখন ভকুসনো-ই তোচকা।
চোখের পলকেই রাশিয়ায় ফাস্টফুড সাম্রাজ্য হারালেও, সেদেশে ম্যাকডোনাল্ডসের যাত্রা শুরুর কাহিনি কিন্তু অভাবনীয়, বিস্ময়কর।
ম্যাকডোনাল্ড সবসময়েই ভিনদেশে ব্যবসার ক্ষেত্রে ওই দেশবাসীর রুচি ও সাংস্কৃতিক পছন্দকে ব্যবসা কৌশলে যুক্ত করেছে। তাদের স্বাদ অনুযায়ী মেন্যুতে নতুন পদও এনেছে। কিন্তু, রাশিয়ায় গিয়ে ঠিক তার উল্টোটাই করে। ফলে কম্যুনিস্ট শাসনের অধীনে থাকা জনতা ম্যাকডোনাল্ডসে গিয়ে ভিন্ন অভিজ্ঞতা লাভের সুযোগ পায়। বিষয়টি গর্ব করেই প্রচার করে ম্যাকডোনাল্ডস। যেমন সোভিয়েত সেন্ট্রাল টেলিভিশনে সম্প্রচারিত বিজ্ঞাপনে বলা হয়, 'আপনি যদি আমেরিকা যেতে না পারেন, তাহলে ম্যাকডোনাল্ডসে চলে আসুন'।
যাত্রা শুরুর পর পরবর্তী এক দশকে দ্রুত গতিতে বিস্তার লাভ করে ফাস্টফুড চেইনটি। এই সময়ে অর্থনৈতিক সংকট, দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মকর্তাদের চাপ, সুযোগ-সন্ধানী প্রতিযোগী থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার মতো বহু বাধাবিপত্তি পাড়ি দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। তবে সোভিয়েত যুগের শেষদিকে গ্রহণ করা ব্যবসার কৌশলটি কোনোদিনই বদলায়নি।
এদিকে রাশিয়ার রাজনীতিতে নতুন এক পরিবর্তনের মেঘ ঝড় হচ্ছিল। ২০১০ এর দশকের মাঝামাঝি প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের শাসনে জাতীয়তাবাদের প্রতি সমর্থন বাড়তে থাকে রাশিয়াজুড়ে। জাতীয়তাবাদীদের টার্গেট হয়- ম্যাকডোনাল্ডস। ফলে কোম্পানিটি এই চাপের মুখে ব্যবসাকে 'রুশীকরণ' বা স্থানীয় সংস্কৃতিকে প্রাধান্য দেওয়ার উপায় গ্রহণ করে।
এই পদক্ষেপে বিরোধিতা কমে আসে, সাময়িকভাবে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলারও সুযোগ পায় কোম্পানিটি। শুধু তাই নয়, ব্যবসাতেও ঘটে ব্যাপক সম্প্রসারণ। যেমন ২০১৫ সালের ৫০০টি আউটলেট থেকে ২০২২ সাল নাগাদ তাদের মোট আউটলেট দাঁড়ায় ৮৫৩টিতে। এমনকী মহামারিকালেও তারা ৫৫টি নতুন রেস্তোরাঁ খোলে, এর একটি আবার খোলা হয় সুদূর ও দুর্গম পূর্ব সাইবেরিয়ায়। এসময় তাদের ড্রাইভ থ্রু আউটলেটগুলো (যেখানে গাড়িতে বসেই খাবারের অর্ডার করা যায়) যানবাহন আসা-যাওয়ার নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করে।
২০২০ সালের মার্চে ক্রেমলিন থেকে আসে বড় স্বীকৃতি। রুশ সরকার ম্যাকডোনাল্ডসকে 'ব্যাকবোন এন্টারপ্রাইজ' হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ফলে কোম্পানিটি রুশ সরকারের সহায়তা লাভের যোগ্যতা অর্জন করে, যা ইতঃপূর্বে গ্যাজপ্রম, অ্যারোফ্লট ও রোসটেলেকম- এর মতো বৃহৎ সরকারি সংস্থাই পেত।
সরকার অহেতুক দেয়নি এই স্বীকৃতি। রাশিয়া বিশাল দেশ, তার কৃষি উৎপাদনও বিপুল। ২০২০ সালে দেশটির হায়ার স্কুল অভ ইকোনমিক্স ম্যাকডোনাল্ডসের সাথে যৌথভাবে এক গবেষণা করে, এতে দেখা যায়- ২০১৮ সালে কোম্পানিটি রাশিয়ার মোট আলু উৎপাদনের ৪ শতাংশ এবং পনিরের ২ শতাংশ কিনেছে। ২০১৪ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত কর দিয়েছে ১০০ কোটি ডলার।
রাশিয়ানরা ম্যাকডাক নামেই ডাকতেন রেস্তোরাঁ চেইনটিকে। ২০২২ সাল নাগাদ রাশিয়ার মোট রেস্তোরাঁ পর্যায়ের বিক্রিবাট্টার ৭ শতাংশ করেছে ম্যাকডোনাল্ডস। তাদের বৈশ্বিক আয়ের ক্ষেত্রে রাশিয়ার ব্যবসার অংশও ছিল ৭ শতাংশ।
প্রথম আউটলেটের বেড়ে ওঠা
২০১৯ সালে সংস্কারের আগে পুশকিন স্কয়ারে ম্যাকডোনাল্ডসের প্রথম আউটলেটটিতে যান ব্লুমবার্গের প্রতিবেদক ক্লিন্ট রেনি। পরিসর দেখেই চমকে যান, প্রায় ৯০০টি টেবিল নিয়ে বিস্তৃত ছয়টি ডাইনিং এরিয়া। খাবারের ডেলিভারি নিতেই সার বেঁধে দাঁড়িয়েছিলেন স্থানীয় ফুড সার্ভিসের ডেলিভ্যারিম্যানেরা।
ততদিনে জাতীয়তাবাদীদের চাপে ম্যাকডোনাল্ডসের রুশীকরণ হয়েছে অনেকটাই। আর সেকথা গর্বের সাথেই তাকে জানালেন এককালে এই ব্রাঞ্জের প্রথম ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করা খামাজাত খাসবুলাটভ। তিনি প্রথমদিকের ইতিহাসও তুলে ধরেন ।
যেমন প্রথমদিনে ৬ হাজার গ্রাহক আসবেন বলে অনুমান করা হলেও, হাজির হয়েছিলেন তার ছয়গুণ সংখ্যক। প্রচণ্ড ঠাণ্ডার মধ্যে লাইনে দাঁড়িয়ে প্রবেশের অপেক্ষা করছিলেন শত শত জন। দাঙ্গার আশঙ্কায় সেখানে মোতায়েন ছিল আধা-সামরিক বাহিনীর সদস্যরা। প্রথমদিকে বিগ ম্যাক নামে পরিচিত ম্যাকডোনাল্ডসের জাম্বো বার্গারের দাম ছিল ৩.৭৫ রুবল। এই অর্থে তখন রাশিয়ায় ১০ পিস পাউরুটি কেনা যেত। কিন্তু, তবু মানুষের ভিড় উপচে পড়েছিল।
কেনার পর দেখা যায় অনেকেই জানেন না কীভাবে মুখে পুরবেন এই বিগ ম্যাক। কাউকে দেখা যায় চাপাচাপি করে এটিকে যতটা সম্ভব ছোট করে আনতে, এভাবে কেউ কেউ আবার রোল করেও খাচ্ছিলেন।
উদ্বোধনের আগের রাতে কম্যুনিস্ট পার্টির কর্মকর্তাদের সাথে ম্যাকডোনাল্ডস কানাডার প্রতিষ্ঠাতা জর্জ কোহন (যিনি রাশিয়ায় ব্যবসা নিয়ে আসেন) গ্রান্ড ক্রেমলিন প্যালেসে এক অনুষ্ঠানে যোগ দেন। শ্যাম্পেনের ফোয়ারা ছোটানো ওই উদযাপনে প্রথমবারের মতো কোনো পশ্চিমা কোম্পানির প্রতিনিধিরা আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। ম্যাকডোনাল্ডসের তৎকালীন চেয়ারম্যান ফ্রেড টার্নার অবশ্য সেখানে যাননি। এসময় তিনি নিজে উপস্থিত থেকে উদ্বোধনী দিনের প্রস্তুতি তদারকি করছিলেন।
খাসবুলাটভ বলেন, 'পেছনের একটি টেবিলে বসে তিনি ধূমপান করছিলেন'। নিশ্চয় দারুণ উত্তেজনাও কাজ করছিল তার মনে।
গর্বাচেভের রাশিয়া ততোদিনে গ্রহণ করেছে পেরেস্ত্রইকা বা মুক্তনীতি। যার আওতায় ম্যাকডোনাল্ডের পদার্পণের সুযোগ আসে সেদেশে। এসময় কানাডার টরেন্টোর ইনস্টিটিউট অব হ্যামবার্গারেলজি থেকে সদ্য স্নাতক পাশ করে ফিরেছেন খাসবুলাটভ। সমৃদ্ধির বার্তা দিয়ে উদ্বোধনের দিনে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, 'অনেকেই আজকাল পেরেস্ত্রইকার কথা বলেন। কিন্তু, এনিয়ে তাদের নেই স্বচ্ছ ধারণা। কিন্তু, আমি আমার পেরেস্ত্রইকা স্পর্শ করতে পারি। তারাও আমার পেরেস্ত্রইকার স্বাদ নিতে পারবে। বিগ ম্যাক-ই হলো আমার পেরেস্ত্রইকা'।
খাসবুলাটভ জানালেন, সেদিন থেকেই রাশিয়ায় পুঁজিবাদী সংস্কৃতির আবহ যুক্ত করার মাধ্যমে স্থানীয় সাংস্কৃতিক পরিবর্তন আনতে ভূমিকা রাখে ম্যাকডোনাল্ডস। উষ্ণ অতিথি সেবা ও উচ্চ মানের খাবারের স্বাদ নিতে পারছিলেন রাশিয়ানরা।
তবে এই যাত্রা শুরুতে যার অবদান সবচেয়ে বেশি তিনি হলেন জর্জ কোহন। ১৯০৬ সালে তার দাদাদাদি সোভিয়েত ইউনিয়নের ইউক্রেন থেকে কানাডায় অভিবাসন করেন। পারিবারিক এই যোগসূত্রের কারণেই সোভিয়েত ইউনিয়নের বাজার সম্ভাবনা নিয়ে বেশ আগ্রহ ছিল কোহনের।
'টু রাশিয়া উইথ ফ্রাইস' নামক আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন, 'তারাও মাংস, রুটি, আলু আর দুধ খায়। অবশেষে একদিন তা বাস্তবে রূপ নিল, আমরাও রাশিয়াতে সর্বোচ্চ মানের মাংস, রুটি, আলু আর দুধ বিক্রি শুরু করলাম'।
তবে বাজার প্রবেশ ঘটেনি একদিনে। এর পেছনে ছিল তার দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টা। ১৯৭৬ সালে কানাডার মন্ট্রিয়ালে অনুষ্ঠিত হচ্ছিল গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক। এই আয়োজনের অন্যতম স্পন্সর ছিল ম্যাকডোনাল্ডস। অলিম্পিক কমিটির কর্মকর্তারা কোম্পানিটিকে সোভিয়েত দলকে পরিবহনে একটি বাস ধার দেওয়ার অনুরোধ করলেন। কোহেন তাতে সানন্দে রাজি হন, তারপর বাসভর্তি সোভিয়েত প্রতিনিধিদের নিয়ে আসেন তার নিকটবর্তী একটি আউটলেটে। সেখানে তাদের দারুণ আপ্যায়ন তো করলেনই, সাথে চতুর ব্যবসায়ীর মতো মস্কোতে অনুষ্ঠেয় পরবর্তী গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকে খাবার সরবরাহের চুক্তিটি পাইয়ে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করলেন।
এরপর আনুষ্ঠানিকভাবে সোভিয়েত সরকারকে এই প্রস্তাব দিতে কয়েক মিলিয়ন ডলার খরচ করে তার কোম্পানি। শেষমেষ কম্যুনিস্ট পার্টি আগ্রহী হয় এবং ১৯৮০ সালে অলিম্পিক আসরের দেড় বছর আগে চুক্তি সইয়ের জন্য কোহনকে মস্কো সফরের আমন্ত্রণ জানায়।
মস্কোতে অনেক আশা করে এসেছিলেন কোহন। তাকে থাকতে দেওয়া হয় সোভিয়েত গুপ্তচর সংস্থা কেজিবির সদর দপ্তরের সামনের এক হোটেলে। সেখানে ১৭ দিন কাটানোর পর হঠাৎ একদিন পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যরা তাকে জানালেন, 'দুঃখিত, কিন্তু কোনো চুক্তি হবে না'।
কোহেন তার লেখায় জানিয়েছেন, অনেক বছর পরে তিনি জানতে পারেন, সোভিয়েত কর্মকর্তারা আশঙ্কা করেছিলেন, এই ঘটনায় বিশ্বের কাছে এই বার্তা যাবে যে- সোভিয়েত ইউনিয়নের নিজস্ব খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থা নেই। তবে ১৯৭৯ সালে আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসনের পর অনেক দেশই ১৯৮০ সালের গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক বয়কট করে। তাই কোহেন বলেছেন, 'আমার না করা সেরা চুক্তি হয়তো এটাই ছিল'। কারণ চুক্তি করলে, বয়কট করার জন্য পশ্চিমা সরকারগুলোর প্রচণ্ড চাপের মধ্যে পড়তো ম্যাকডোনাল্ডস।
পরের এক দশকে চারজন নেতা বদলায় সোভিয়েত নেতৃত্বে। আর ম্যাকডোনাল্ডস এই সময়টা বার্গারহীন সোভিয়েত রাজ্যে ব্যবসা শুরুর আলোচনা চালিয়ে যেতে থাকে। কোহেন বলেন, মস্কোতে 'জরুরি বৈঠকের' জন্য হঠাৎ তলব এসময়ে হয়ে পড়ে সাধারণ ঘটনা। আমাদের নির্বাহীরা বিমানে চেপে সেখানে পৌঁছানোর পর আবার জানতে পারতেন, আলোচনা আগামী কোনো তারিখে হবে। তাই অগ্যত্যা জেনারেল সেক্রেটারি ব্রেজনেভের সুস্বাস্থ্য কামনা ও পূর্ব-পশ্চিম সহযোগিতা কামনা করে ভদকা টোস্ট করে আবার ফিরে আসতেন।
তবে আশার আলো দেখা দেয়, মিখাইল গর্ভাচেভের নেতৃত্ব গ্রহণের পর। ১৯৮৭ সালে গর্বাচেভ ম্যাকডোনাল্ডসের সাথে চুক্তি করেন। তবে সেটা ছিল অনেকটাই সোভিয়েত ধাঁচের। যেমন মুনাফার ৫১ শতাংশ পাবে সোভিয়েত রাষ্ট্র। তবে কোম্পানিটি তাতেই রাজি হয়ে যায়।
প্রথম চুক্তিতে শুধু একটি রেস্তোরাঁ- পুশকিন স্কয়ারে খোলার অনুমতি দেওয়া হয়। শর্ত ছিল- বিক্রিবাট্টা করতে হবে রুবলে, যা তখন মার্কিন মুদ্রায় রুপান্তর করা সম্ভব ছিল না। 'তখন পতনের কিনারে দাঁড়িয়েছিল সোভিয়েত সরকার, উত্তেজনাও ছিল চরমে। ছোটখাট সাধারণ বিষয়ও চরম মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠছিল' -লিখেছেন কোহন।
যেমন ফ্রেঞ্চ ফ্রাই নিয়েও হয় অশেষ ভোগান্তি। রাশিয়া বিশ্বের শীর্ষ আলু উৎপাদক হলেও, রাশিয়ান জাতগুলি আকারে ছোট ও আঠালো হওয়ায়– ফ্রাই বানানোর বেশিরভাগ আলু আমদানি করতে হয় ম্যাকডোনাল্ডসকে। কোম্পানিটির মোট আমদানিকৃত উপকরণের ৮০ শতাংশই ছিল আলু।
একইসঙ্গে, প্রথম বার্গারটি বিক্রিরও অনেক আগে থেকেই– একেবারে শূন্য থেকে তাদের নিজস্ব সরবরাহ চক্র গড়ে তুলতে হয়। খাদ্য উপকরণ প্রক্রিয়াকরণে মস্কোর উপকন্ঠে তারা ৫ কোটি ডলার বিনিয়োগে ম্যাককমপ্লেক্স নামে একটি কারখানা স্থাপন করে। এখানে হটডগের বনরুটি, বার্গারের পাউরুটি, আইসক্রিম উৎপাদন থেকে শুরু করে হ্যামবার্গারের মাংস পেষাই–সব ধরনের কাজ করতে হতো কর্মীদের।
সময়ের বিবর্তনে ম্যাককমপ্লেক্স এতটা সফলতা দেখায় যে, বিভিন্ন দেশের দূতাবাস, তারকা হোটেল ও রেস্তোরাঁগুলো তাদের পণ্য কিনতে শুরু করে।
পুশকিন স্কয়ারের প্রথম আউটলেটটি পর্যটক, স্থানীয় বাসিন্দা এবং কূটনীতিকদের কাছে এতটাই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস এক প্রতিবেদনে লিখেছিল, লেনিনের সমাধি দেখার লাইনে দাঁড়িয়ে যতোটা অপেক্ষা করতে হয়, এখানে তার চেয়েও চারগুণ বেশি সময় লাগে।
১৯৯৩ সালে খোলে ম্যাকডোনাল্ডসের দ্বিতীয় রেস্তোরাঁ। আর উদ্বোধনের অনুষ্ঠানে এসেছিলেন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলেৎসিন। তিনি ম্যাকডোনাল্ডসকে আরও শাখা খোলার পরামর্শ দিয়ে বলেন, 'উরাল পর্বতমালার দিকেও যান আপনারা। সাইবেরিয়াতেও যান'।
রাষ্ট্রীয় সমর্থন থাকায় এরপর পিছু ফিরে দেখতে হয়নি কোম্পানিটিকে।
হারানো সাম্রাজ্য
২০২২-এর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এভাবেই চলছিল ম্যাকডোনাল্ডসের ব্যবসা। তারপর ইউক্রেনে আগ্রাসনের প্রেক্ষাপটে নাইকি, হারমিস, লেভি স্ট্রাউস থেকে শুরু করে অধিকাংশ পশ্চিমা কোম্পানি রাশিয়ায় ব্যবসা বন্ধ করে দেয়। ওই বছরের ৮ মার্চ ম্যাকডোনাল্ডস সাময়িকভাবে তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম সাময়িকভাবে বন্ধ রাখার কথা জানায়। এ সময় তারা পরিস্থিতিকে 'নজিরবিহীন ধরনের প্রতিকূল' বলে উল্লেখ করে। রাশিয়ার গ্রাহকদের তারা জানায়, আর মাত্র এক সপ্তাহ পাবে তারা বিগ ম্যাক কেনার সুযোগ। ফলে ক্রেতাদের এত দীর্ঘ সারি তৈরি হয় তাদের আউটলেটগুলোর সামনে যা এমনকি ১৯৯০ এর দশকের পর আর দেখা যায়নি। অনেক গ্রাহক বার্গার কিনে জমানো শুরু করেন। এক ব্যক্তি তো নিজের ফ্রিজে রাখা ৫০টি বার্গারের ছবিও শেয়ার করেন।
ম্যাকডোনাল্ডস বন্ধের প্রতিবাদ জানিয়ে পুশকিন স্কয়ারের প্রধান আউটলেটের দরজায় নিজেকে হ্যান্ডকাফ দিয়ে আটকে রাখেন একজন পিয়ানোবাদক ও সামাজিক মাধ্যমের সেলিব্রেটি। তিনি চিৎকার করে বলছিলেন, 'এভাবে চলে যাওয়া শত্রুতারই প্রমাণ'। পরে পাঁচজন পুলিশ সদস্য মিলে তাকে সেখান থেকে সরিয়ে নেন।
ম্যাকডোনাল্ডসের সামনে হয়তো উপায়ও ছিল না। যুক্তরাষ্ট্রে তখন টুইটার ব্যবহারকারীরা #বয়কটম্যাকডোনাল্ডস নিয়ে ঝড় তুলেছে। বাধ্য হয়ে ১৬ মে কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ক্রিস কেম্পজিনস্কি এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানান, 'এই প্রথমবারের মতো আমরা একটি প্রধান বাজার থেকে সরে আসার এবং সেখানে আমাদের সম্পদ বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছি। যারা কিনবে তারা আমাদের মেন্যু পরিবেশন করবে না, বা আমাদের ব্র্যান্ড নামও ব্যবহার করবে না। আমাদের সোনালী চিহ্ন আর দেখা যাবে না রাশিয়ায়'।
অনেকের মতে, ম্যাকডোনাল্ডস অনেক দেরিতে এ সিদ্ধান্ত নিলেও, এটি তাদের এক সোনালী যুগের অবসানেরও প্রতীক। রাশিয়ার বাজারে ৩২ বছর ব্যবসার অবসান, পুঁজিবাদী মূল্যবোধের উত্থান ও পতনেরও ইতিহাস।