আমদানি জটিলতায় সংকটে বেবি মিল্কের সরবরাহ
ডলার সংকটে লেটার অব ক্রেডিট (এলসি) ওপেনিং এ বাড়তি সময় লাগা, রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে তৈরি হওয়া গ্যাস সংকটে রপ্তানিকারক দেশের উৎপাদন সীমিত হয়ে যাওয়ার প্রভাবে বেবি মিল্কের (ইনফ্যান্ট ফর্মুলা) সরবরাহ সংকট তৈরি হয়েছে।
বেবি মিল্কের আমদানিকারক ও বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, বাজারে চাহিদার তুলনায় পণ্যটির সরবরাহ কমে গেছে। আমদানিতে খরচ বেড়ে যাওয়ার কারণে বেবি মিল্কের দামও বেড়েছে।
বেবি মিল্কের বাজারে ৫০ শতাংশের বেশি বাজার দখলে আছে নেসলে বাংলাদেশের। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কোম্পানিটির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, "অবস্থা এমন হয়েছে যে, এলসি খোলার সমস্ত ডকুমেন্ট রেডি কিন্তু ডলার সংকটের কারণে এটা সেটেল করা যাচ্ছে না। এ কারণে আগে যে স্মুথ সরবরাহ চেইন ছিল, সেটা নষ্ট হয়ে গেছে।"
ক্রেতাদের চাহিদা মেটাতে সংকটের মধ্যে পড়তে হচ্ছে বলে জানান তিনি।
আমদানিকারকরা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক খুব বেশি স্ক্রুটিনি করে দেখছে কোন পণ্যটা আনা দরকার, আর কোনটা দরকার নেই। তারপর এলসি খোলার অনুমতি দিচ্ছে। এ কারণে এলসি খোলার ক্ষেত্রে সময় অনেক বেশি লাগছে।
এলসি জটিলতা এবং রপ্তানিকারক দেশগুলোর সরবরাহ পরিস্থিতি ধীরগতির হওয়ার কারণে আমদানিও ধীরগতির হয়েছে। আবার সময় বেশি লাগার কারণে বাড়তি খরচও হচ্ছে। এসব কারণে বাজারে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বেবি মিল্কের দামও বেড়েছে দফায় দফায়।
সুপারশপ স্বপ্ন, মিনা বাজারসহ কারওয়ানবাজারের বেশ কয়েকটি শপ ঘুরে দেখা গেছে, ৪০০ গ্রাম ওজনের বেবি মিল্কের একটি টিনের কৌটা কিনতে এখন ব্র্যান্ডভেদে সর্বোচ্চ ৭৫০ টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে। সরবরাহকারীরা বলছেন, ২০২০ সালেও এই দাম ছিল ৫০০ টাকার মধ্যে।
কারওয়ানবাজারের মুদি দোকান আল-আমিন ট্রেডার্সের বিক্রেতা আলমগীর হোসেন টিবিএসকে বলেন, "একদিকে দাম বেশি, অন্যদিকে সরবরাহ কম। যেগুলোর চাহিদা বেশি, সেগুলো অর্ডার দেওয়ার এক মাস পরেও সরবরাহ করা হচ্ছে।"
বেবি মিল্কের বাজারজাতের জন্য পাবলিক হেলথ নিউট্রিশন ইন্সটিটিউটের অনুমতি নেওয়ার দরকার পড়ে। এখন পর্যন্ত ১৭টি প্রতিষ্ঠান এই অনুমতির জন্য আবেদন করেছে। তবে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, দেশে বর্তমানে ৯-১২টি ব্র্যান্ডের বেবি মিল্ক বাজারে পাওয়া যায়। বার্ষিক ১০ হাজার মেট্রিক টন বেবি মিল্কের চাহিদা রয়েছে দেশের বাজারে।
আমদানিকারকরা বলছেন, ডলার সংকটের কারণে সব ব্যাংক এলসি খুলতে পারছে না। আবার রপ্তানিকারক দেশগুলোতেও সংকট তৈরি হয়েছে। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ইউরোপের দেশগুলোতে গ্যাসের সংকট তৈরি হয়েছে। একটা নির্দিষ্ট টাইমের পর কোন কোম্পানি গ্যাস ব্যবহার করতে পারছে না।
আবার নির্ধারিত সময়ের বাইরে কোন কোম্পানি যদি গ্যাস ব্যবহার করতে চায় তবে সেটা চড়া দাম দিয়ে কিনতে হচ্ছে। এতে করে কোম্পানিগুলোর উৎপাদনও কমে গেছে। এতে তাদের সরবরাহও অনেকটা সংকুচিত হয়েছে। ফলে তারাও নির্দিষ্ট পরিমাণের পণ্য সরবরাহ করতে আগের চেয়ে বেশি সময় নিচ্ছে। সবমিলে এসব পণ্য দেশে আসতে সময় লাগতো ৩ মাস, সেখানে এখন লাগছে ৮ মাস।
আমদানিকারকদের তথ্য বলছে, ২০২২ সালে আমেরিকার দুটি বড় বেবি মিল্ক প্রস্তুতকারী কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। যে কারণে তারাও এখন ইউরোপের দেশগুলো থেকে বেবি মিল্ক কেনার পরিমাণ বাড়িয়েছে। তাছাড়া চীন সংকটের শঙ্কায় চাহিদার চেয়ে বেশি দুধ কিনছে। ফলে একদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা বেড়েছে, অন্যদিকে সরবরাহ কমে গেছে। এর প্রভাবে দেশেও সরবরাহ সংকট তৈরি হয়েছে।
ইনফ্যান্ট অ্যান্ড ইয়াং চিলড্রেন নিউট্রিশন অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ইফতেখার রশিদ টিবিএসকে বলেন, "ডলার সংকটের কারণে এলসি খুলতে সমস্যা হচ্ছে। আবার রাশিয়া-ইউক্রেন যদ্ধের প্রভাবে ইউরোপে তৈরি হওয়া গ্যাস সংকটে বেবি মিল্কের উৎপাদন কম হচ্ছে, আবার নতুন বায়ার তৈরি হয়েছে। যে কারণে সরবরাহ চেইনে সংকট তৈরি হয়েছে।"
এ প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারাও জানান, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে ইন্টারন্যাশনাল প্রোডাকশন কমে যাওয়া, ডলার ক্রাইসিস, এলসি জটিলতার কারণে বেবি মিল্কের আমদানির পরিমাণ কমেছে। তবে কর্মকর্তারা এটাকে শঙ্কা হিসেবে না দেখে সম্ভাবনা হিসেবে দেখেতে চান। সরবরাহ সংকট তৈরি হলে বেবি মিল্কের ওপর নির্ভরতা থেকে সরে এসে বাধ্য হয়েই অনেক মা তার শিশুকে বুকের দুধ খাওয়াবে, যা শিশুর পুষ্টিতে ভুমিকা রাখবে।
ইনস্টিটিউট অফ পাবলিক হেলথ নিউট্রিশনের ন্যাশনাল নিউট্রিশন সার্ভিসেসের ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. মুরাদ শমসের তাব্রিস খান টিবিএসকে বলেন, "শূন্য থেকে ৬ মাস বয়সী শিশুর জন্য মায়ের দুধের বিকল্প কিছু নেই। বুকের দুধের পরির্বতে বেবি মিল্ক খাওয়ালে শিশু অপুষ্টিতে ভুগে ও বিভিন্ন জঠিল রোগে আক্রান্ত হয়।"
"কিন্তু যেসব শিশুর মা নেই, এবং যাদের বয়স ৬ মাস বয়স পেরিয়ে গেছে তাদের জন্য বিকল্প দুধের প্রয়োজন। তবে সেটা নিয়ন্ত্রিত পরিস্থিতির মধ্যে থাকতে হবে," যোগ করেন তিনি।