ঢাকা আর্ট সামিটের যে তিনটি উপস্থাপনা স্মৃতিকাতর করে ফেলে
আপনার ছোটবেলার নদীটা কি আগের মতোই আছে?
-না।
আপনার স্কুলে কি তালগাছ ছিল?
-হ্যা।
মাকে কতদিন পর পর দেখেন?
-ছুটি পেলে দেখা করতে যাই।
অথচ একটা সময় ছিল মাকে না দেখে আপনি এক বেলাও থাকতে পারতেন না, তাই না?
-হ্যা।
ইমরান উজ-জামানের যেন হঠাৎ কী হলো, তিনি আর বসতে চাইলেন না।
প্রশ্নকর্তা বললেন, আপনার মনটা খারাপ করে দিলাম বুঝি? জানেন আমারও খুব মন খারাপ। যাচ্ছেই না অসুখটা। সেই তালপুকুর, শিশিরভেজা দূর্বাঘাস, হলুদ শর্ষে ক্ষেত, মায়ের কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়া, নতুন ধানের গন্ধ সবই ফিরে ফিরে মনে পড়ে যাচ্ছে। কিছুতেই তাড়াতে পারছি না। আপনি আমাকে সঙ্গে নেবেন?
ইমরান: কোথায়?
প্রশ্নকর্তা: যেথায় যেতে চাইছেন। যেখানে গেলে কিছুই আর মনে পড়বে না।
ইমরান: আমি তো কোথাও যাচ্ছি না। বলতে পারেন, আমি পালাচ্ছি। আমার ছোটবেলা থেকে, আমার নদীর কাছ থেকে, ঘাসের কাছ থেকে, গাছের কাছ থেকে আমি পালাচ্ছি। শহরের ধোঁয়া, ধূলা, চাকরি-বাকরি আমাকে স্মৃতির কাছে ফিরতে দিচ্ছে না। আমার অসহায় লাগছে।
ঢাকা আর্ট সামিটের ষষ্ঠ আসর শুরু হয়েছে শিল্পকলা একাডেমিতে ৩ ফেব্রুয়ারি। প্রতি দুই বছরে একবার এ আয়োজন হয়। মাঝখানে করোনার জন্য ৩ বছর বন্ধ ছিল।
দেশ-বিদেশের ১৬০ জন শিল্পী এবারের আসরে অংশ নিচ্ছেন। এদের মধ্যে ইয়াসমীন জাহান নূপুরও একজন। জাতীয় চিত্রশালার দ্বিতীয় তলায় ১ নং গ্যালারির দরজা দিয়ে ঢুকে কিছুদূর গেলে ডানদিকে নূপুরের গ্যালারি। তিন দেয়ালে ঘেরা গ্যালারিটিতে বসার জায়গা আছে কিছু। আসনগুলো পাটের দড়ি দিয়ে বোনা মাদুর অথবা কাঠের তৈরি টুল।
এক দেয়ালে ঠাকুমার ঝুলির রাক্ষস-খোক্কস, রাজপুত্র, সোনার হরিণ চিত্রিত। আরেক দেয়ালে লাঙল, মাছ ধরার চাঁই ইত্যাদি। অন্য দেয়ালে কাঠের তাকে কাঁচের অনেকগুলো বয়াম। সেগুলোয় ধান, সরিষা বা তিলের বীজ। আরো আছে বাতাসা, খই ও আচারের বয়াম।
নূপুর সহ-শিল্পী নিয়েছেন চার জন যাদের প্রত্যেকেরই মন খারাপ। যন্ত্র, উন্নয়ন, নগরায়ন তাদের শৈশব ছিনিয়ে নিয়েছে। দর্শকদেরকে তারা তার ভাগীদার করতে চাইছেন যেমন ইমরান উজ-জামানকে করছিলেন; কারণ দর্শকদের অভিজ্ঞতাও ভিন্ন নয়।
নূপুরের জন্ম ১৯৭৯ সালে চট্টগ্রামে। তার প্রদর্শনীর শিরোনাম হোম বা বাড়ি। তিনি বলছেন, "বাড়ি হলো সেই নিরাপদ জায়গা যেখানে স্মৃতিগুলো বাস করে আর যেখানে হারানো স্মৃতিগুলোকে ফিরিয়েও আনা যায়।" স্কেচ, স্থাপনা আর উপস্থাপনার সমন্বয়ে তিনি প্রদর্শনীটি তৈরি করেছেন।
পারফরমেন্স আর্টিস্ট হিসেবে নূপুরের যাত্রা শুরু ২০০৩ সালে। সমাজ ও সময়ের পরিবর্তন দ্বারা আলোড়িত হন নূপুর। পরে নিজের শিল্পকর্মে সেগুলো সম্পৃক্ত করেন। তাকে বলা হয় আল্ট্রা-কনটেম্পোরারি আর্টিস্ট।
২০১৩ সালে ভেনিস বিয়েনালেতে তার শিল্পকর্ম প্রদর্শিত হয়েছে। যুক্তরাজ্যের ক্যামব্রিজেও তিনি শিল্পকর্ম প্রদর্শন করেছেন।
বেলি অব দ্য স্ট্রেঞ্জ
ভারতের মুম্বাইয়ের দুই স্থপতি রূপালি গুপ্তে এবং প্রসাদ শেঠির স্থাপনাকর্ম ভেনিস বিয়েনাল ঘুরে এসে এখন উপস্থিত ঢাকা আর্ট সামিটে। দ্বিতীয় তলায় ১ নং গ্যালারির প্রবেশমুখেই গর্ভ আকৃতির এই শিল্পকর্ম, নাম বেলি অব দ্য স্ট্রেঞ্জ।
এটা দেখতে গুহার মতো বা ফলের মতো অথবা সবজির মতো। ১২ জন একসঙ্গে এ গর্ভের ভিতর ঢুকতে পারে। বসার আসন হিসাবে রাখা আছে মোড়া। পড়ার জন্য আছে বই। বইগুলো অবশ্য সবই শিশুতোষ আর তা বিভিন্ন দেশের উপকথা, রূপকথা বা লোককথা। বইগুলোতে লেখা যত না আছে, তার চেয়ে বেশি আছে ছবি। তাই দর্শকদের বুঝতে বেশি অসুবিধা হয় না।
রূপালি আর প্রসাদ পেশায় স্থপতি। তারা স্থাপনাশিল্পটি তৈরি করেছেন বাঁশ, কাগজ আর কাঠের সমন্বয়ে। প্রতি বিকালে এখানে গল্প বলার আসর হয়। গেল রোববার ৫ ফেব্রুয়ারি বিকালে যেমন বলেছে রাঙামাটির সুশীল বিকাশ চাকমা। সে তার নিজের ভাষায় একটি সাপ ও একজন মায়ের সাত ছেলের গল্প বলেছে। গল্পে ঢেকিছাঁটা চাল এবং তা দিয়ে পিঠা বানানোর কথাও বলেছেন সুশীল।
বেলি অব দ্য স্ট্রেঞ্জ এমন একটি গর্ভগৃহ যেখানে গল্পরা নিজেদের মধ্যে ভাবের আদান প্রদান করে। যদিও এগুলো বিভিন্ন ভাষার- রুশীয়, মঙ্গোলীয়, আরবী, চীনা, বাঙলা বা সামোয়ান।
রূপালি এবং প্রসাদ মুম্বাইতেও দেখেছেন, থাকার জায়গা ছোট ছোট হয়ে আসছে, এতোই ছোট যে মানুষেরই জায়গা হয় না। তাহলে গল্পগুলোর স্থান সংকুলান হবে কিভাবে? ঢাকাও তাদের কাছে মুম্বাইয়ের মতো মনে হয়েছে যেখানে গল্পেরা একটু জায়গা খুঁজছে আর সে জায়গাটিই হলো এই বেলি অব দ্য স্ট্রেঞ্জ।
ইরেলেভেন্ট ফিল্ড নোট
জাতীয় চিত্রশালার তৃতীয় তলায় শিল্পী কামরুজ্জামান স্বাধীনের 'ইরেলেভেন্ট ফিল্ড নোটস' নামের শিল্পকর্ম প্রদর্শিত হচ্ছে বড় জায়গা জুড়ে। এটি তিনি গড়েছেন চলচ্চিত্র, শব্দ ও ভাস্কর্যের সমন্বয়ে। স্বাধীন এখানে বলছেন, কৃষি সংস্কৃতি ও কৃষি কাজের সঙ্গে জড়িত লোকাচার, কবিতা, লোককথার গল্প।
তার বাড়ি ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়ায়। জন্ম ১৯৭৪ সালে। তিনি ছোটবেলা থেকেই গমীরা, সঙনাচ দেখে আসছেন। তিনি দেখেছেন ফসলকে পোকার আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য স্থানীয়ভাবেই গড়ে ওঠা নানা রকম প্রতিষেধক ব্যবস্থা। ফসলকে অদৃশ্য শক্তির হাত থেকে রক্ষার জন্যও মন্ত্র পড়া হতো, নাচা হতো সঙনাচ।
স্বাধীন বলছিলেন, "দৃশ্যমান ও অদৃশ্য সব রকম শক্তিই আমাদের সংস্কৃতির অংশ। আমাদেরকে বলা হতো ভরদুপুরে ওই মাঠ পার হয়ো না, সন্ধ্যায় পাকুড় গাছের তলায় ঘুর ঘুর করো না। কেন? কারণ ওখানে তেনারা (অশরীরি শক্তি) থাকেন। এই তেনারা কারা? তাদের কোনো বর্ণনা পাওয়া যেত না। আমরা ছোটরা যে যার মতো ওই তেনাদের চেহারা কল্পনা করে নিতাম। এই প্রদর্শনীতে যে আটটি ভাস্কর্য দেখাচ্ছি সেগুলো ওই আমার ছোটবেলার তেনারা।"
"বালিয়া গ্রামের সব বয়সী ও পেশার মানুষের দলবদ্ধ প্রয়াস এই শিল্পকর্ম। আমাদের প্রত্যেকেরই এই তেনাদের গল্প শোনা আছে। আমাদের কল্পনায় এখনো তাদের বসতি। কিন্তু এখন যখন যন্ত্রের যুগ, হাইব্রিডের যুগ তখন হারিয়ে যাচ্ছেন তেনারা। তার মানে হারিয়ে যাচ্ছে সংস্কৃতির নানা উপাদান। অথচ কোনোটিই কিন্তু ফেলনা ছিল না,
"আমাদের বিকাশে অতিপ্রাকৃত এই উপাদানগুলোর ভূমিকা আছে। যন্ত্রের দাপটে, কীটনাশকের লীলায়, হাইব্রিডের খেলায় ফসলের জমিকে আর সঙনাচ দেখাতে হয় না, অদৃশ্য শত্রুবধে মন্ত্র পড়তে হয় না- তাই তেনারা হারিয়ে যাচ্ছেন। 'ইরেলেভেন্ট ফিল্ড নোটস' তেনাদের ধরে রাখার একটা প্রয়াস মাত্র। তিন বছর ধরে আমরা এই প্রকল্পের কাজ অব্যাহত রেখেছিলাম," বলছিলেন তিনি।
স্বাধীন আরো বলেন, "সঙের মুখোশের সন্ধানে বীরভূমের (ভারত) মতো জায়গা ঘুরে বেড়াতে হয়েছে। আমরা পাটখড়ি, পাটের আঁশ, দড়ি, শনগাছ ইত্যাদি দিয়ে এই ভাস্কর্যগুলো গড়েছি আর চলচ্চিত্রটিতে দেখবেন সারা বছরের উপস্থিতি। কারণ সব মৌসুমেই কোনো না কোনো ফসল হয়। বালিয়াতেই আমার স্টুডিও। আমার যে কোনো শিল্পকর্ম তৈরি হওয়ার পর প্রথম প্রদর্শিত হয় বালিয়ার কোনো ওপেন স্পেসে। তারপর তা দেখানো হয় নগরের চিত্রশালায়,
"এই ভাস্কর্যগুলোর কোনোটা গরুর মতো, কোনোটা সজারুর মতো দেখালেও আদতে কিন্তু তা নয়। এগুলোর সঙ্গে কারোই মিল নেই কারণ এরা আমাদের ছোটবেলার চরিত্র 'তেনারা'।"
১১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নয় দিন ধরে চলবে ঢাকা আর্ট সামিট ২০২৩। এবারের প্রতিপাদ্য বন্যা। আয়োজকরা বলছেন, নদীমাতৃক এই দেশে বন্যা কেবল একটি দুর্যোগমাত্র নয়, অনেক মেয়ের নামও রাখা হয় বন্যা। এই বন্যা প্রশ্ন তোলে আবশ্যকতা বা অনাবশ্যকতা নিয়ে, প্রথাগত ধ্যান ধারণা নিয়ে।
সামিটে স্থান পাওয়া অনেক শিল্পকর্মেই এর প্রতিফলন দেখা গেছে। যেমন রূপালি গুপ্তে এবং প্রসাদ শেঠি বেলি অব দ্য স্ট্রেঞ্জ নামের গর্ভগৃহটিও বাঁশের খুঁটির ওপর ভর করে একটু উঁচুতে দাঁড় করানো, বন্যা এলে যেমনভাবে ঘর উঁচু করা হয়। এর আরেক অর্থ দাঁড়ায় হার মানতে না চাওয়া, যতক্ষণ শক্তি আছে ততক্ষণ লড়ে যাওয়া।
সামিটে অংশ নেওয়া দেশি-বিদেশি শিল্পীদের মধ্যে আছেন সুমাইয়া ভেলি, অ্যান্টনি গ্রমলি, আসফিকা রহমান, ভাষা চক্রবর্তী, ডানিয়েল বৈদ্য, দামাসাস হাচা, হাবিক চুহেন, জামাল আহমেদ, জয়দেব রোয়াজা, পল তাবুরেট, সাহেজ রাহাল, রফিকুন্নবী, শুচি রেড্ডি, আবীর আব্দুল্লাহ, ভেরোনিকা হাপচেঙ্কো, গণেশ পাইন প্রমুখ।