অ্যাপ থাকতেও ভাড়ায় কেন? যাত্রীদের ডেকে হয়রান রাইডাররা!
"অফিস থেকে ফেরার পথে রাস্তায় হাঁটার জো নাই। একে তো বেশিরভাগ ফুটপাতেই রাজ্যের দোকানপাট। কোথাও ভাঙ্গা, কোথাও রাস্তা এতোই সরু যে হাঁটা রীতিমতো অসম্ভব। আর এই ফুটপাত থেকে রাস্তা পার হওয়ার সময় প্রায়ই মোটরসাইকেলের রাইডাররা এমনভাবে ডাকাডাকি করতে থাকে! হেঁটে যাওয়ার পুরো সময়টা খুবই বিরক্তিকর।"
বহুজাতিক কোম্পানিতে কর্মরত সুমাইয়া জাহিনের মুখ থেকে শুনছিলাম এসব কথা। রাজধানীর বাংলামোটর থেকে শুরু করে ফার্মগেট যাওয়ার পথে প্রত্যেক মোড়ে মোড়ের একই চিত্র। শাহবাগ, নিউমার্কেট, আসাদগেটসহ বড় বড় স্টপেজেই এরকম অবস্থা বলে অভিযোগ তার।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) ওয়েবসাইট অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে নিবন্ধিত প্রায় ৪০ লাখ মোটরবাইক রয়েছে। এরমধ্যে ১৭টি রাইডশেয়ারিং প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যার ভেতর মোটরবাইকের জন্য উবার, পাঠাওসহ মোট ৫ নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সবগুলোই অ্যাপের মাধ্যমে পরিষেবা দিয়ে থাকে।
২০১৯ সালে রাইডশেয়ারিং বিষয়ক নীতিমালা তৈরি করে সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ। রাইডশেয়ারিং নীতিমালা অনুযায়ী, যেহেতু যাত্রীর গন্তব্যস্থল নির্ধারণ, ভাড়ার পরিমাণ ঠিক হওয়া থেকে শুরু করে সবই অ্যাপের মাধ্যমে চলে, তাই অ্যাপগুলোর আওতায় থাকা রাইডারদের ডাকাডাকির কোনো সুযোগ নেই।
তবে রাস্তাঘাটে ভাড়ার জন্য ডাকতে থাকা এসব মোটরবাইক আসলে চালায় কারা? কেনই বা তারা ভাড়া ঠিক করে বা 'খ্যাপে' চালায়? আর এ ধরনের মোটরবাইকে যাত্রীরা কেনই বা চড়ে?
ভাড়ায় বা 'খ্যাপে' চালানো এসব মোটরবাইক চালকদের বিরুদ্ধে বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আরেক নারী সুমি ফারহানার অভিযোগও গুরুতর। তার বাসা রাজধানীর ফার্মগেট। বলেন, "চাকরিসূত্রে প্রতিদিনই মগবাজারে আসি। বাস বা অন্য যেকোনো বাহনে উঠলে ফিরতে প্রচুর সময় লেগে যায়। তাই হেঁটে ফেরার চেষ্টা করি। কিন্তু প্রত্যেকটা সিগন্যালই মোটরবাইকের স্বর্গরাজ্য। হাঁটতেও অসুবিধা হয় তাদের কারণে।"
"আর কোনো কারণে যদি ভাড়ায়চালিত এসব বাইকে যেতে চাই, তাহলে আশেপাশের বাকি রাইডারদের চাহনি, মুখ টিপে হাসি দেখলে গা জ্বলে যায়। নিতান্তই বিপদে না পড়লে উঠি না এসব বাইকে।"
ভাড়ায় তাহলে চড়ে কারা?
সুমাইয়ার মতো না হলেও, প্রায় কাছাকাছি ধরনের সমস্যায় পড়তে হয় মহাখালীর ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির প্রভাষক নাফিজা হককেও।
তিনি জানালেন, প্রতিদিন বসুন্ধরা থেকে মহাখালীতে যাওয়া-আসার জন্য নিজস্ব গাড়ি রয়েছে তার। যানজটের কারণে প্রায়ই গন্তব্যে পৌঁছাতে দেরি হয়ে যায় দেখে দারস্থ হন রাইডশেয়ারিংয়ের। রাইডশেয়ারিংয়ের বাইকে সময় আর খরচ দুটোই বেশ কম। কিন্তু ইদানীং বেশি জ্যাম থাকলে প্রায়ই পাঠাও, উবার চালকরা তাদের রাইড ক্যান্সেল করে দেয়। এমন একটা অবস্থা হয়, তখন গাড়িও থাকে না, আবার বাইকেও যেতে পারেন না।
জানালেন, এর সমাধান হিসেবে বেছে নিয়েছেন ভাড়ায় বা 'খ্যাপে' চলা বাইককে। তবে এসব বাইকের সেবায় মোটেও সন্তুষ্ট নন নাফিজা। তার মতে, বাধ্য হয়েই ভাড়ায় চলা বাইকে উঠতে হচ্ছে। এতে ভাড়াও বেশি গুনতে হচ্ছে, আবার নিজের নিরাপত্তা নিয়েও চিন্তুা থাকে সবসময়। যেখানে সেখানে ধাক্কা লাগিয়ে দিলেও এদের বলার কোনো সুযোগ থাকে না।
তবে যাওয়া-আসার পথে নিজেদের সুবিধার জন্যও ভাড়ায়চালিত মোটরবাইক বেছে নেন অনেকে। রাজধানীর মতিঝিলের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানালেন, চাকরির সুবাদে প্রতিদিন রাজধানীর বসুন্ধরা থেকে মতিঝিলে যাওয়া-আসা করেন তিনি।
"এতটা দূরত্বের কারণে অ্যাপে না, ভাড়ায়চালিত মোটরবাইকগুলোই বেছে নিয়েছি। ভাড়া বেশি গুনতে হলেও প্রতিদিন সকালে যখন বের হই সেসময় একের পর এক রাইড ক্যান্সেল হওয়ার ভয় তো অন্তত থাকে না। এছাড়া, এভাবে গেলে বাইকের জন্য খুব বেশিক্ষণ অপেক্ষাও করতে হয় না।"
একই কথা জানা গেল মামুনুর রশীদ নামে আরও এক শিক্ষার্থীর মুখে। রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন তিনি। জানালেন, "প্রতিদিন ক্লাস ধরার তাড়া থাকে, সেজন্যই পাঠাও, উবারের মতো রাইডশেয়ারিংয়ে চড়তাম। তবে ইদানীং প্রায়ই দেখা যায়, অ্যাপে রাইডাররা রিকোয়েস্ট বাতিল করে দেয়। অন্য সময়ে তেমন কোনো অসুবিধা না হলেও পরীক্ষার সময় এরকম হলে খুবই সমস্যা হয়।"
"কিছুদিন আগে ষষ্ঠ সেমিস্টারের পরীক্ষার সময় এ কারণে প্রায় ২০ মিনিট দেরি হয়েছে। এজন্য বাকি পরীক্ষাগুলোতে আর কোনো ঝুঁকি নেইনি। ভাড়ায় চালায় এরকম বাইকই বেছে নিতে বাধ্য হয়েছি।"
রাইড ক্যান্সেল করে দেওয়া নিয়ে অভিযোগ দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি গণমাধ্যমের কর্মীর। তার মতে, উবার বা পাঠাওয়ে কল দিলেও আজকাল অনেকেই কল ধরে করে বলে, "ভাই অ্যাপে যা ভাড়া দেখাচ্ছে তাতেই যাবো কিন্তু রাইডটা ক্যান্সেল করে দেন। অর্থাৎ রাইড আমাকে ক্যান্সেল করতে হবে, যাতে তাদের রেটিং ঠিক থাকে। কিন্তু এভাবে তো যাত্রীদের রেটিংও কমে যায়।"
'পেট্রোলের দাম আগে ছিল ৮৯, এখন ১৩০!'
অ্যাপে না চালিয়ে কেন ভাড়ায় চালান, এমন প্রশ্নের জবাবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পাঠাওয়ের এক নিবন্ধিত চালক জানালেন, "আগে যেখানে চাকরি করতাম, সেই চাকরিতে বেতন ছিল মোটে ১২ হাজার টাকা। ওই টাকায় সংসার চলতো না। দেখা যেতো মিথ্যার আশ্রয় নিলে আবার ঠিকই ৩০-৪০ হাজার টাকা আয় করতে পারতাম। কিন্তু ওই পথ ভালো লাগেনি। এইজন্য মোটরবাইক চালানো শুরু করি। প্রথমে উবারে চালাতাম, এরপর পাঠাওয়ে চালাতে শুরু করি। অ্যাপের সঙ্গে ভাড়ায়ও চালাই। এতে ৩০-৪০ হাজার টাকা অনায়াসেই আয় হয়।"
"অ্যাপে রেজিস্ট্রেশন করে চালান আবার ভাড়ায়ও চালান- এই কাজ তো বেআইনি"- এমন প্রশ্নের জবাবে ওই বাইক চালকের উত্তর, "অ্যাপে আগে কমিশন দিতে হতো ১০ শতাংশ, আর এখন দিতে হয় ১৫ শতাংশ। অর্থাৎ একশ' টাকায় ১৫ টাকাই দিয়ে দিতে হয়। এতো টাকা যদি দিয়েই দেই তাহলে কীভাবে চলবে? ভাড়ায় চালালে তো কাউকে কমিশন দিতে হয় না।"
তিনি আরও জানালেন, "আগে পেট্রোলের দাম ছিল ৮৯ টাকা, এখন এর দাম দাঁড়িয়েছে ১৩০ টাকা! এই অবস্থায় কীভাবে কমিশন দেই। দাম বাড়ার পর পাঠাও বা কোনো অ্যাপে চালাতে ইচ্ছা করে না। যদি আমাদের ভাড়ার রেটটা একটু বাড়িয়ে দিতো, তাহলেও একটা কথা ছিল। এইজন্য ভাড়ায় চালাই।"
ওই চালকের অভিযোগ, "রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠানগুলো শুধু নিজেদের সুবিধা দেখে, ব্যবহারকারীদের সুবিধাও ভালোই দেখে, কিন্তু আমাদের অবস্থা তারা দেখে না। তবে ভাড়ায়ও সবসময় যে খুব একটা যাত্রী পাওয়া যায়, তাও না।"
বললেন, "আজকে ফজরের পর পর বের হয়েছি, কিন্তু সকাল সাড়ে ১১টা পর্যন্ত কোনো কাস্টোমারই ছিল না। সাড়ে ১২টা পর্যন্ত আয় হয়েছে মাত্র ৮০ টাকা। তাই অ্যাপ চালু করেছি। আবার এরকমও অনেক সময় দেখা যায়, বেলা ২টার মধ্যে হাজারখানেক টাকা আয় হয়ে যায়," বেশিরভাগ দিনই এমন হয় বলেও জানালেন তিনি।
জমিজমা হারিয়ে এখন চালান বাইক
"বাবার মৃত্যুর পর সম্পত্তি ভাগ-বাটোয়ারা হয়, কিন্তু এরপর থেকেই ভাইয়ে ভাইয়ে কোন্দল, মামলা মোকদ্দমা, সবমিলে নিজের ভাগের সম্পত্তি বিক্রি করে ঢাকা চলে আসি। ঢাকায় আসার পর থেকে এমন কোনো ব্যবসা নেই যেটা করিনি। কাপড়, খুচড়া যন্ত্রাংশ সব কিছুর ব্যবসা করেছি। এখন বাইক চালাই। আগে অ্যাপে চালাতাম। সেটাতেও কমিশন বেড়ে গেল,
"ঢাকা শহরে খেয়েপড়ে বাঁচা তো লাগবে, ছেলেমেয়ের পড়াশোনার খরচ সব মিলে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছিলাম। তখন পরিচিত একজন ভাড়ায় চালানোর বুদ্ধি দিলো। বছরখানেক ধরে এভাবেই চালাচ্ছি। অবৈধ হলেও কিছু করার নেই। বাড়ি তো আর ফিরে যাওয়া সম্ভব না। এভাবেই চলা লাগবে," বলেন তিনি।
শুনছিলাম ভাড়ায়চালিত রাইডার, মো. মনিরুজ্জামানের গল্প। তার বাড়ি উত্তরবঙ্গের, লালমনিরহাট জেলার কালীগঞ্জে।
মো. সোহাগ নামে আরও এক রাইডারের গল্প কিছুটা মনিরুজ্জামানের মতোই। কোভিডের পর অনেকটা বাধ্য হয়ে এই পেশায় এসেছেন তিনি। মোটরবাইক চালানোর আগে ৭/৮ বছর ধরে মিরপুরে কাপড়ের ব্যবসা করতেন। মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে লকডাউনের সময় তার ভাড়া দোকানটি ছেড়ে দিতে হয়। তাই ভাড়ায় বাইক চালানোকে বেছে নিয়েছেন।
"আপাতত টাকা জমাচ্ছি তাই বাইক চালাই, প্রতিদিন হাজার ১২শ' থেকে ১৫শ' আয় হয়, সপ্তাহে ৫ দিনের বেশি চালাতেও পারি না। সম্ভব হলে আজকেই ছেড়ে দিতাম।"
এর ভিন্নচিত্রও রয়েছে। মোটরবাইক চালক আজাজ আহমেদ। তবে তিনি শুধুই অ্যাপেই চালান, ভাড়ায় চালান না। "কোম্পানির কমিশন বেড়ে গেলেও অ্যাপের কারণে দিনে প্রচুর ট্রিপ পাই। অন্তত ভাড়ায় যারা চালায় তাদের মতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসেও থাকতে হয় না, আবার যাত্রীরা যাবে কিনা এটা জিজ্ঞেসও করতে হয় না। কোনো না কোনো ট্রিপ সবসময় পেতেই থাকি, এজন্য ভাড়ায় চালাই না।"
জানা গেল, রাইডশেয়ারিং প্রতিষ্ঠান পাঠাও-এর সঙ্গে প্রায় তিন বছর ধরে যুক্ত আছেন তিনি। রাজধানীর মোহাম্মদপুরের স্থানীয় এ বাসিন্দার নিজস্ব একটি গরুর খামার রয়েছে। খামারে যে দুধ উৎপন্ন হয় তা বিভিন্ন মিষ্টির দোকানে দিয়ে দিতেন, ব্যবসা ভালোই চলতো।
"এখন ভুষি থেকে শুরু করে গরুর খাবার সবকিছুর দাম বেড়েছে। জমি নিজের বলে ব্যবসা টিকে আছে। তাই মোটরবাইক চালাই। দিনে ৫ ঘণ্টার বেশি সময় পাই না, তবে কোম্পানিকে দিয়ে আয় তেমন খারাপ হয় না।"
ঢাকা শহরে শতকরা ৮০ থেকে ৯০ ভাগ রাইডারই এখন ভাড়ায় চালান বলে জানালেন আজাজ। তার নিজের বাড়ি রয়েছে, এরসঙ্গে খামার রয়েছে বলেই হয়তো পারছেন অ্যাপে চালাতে, এমনটিও মনে করেন তিনি।
বিআরটিএ কী বলে
জানা যায়, ২০১৯ সালের ৯ ও ১০ ডিসেম্বর নিবন্ধন সনদ পায় পাঠাও, উবার ও সহজ। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ তাদের এ সনদ দেয়। ২০২২ সাল পর্যন্ত দেশে রেজিস্ট্রেশন করা মোটরসাইকেলের সংখ্যা ছিল ৪০ লাখ। যেখানে কেবল ২০২২ সালেই মোটরসাইকেল নিবন্ধনের সংখ্যা ছিল ৫ লাখ। এ বছর জানুয়ারিতে ৫ হাজারের বেশি নিবন্ধন হয়েছে।
২০২০ ও ২০২১ সালে কোভিডের কারণে নিবন্ধনের সংখ্যা কমে যায়। গত দুই বছর এর সংখ্যা ছিল তিন লাখের মতো।
বিআরটিএ' কর্তৃপক্ষের মতে, রাইডশেয়ারিং শুরুর পর থেকে নিবন্ধন বেড়ে যায় অনেকাংশে। ফলে ২০১৮-১৯ সালে এর সংখ্যা ছিল গড়ে ৫ লাখের কাছাকাছি।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) মতে, অ্যাপের বাইরে ভাড়ায় চালানো পুরোপুরি বেআইনি। এভাবে বাইক চালানোর কোনো সুযোগই নাই।
প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক এবং মুখপাত্র শেখ মোহাম্মদ মাহবুব-ই-রব্বানী জানালেন, "মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে যাত্রী ওঠানোর কথা শুনলেই আমরা ব্যবস্থা নেবো। এটা একদমই সড়ক নীতিমালা পরিপন্থী।"
রাইডশেয়ারিং কোম্পানিগুলো এ বিষয়ে এরইমধ্যে ব্যবস্থা নেওয়া শুরু করেছে বলেও জানালেন তিনি।