বন্যার শঙ্কায় হাওরাঞ্চলে ধান কাটার ধুম
চলতি বছর দেশের হাওরাঞ্চলে বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। ঝড়-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ঘাম ঝরানো মাঠে পরিশ্রমের ফসল দেখতে পেয়ে কৃষকের মুখে ফুটেছে তৃপ্তির হাসি। কিন্তু সেই হাসির পাশাপাশি তাদের মনে ছিল উদ্বেগ। বর্ষা আসন্ন, সঠিক সময়ের মধ্যে ধান কাটতে না পারলে উজানের ঢলে তলিয়ে যাবে সব। তার ভেতর মরার ওপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে দাঁড়ায় শ্রমিক সঙ্কট।
পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, আগামীকাল সোমবার থেকে ভারতের মেঘালয়, আসাম, ত্রিপুরা ও বরাক অববাহিকায় ২০০ থেকে ৪০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতের শঙ্কা রয়েছে। যার প্রভাব পড়বে দেশের হাওরাঞ্চলে।
তবে আগে থেকেই সতর্ক প্রশাসন। এরই মধ্যে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে শ্রমিক এনে কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা ও সুনামগঞ্জের ধান কাটা শুরু হয়েছে। ব্যবহার করা হচ্ছে কম্বাইন হার্ভেস্টরসহ রিপার মেশিনের মতো যন্ত্র। জেলাভেদে ৪০ থেকে ৬৫ শতাংশ পর্যন্ত ধান এরইমধ্যে কাটা হয়ে গেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অল্প কিছুদিনের মধ্যেই হাওরের সব ধান কাটা শেষ হবে।
ঝড়-বৃষ্টি-বজ্রপাতকে উপেক্ষা করে সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলের প্রায় ৫৪ শতাংশ ধান এরইমধ্যে কাটা শেষ। জেলা প্রশাসন ও কৃষি বিভাগের বরাত দিয়ে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সুনামগঞ্জ সংবাদদাতা শামস শামীম জানিয়েছেন, চলতি বছর জেলায় দুই লাখ ১৯ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে বোরোধানের চাষ হয়েছে। এরমধ্যে শুধু হাওরাঞ্চলের এক লাখ ৬১ হাজার জমিতে হয়েছে বোরোর চাষ।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধি বলছেন, আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে বাকি ধান কাটা শেষ হবে।
প্রথমদিকে ধান কাটার শ্রমিকের সঙ্কট থাকলেও জেলা প্রশাসন উদ্যোগ নিয়ে ঝিনাইদহ, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, চট্টগ্রাম, রংপুর, সিলেটসহ বিভিন্ন স্থান থেকে প্রায় ১০ হাজার ৭৩৪ জন শ্রমিক নিয়ে এসেছেন। তাদের পাশাপাশি ১১৪টি কম্বাইন হার্ভেস্টর এবং ১১৭টি রিপার মেশিন ব্যবহার করা হচ্ছে।
তবে ধর্মপাশা উপজেলার সুখাইর রাজাপুর দক্ষিণ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আমানুর রাজা বলেন, যে মেশিন দেওয়া হয়েছে, তা হাওরে ধান কাটার জন্য উপযুক্ত নয়। তাই শ্রমিকরাই ভরসা।
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সবিবুর রহমান বলেন, 'বৃষ্টির গতি অন্যদিকে ঘুরে গেছে। তাই সুনামগঞ্জের বদলে পার্বত্য এলাকায় বৃষ্টিপাত হতে পারে।'
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের ময়মনসিংহ প্রতিনিধি হোসাইন শাহীদ জানিয়েছেন, ভিন্নচিত্র দেখা গেছে কিশোরগঞ্জে। সেখানে অন্যান্য বছরের তুলনায় শ্রমিক কম থাকলেও কৃষিযান্ত্রিকীকরণকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া একটি রাজনৈতিক দলের উদ্যোগে প্রতিটি ইউনিয়নে ৫০ জনের করে একটি স্বেচ্ছাসেবক দল তৈরি হয়েছে। তারা বিনা মজুরিতে শ্রমিকদের পাশাপাশি কৃষকদের ধান কেটে মাড়াই করে দিচ্ছেন। কম্বাইন হার্ভেস্টর ও রিপার মেশিনের কারণেও অল্প সময়ে বেশি ধান কাটা সম্ভব হচ্ছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি বছর জেলার ১৩টি উপজেলায় এক লাখ ৬৬ হাজার ৭১০ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ করা হয়েছে। এর মধ্যে হাওরাঞ্চলের এক লাখ তিন হাজার ৪৪৫ হেক্টর জমিতে হয়েছে বোরো ধান। হাওরাঞ্চলের ৪০ শতাংশ ধান এরইমধ্যে কাটা হয়ে গেছে।
কিশোরগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিক জানান, প্রতি ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ, কৃষকলীগ ও অঙ্গসহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মী নিয়ে ৫০ সদস্যের একটি টিম গঠন করা হয়েছে। ইতিমধ্যে তার নেতৃত্বে ওই সেচ্ছাসেবক টিম কাজ করছে। তারা কৃষককে ধান কাটাসহ নানাভাবে সহযোগিতা করছেন।
জেলার মিঠামইন উপজেলার কৃষক আতাউর রহমান জানান, প্রথমে সমস্যায় পড়লেও পরে স্বেচ্ছাসেবকরা তার ধান কেটে দেওয়ায় তিনি এখন সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছেন। তিনি জানান, আগের চেয়ে কম হলেও এখনো শ্রমিক সঙ্কট রয়েছে। তবে ১৫ দিনের মধ্যে হাওরের সব ধান কেটে ফেলা যাবে বলে তিনি আশা করেন।
কিশোরগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মোহাম্মদ সাইফুল আলম জানিয়েছেন, শ্রমিক সঙ্কট নিরসনে ধান কাটা ও মাড়াইয়ের জন্য ৬১টি যন্ত্র সরবরাহের পরিকল্পনা ছিল। এরইমধ্যে ২৭টি কম্বাইন হার্ভেস্টরের মাধ্যমে ধান কাটা-মাড়াইয়ের কাজ চলছে। অল্প সময়ের মধ্যে বাকি ধান কাটা সম্ভব হবে।
কিশোরগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ আলী জানান, ২৭ এপ্রিল থেকে ভারতের মেঘালয়, আসাম, ত্রিপুরা ও বরাক অববাহিকায় ২০০ থেকে ৪০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। এতে দেশের সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, হবিগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জের হাওরাঞ্চলের নদীর পানি অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেয়ে বন্যা হতে পারে।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের নেত্রকোনা প্রতিনিধি সঞ্জয় সরকার জানিয়েছেন, রোববার পর্যন্ত জেলার হাওরাঞ্চলের ৬৫ ভাগ জমির ধান কাটা হয়ে গেছে। কাটা, মাড়াই ও বাছাইয়ের জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতির সহজলভ্যতার কারণে অপেক্ষাকৃত কম সময়ে ধান ঘরে তুলতে পারছেন চাষীরা। অন্যান্যবারের তুলনায় এবার ধানের ফলনও হয়েছে বাম্পার।
জেলার খালিয়াজুরী, মোহনগঞ্জ ও মদনের সম্পূর্ণ এবং কলমাকান্দা ও আটপাড়া উপজেলার অংশিক এলাকা নিয়ে বিশাল হাওরাঞ্চল। এখাকার একমাত্র ফসল বোরো ধান। কৃষি বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, এ বছর জেলার হাওরাঞ্চলে ৪০ হাজার ৮৬৫ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছে।
চাষীরা জানান, করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে শুরুর দিকে কিছুটা শ্রমিক সঙ্কট দেখা দিলেও এখন আর তা নেই। পাবনা, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, জামালপুর ও ময়মনসিংহ এলাকা থেকে বেশ কিছু শ্রমিক এসেছেন হাওর এলাকায়।
সব মিলিয়ে হাওরাঞ্চলের পাঁচ উপজেলায় সাড়ে ১২ হাজার শ্রমিক ধান কাটছেন বলে জানিয়েছে কৃষি বিভাগ।
খালিয়াজুরী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ হাবিবুর রহমান বলেন, আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে আগামী ১০ দিনের মধ্যে ওই উপজেলার সব ধান কাটা শেষ হয়ে যাবে।