‘ফকিন্নির বাজারে’ ক্রেতাদের ভীড় বাড়লেও সরকার সরে আসছে কৃচ্ছতাসাধন নীতি থেকে
খবর বেরিয়েছে যে, 'ফকিন্নির বাজারে' ক্রেতাদের ভীড় বাড়ছে। সাধারণ বাজারে জিনিসপত্রের আকাশ ছোঁয়া দামের কারণে শহরের অনেক মানুষ এখন 'ফকিন্নি বাজারে' ভীড় করছেন। সেখানে ডিম বিক্রি হয় ২০ বা ৩০ টাকা হালিতে পলিথিনের ব্যাগে। যেসব ডিম পুরোপুরি ফেটে যায়, সেগুলোর কুসুম কোনোরকমে পলিব্যাগে ভরে বিক্রি করা হয়। ফেটে যাওয়া ডিম কিন্তু কুসুম বেরিয়ে যায়নি এমন ডিমও পাওয়া যায়।
শুধু তাই নয়, সেখানে খুব কম দামে ডাল, চাল, মুরগির ডানা, পাখনা, কুড়িয়ে পাওয়া সবজি, খুব ছোট পলি প্যাকেটে তেল, মশলাও পাওয়া যায়। এই বাজারের জিনিসগুলো তাজা বা ভালো মানের নয়, তবে অনেক পরিবারেই প্রাণিজ আমিষের সংস্থান হবে এবং গরম ভাত ও ডালও মিলবে। গুগল ম্যাপে 'ফকিন্নি' বাজারকে উল্লেখ করা হয়েছে মুদি দোকান হিসেবে। রেটিং ভালো দেখানো হয়েছে, পাঁচের মধ্যে চার।
কেনো এরকম একটি বাজারের রেটিং ভাল হবে? কেনো দলবেঁধে মধ্য ও নিম্ন মধ্যবিত্তের মানুষ সেখানে যাবেন কেনাকাটা করতে? এর উত্তর হলো, সেখানে কম দামে কিছুমিছু কিনতে পারা যায়। ২০২০ সালের শুরুতে যেখানে মশুর মোটাদানার ডালের কেজিপ্রতি দাম ছিল ৫০ টাকা, তা এখন ৯৫ টাকা বা আরো বেশি। একইভাবে ৩০ টাকার মোটা চাল এখন ৪৮ থেকে ৫০ টাকা; ৯০ টাকা লিটারের খোলা সয়াবিন তেল ১৬৮ টাকা। দাম বাড়েনি, এমন পণ্য নেই বললেই চলে। মূল্যবৃদ্ধির হার ৯০ শতাংশ।
অন্যদিকে, বৈশ্বিক ও দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে কৃচ্ছতাসাধনের যে ঘোষণা দিয়েছিল, সেই অবস্থান থেকে সরে আসছে। কারণ তাদের বিবেচনায় দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ভালো হচ্ছে। যদি দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ভালোই হবে, তাহলে মোটামুটি স্বচ্ছল পরিবারগুলোর নাভিশ্বাস উঠছে কেনো? দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণিটি হারিয়ে যাচ্ছে কেনো? কেনো 'ফকিন্নির বাজারে' ভীড় বাড়ছে? কেনো শহর ছেড়ে মানুষ গ্রামে ফিরে যাচ্ছেন? এর কোনো হিসাব বা উত্তর নেই সরকারের কাছে। করোনার পরে দেশে দারিদ্রের হার কত বেড়েছে, সরকার তাও জানায়নি। বেসরকারি সংস্থা ও অর্থনীতিবিদরা যা বলেন, সরকার সেটিও গ্রহণ করে না।
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, "অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এখন ঠিক আছে। তবে আগামীতে যেকোনো বিপদ হতে পারে। তাই আমাদের অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে।"
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সবিনয়ে জানতে চাই, এই সতর্কতা কাদের জন্য? সরকারের জন্য, রাজনীতিবিদদের জন্য, ব্যবসায়ীদের জন্য, নাকি সাধারণ মানুষের জন্য?
বিত্তবানদের জন্য কোনো সতর্কতার প্রয়োজন নেই, কারণ তাদের পকেটে টাকা উপছে পড়ছে। যারা ব্যাংক খালি করেছেন, যারা বিদেশে টাকা পাচার করেছেন, যারা প্রকল্পগুলোকে অন্ধ করে রেখেছেন, যারা কানাডা-দুবাই-আমেরিকাতে বসতি গড়েছেন, যারা দুর্নীতি করে ফুলেফেঁপে ঢোল হয়েছেন, তাদেরতো সতর্ক হওয়ার কোনো দরকার নেই।
পরিকল্পনা বিভাগের সচিব দ্য ডেইলি স্টারকে বলেছেন, "কৃচ্ছ্রসাধন এখনো চলছে। কিন্তু অর্থনীতির কিছুটা উন্নতি হওয়ায় আমরা নীতি কিছুটা শিথিল করেছি।" অন্যদিকে, সাধারণ মানুষ অর্থনৈতিক উন্নতির কোনো সুফল দেখতে পাচ্ছে না। বাজারে প্রতিটা জিনিসের দাম প্রায় দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে। বেড়েছে চিকিৎসা খরচ, বাড়িভাড়া, শিক্ষা ও যাতায়াত ব্যয়।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর এই কৃচ্ছতাসাধন করা নিয়ে গণমাধ্যমে যা বলেছেন, তা প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, "অনেক ধুমধাম করে সরকার কৃচ্ছতাসাধনের সার্কুলার দিয়েছে, কিন্তু তাতে কিছুই হয়নি। কৃচ্ছতার ফলে কত টাকা সাশ্রয় হয়েছে, সে সম্পর্কে আর কোনো ঘোষণা দেওয়া হয়নি। অর্থাৎ, সরকার কোন জায়গা থেকে টাকা বাঁচিয়েছে? সেটিও জানানো হয়নি, কিন্তু আমরা সেটি জানতে চাই।"
অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেছেন, "মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনা দরকার ছিল। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৭ মাসে গড়ে ৮ দশমিক ৭ শতাংশ ছিল মূল্যম্ফীতি, যা বাজেট লক্ষ্যমাত্রার ৫ দশমিক ৬ শতাংশের চাইতে অনেক বেশি। এই ভয়াবহ মুদ্রাস্ফীতির কারণে মানুষ প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে পারছেন না, তাদের কেনার ক্ষমতা কমে গেছে। মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনতে পারলে মানুষ তাদের একই আয় দিয়ে আরও বেশি কিনতে পারবেন। যার ফলে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার হবে।"
আমরা যারা সাধারণ মানুষ, অর্থনীতি খুব একটা বুঝিনা, শুধু এটা বুঝি- আগে যে টাকা দিয়ে ৫টা পদ কিনতে পারতাম, এখন সেই টাকায় ২টা পদ কিনতে পারি। সংসার খরচ কমানোর জন্য বিভিন্নখাতে বিভিন্ন জিনিস কেনা বন্ধ করার পরেও মোট বাজার মূল্য বেড়ে যাচ্ছে। এরমানে বাজারে দ্রব্যের দাম সীমাহীন।
তাইতো যখন দেখি ওএমএসের ট্রাকের পেছনে অনেক বড় লাইন, যখন দেখি বিভিন্ন পরিবারে মাছ গোশত খাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে বা কোনো ছাত্র বা ছাত্রীর প্রাইভেট পড়া ছাড়তে হয়েছে, স্কুলও ছাড়িয়ে দিতে হয়েছে কোনো কোনো পরিবারের বাচ্চাকে, তখন আর অবাক হইনা। কারণ মানুষের নুন আনতে পান্তা ফুরোয় অবস্থা বাড়ছে।
বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) ২০২২ সালের একটি হিসাব জানিয়েছিল, ঢাকা শহরের চার সদস্যের একটি পরিবারকে খাবার কিনতে মাসে গড়ে ৯ হাজার ৫৯ টাকা খরচ করতে হয়। মাছ-মাংস খেলে ওই পরিবারের খাবারে খরচ হয় ২২ হাজার ৪২১ টাকা। মানুষ কী কী খায়, তা ধরা হয়েছিল বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জরিপ 'বাংলাদেশ আরবান সোশিও ইকনোমিক অ্যাসেসমেন্ট সার্ভের' ভিত্তিতে। সিপিডির হিসাবে, মাছ ও মাংস খেলে দৈনিক গড় খাবার খরচ ৭৪৭ টাকা দাঁড়ায়। কিন্ত করোনাকাল থেকে আমাদের যে অবস্থা, তাতে প্রতিদিন ১৫০ থেকে ২০০ টাকার বাজার করাই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শুধুতো খাওয়া নয়, আছে বাড়িভাড়া, যাতায়াত, শিক্ষা, চিকিৎসা, আমন্ত্রণ-নিমন্ত্রণ রক্ষা এবং আরো বিভিন্ন ব্যয়। করোনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে মূল্যবৃদ্ধির সরাসরি প্রভাব পড়েছে আমাদের ওপর। বারবার বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি মানুষকে দিশাহীন করে তুলেছে। সাংসারিক ব্যয় কাটছাঁট করার পরেও সীমিত, নিম্ন আয় ও মধ্যম আয়ের মানুষ এখন চাপে আছেন। প্রথমদিকে সরকারের ওএমএস কর্মসূচিতে ক্রেতা ছিলেন খুব দরিদ্র মানুষ বা একেবারে স্বল্প আয়ের মানুষ। তবে বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বাড়তে থাকায় দিন দিন ওএমএসের লাইনে আরো অনেক মানুষের সংখ্যা বাড়ছে।
ঠিক এরকম একটা অবস্থায় সরকার তার কৃচ্ছ্রসাধন নীতি থেকে সরে আসার যে ঘোষণা দিল, তাতে জনগণ নতুনভাবে ভাবনার মধ্যে পড়লেন। আবার গণহারে সরকারি কেনাকাটা হবে, আবার বালিশ কাণ্ড, আবার গরু দেখতে বিদেশগমণ, সাঁতার শিখতে নৌভ্রমণ, একটার পর একটা প্রকল্প গ্রহণ, প্রকল্প অর্ধসমাপ্ত ভাবে ফেলে রাখা এবং এই জাতীয় আরো অনেককিছু জনগণকে দেখতে ও সইতে হবে।
এদেশের অধিকাংশ সাধারণ মানুষের চাহিদা খুব কম। কাজ শেষে ঘরে ফেরা, নিরাপত্তা, বাচ্চার শিক্ষা, সামান্য মাথা গোঁজার ঠাঁই এবং অসুখ হলে ডাক্তার ও ওষুধ। এখন সেই চাহিদার তালিকা আরো ছোট হয়ে গেছে। বাবা-মা চান নিজেরা অভুক্ত থেকেও যেন দিনশেষে সন্তানের মুখে একটু ভাত-তরকারি তুলে দিতে পারেন।
সবাই উন্নয়ন চায়, কিন্তু এই উন্নয়ন চাইতে গিয়ে কতটা ঋণের ভারে জর্জরিত হতে হবে, এটা ভেবেই হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যায়। সরকার বলছে, পাইপলাইনে বৈদেশিক অর্থ জমা হয়ে আছে, এগুলো ছাড়াতেই কৃচ্ছতাসাধন নীতি থেকে বেরিয়ে আসতে হচ্ছে। এর ফলাফল যে ঠিক কী হবে, তা অর্থনীতিবেত্তারা বলতে পারবেন।
তবে আমরা বলতে পারবো হয়তো গরীবের বাজারে ভীড় আরো বাড়বে, ফুটপাত থেকে কেনাকাটা করা মানুষের সংখ্যাও বাড়বে, পলিথিনে করে ভাঙা ডিম কেনার প্রবণতা বাড়বে, ফকিন্নির বাজার টাইপ বাজার আরো রমরমা হবে। পাশাপাশি বাড়বে রাহাজানি, ছিনতাই, ডাকাতি, অভাব, বেকারত্ব, হতাশা, হত্যা ও আত্মহত্যা।
উড়ালসড়ক, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, টিউবরেল, কর্ণফুলি টানেল, আট লেনের সড়ক সব যেমন দেশের অবকাঠামো উন্নয়নের সাক্ষ্যবহন করছে, তেমনি মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমতে কমতে দারিদ্রসীমার নিচে নেমে আসাটাও দেশের অর্থনীতি ও সামাজিক অবস্থার জন্য ভয়াবহ পরিণাম ডেকে আনবে।
পরিস্থিতি যেন এতোটাই কঠিন হয়ে না পড়ে যে, মিসর সরকারের মতো দেশের মানুষকে প্রোটিনের বিকল্প উৎস হিসেবে মুরগির পা ও পাখা খাওয়ার পরামর্শ দিতে হয়। মুরগির পা ও পাখা আমরা এখনো মজা করেই খাই। কিন্তু সরকার এমন আহ্বান জানালে মুরগির পা ও পাখার দামও বেড়ে যাবে। যেমনটা হয়েছে মিসরে, সেখানে সরকারের ঘোষণার পর মুরগির পা ও পাখা কেনাও কঠিন হয়ে গেছে।
- লেখক: যোগাযোগকর্মী