বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত স্থানীয়রা পায় না প্রকৃত ক্ষতিপূরণ
জীবনের সকল সঞ্চয় দিয়ে সীতাকুণ্ডের কেশবপুর এলাকায় ১০ লাখ টাকা খরচ করে এক বছর আগে টিন ও লোহার এ্যঙ্গেল দিয়ে একটি বাড়ি নির্মাণ করেছিলেন নিজাম উদ্দিন (৫৫)। সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টের ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনায় তছনছ হয়ে গেছে পুরো বাড়ি। ভেঙ্গে গেছে ঘরের সকল আসবাসপত্র। উড়ে গেছে ঘরের টিন, লোহার এ্যঙ্গেল।
ওই ঘরের দুই রুমের ভাড়া বাবদ ৭ হাজার টাকাই ছিলো ৩ ছেলে মেয়েসহ নিজাম উদ্দিনের পরিবারের ভরণপোষণের অবলম্বন।
ওই এলাকায় সুপার স্টিল নামক একটি রড় কারখানায় ফায়ারম্যান হিসেবে চাকরি করলেও বেশ কিছুদিন ধরেই বেকার।
নিজাম উদ্দিন টিবিএসকে বলেন, "সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টের বিস্ফোরণে আমার বসত ঘর তছনছ হয়ে গেছে। দুর্ঘটনার সময় ১ মাস তিন দিন বয়সী কন্যাসন্তান সহ আমার স্ত্রী ঘরে ছিলেন। বিকট শব্দে আমার স্ত্রী অজ্ঞান হয়ে যায়। দেড় ঘণ্টা পর তার জ্ঞান ফিরে।"
ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, "তছনছ হয়ে যাওয়া ঘর মেরামত করতে লক্ষাধিক টাকার প্রয়োজন। এখন এই টাকা কে দেবে? কে দেবে আমাদের ক্ষতিপূরণ?"
শনিবার সীতাকুণ্ডের সোনাইছড়ি ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টে সিলিন্ডার বিস্ফোরণে আশপাশের অন্তত এক কিলোমিটার এলাকার দেড় শতাধিক ঘরবাড়ি, কারখানা, দোকানসহ বিভিন্ন স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঘরের দরজা, জানালা, আসবাবপত্র ভেঙ্গে গেছে।
এই ঘটনায় নিহত হয়েছে ৭ জন। এ পর্যন্ত ৩৩ জনকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে। কারখানার লোহার টুকরা এসে আহত হয়েছে আশেপাশের প্রায় সকল ঘরের কোন না কোন বাসিন্দা।
নিজাম উদ্দিনের মতো ক্ষতিগ্রস্তদের সবার একই প্রশ্ন- এই ক্ষতির দায় কে নেবে? কে দেবে ক্ষতিপূরণ?
গত বছরের ৪ জুন সোনাইছড়ি ইউনিয়নের বিএম কন্টেইনার ডিপোতেও ঘটে প্রায় একই ধরনের বিস্ফোরণের ঘটনা। হাইড্রোজেন পার অক্সাইড থেকে কন্টেইনার বিস্ফোরণে নিহত হয় ৫১ জন। আহত হয় প্রায় দুইশ জন।
সোনাইছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের তথ্য মতে ওই দুর্টনায় বিএম ডিপোর আশপাশের প্রায় দুইশ ঘরবাড়ি, ধর্মীয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, দোকান ও অন্যান্য স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রায় ৭৫ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করে তা জেলা প্রশাসনে জমা দেয়া হয়।
জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে বিএম ডিপো কর্তৃপক্ষ স্থানীয়দের ক্ষতিপূরণ বাবদ প্রায় ২৫ লাখ টাকা প্রদান করে বলে টিবিএসকে জানান সোনাইছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মনির আহমেদ।
বিএম ডিপোর দুর্ঘটনায় আশপাশে ক্ষয়ক্ষতির শিকার স্থানীয়দের সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা বলেন, দুর্ঘটনায় তারা যে পরিমাণ ক্ষতির শিকার হয়েছিলেন তারা সে পরিমাণ ক্ষতিপূরণ পাননি। ক্ষোভ প্রকাশ করে তারা বলেন, এভাবে জনবসতিপূর্ণ এলাকায় একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটলেও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো প্রকৃত ক্ষতিপূরণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
বিএম কন্টেইনার ডিপোর বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ডিপোর উত্তর পার্শ্বে নুর নওশাদের আধাপাকা ঘর। ঘর মেরামত করতে খরচ হয় ৩০ হাজার টাকার বেশি। তবে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ১০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দেয় বলে জানিয়েছে নুর নওশাদ।
বিএম কন্টেইনার ডিপোর নির্বাহী পরিচালক ক্যাপ্টেন মাইনুল দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, বিএম ডিপোর দুর্ঘটনায় নিহত, আহতদের পরিবার এবং ক্ষয়ক্ষতির শিকার ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে প্রায় ১৮ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের প্রকৃত ক্ষতির সমপরিমাণ অর্থ না পাওয়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, "জেলা প্রশাসনের তালিকা অনুযায়ী স্থানীয়ভাবে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে। ওই তালিকায় যে পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি উল্লেখ করা হয়েছে সেই অর্থ পরিশোধ করা হয়েছে।"
অন্যদিকে সোনাইছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মনির আহমেদ টিবিএসকে বলেন, "জনপ্রতিনিধি হিসেবে স্থানীয় বাসিন্দা এবং শিল্প কারখানা মালিকদের স্বার্থ একইসাথে দেখতে হয়। তবে বিএম ডিপোর ঘটনায় আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা অনুযায়ী যে পরিমাণ টাকা চেয়েছিলাম তা পাইনি।"
"সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টে দুর্ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে কাজ চলছে। তবে এই দুর্ঘটনায় অন্তত ১৫০ ঘরবাড়ি, দোকান, কারখানা ও স্থাপনার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে আমরা ধারণা করছি।"
সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্ট এর পুর্ব পার্শ্বে অবস্থিত নবনির্মিত দ্বিতল ভবন তাজ ভিলাও ক্ষতিগ্রস্ত হয় বিস্ফোরণে। কারখানা থেকে উড়ে আসা লোহার টুকরা পড়ে আহত হন ওই ভবনের কেয়ারকেটার তোফাজ্জল হোসেন।
ওই বাড়ির মালিক জয়নাল আবেদীনের ছেলে সাজ্জাদ হোসেন টিবিএসকে বলেন, "একটি পারিবারিক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আমাদের পরিবারের সকল সদস্য চট্টগ্রাম শহরে ছিলাম। দুর্ঘটনার খবর পেয়ে বাসায় এসে দেখি প্রতিটি ঘরের দরজা, জানালা সহ ভেঙ্গে গেছে। তছনছ হয়ে গেছে ঘরের বিভিন্ন আসবাবপত্র। এই ঘটনায় প্রায় ৩ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এই ক্ষতিপূরণ আমরা কার কাছে পাবো?"
ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, "একটি ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় অক্সিজেন প্ল্যান্ট কারখানা পরিচালনার অনুমতি কিভাবে দেওয়া হলো? এমন ক্ষয়ক্ষতির দায় কে নেবে?"
চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলেন, "সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টের দুর্ঘটনার বিষেয়ে বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের সাথে সোমবার চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে দুর্ঘটনাস্থলের আশপাশের এলাকার স্থাপনায় ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের বিষয়ে আলোচনা হবে। ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করে ক্ষতিপূরণ প্রদানের ব্যবস্থা করা হবে।"