বিদায়ী বছরে ৫,০৬৪ কোটি টাকার ঋণ মওকুফ করেছে ব্যাংক
বিদায়ী বছর ব্যাংকিংখাতে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল ও ঋণের সুদ মওকুফ অস্বাভাবিক পরিমাণে বেড়েছে।
২০২২ এর পুরো বছর জুড়ে ২৭ হাজার কোটি টাকা পুনঃতফসিল করতে গিয়ে ব্যাংকগুলো গ্রাহকের ৫,০৬৪ কোটি টাকার ঋণ মওকুফ করেছে, যা এর আগের বছরের তুলনায় ৩,২০৯ কোটি টাকা বেশি।
ব্যাংকারারা বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক পলিসি করে ব্যাংক মালিকদের হাতে এ সুযোগ দিয়ে দিয়েছে। এখন ব্যাংকগুলোর বোর্ডই নামমাত্র ডাউন পেমেন্টে ঋণের সুদ মওকুফ করতে পারে।
এছাড়া সুদ মওকুফের বোর্ডের হাতে ক্ষমতা দিয়ে স্পষ্ট সার্কুলার করায় এর পরিমাণ বেড়েছে।
তারা আরও বলেন, কোভিডের কারণে ২০২০-২১ সাল জুড়ে গ্রাহক ঋণ পরিশোধে প্রায় পুরোপুরি ছাড় পেয়েছে। ২০২২ সালেও শ্রেণিভেদে ঋণ পরিশোধে ছাড় পেয়েছে গ্রাহক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সূত্রমতে, ২০১৮ সালে ব্যাংকগুলো ১,১৯৪ কোটি টাকা সুদ মওকুফ করে; পরের বছর এই সংখ্যা ২,২৯৩ কোটি টাকায় পৌঁছে। ২০২০ সালে তা কিছুটা কমে ১,৫৭৮ কোটি টাকায় নামে। ২০২১ সালে আবার ১,৮৫৫ কোটি টাকায় উন্নীত হয়।
এছাড়া, ২০২২ সালে ব্যাংকগুলো ঋণ পুনঃতফসিল করেছে ২৭,২৭৯ কোটি টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় দুই গুণ বেশি।
২০২১ সালে ব্যাংকগুলো ঋণ পুনঃতফসিল করেছে ১২,৩৮০ কোটি টাকা। তার আগের বছর ২০২০ সালে পুনঃতফসিল করেছে ১৩,৪৬৮ কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, "ঋণ পুনঃতফসিল ও মওকুফের সুবিধার পুরোটাই বড় বড় গ্রাহকরা পেয়ে থাকে এবং তারাই ইচ্ছাকৃত খেলাপি গ্রাহক।"
তিনি বলেন, "বর্তমানে ব্যাংকিং সেক্টর খবুই দুর্ভাগজনক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যথাযথ কোন পদক্ষেপ নিচ্ছে না। ব্যাংকগুলো কোনরকমে ব্যালেন্স শিট ভালো দেখাতে নানা সিস্টেম করছে। কেউই আমানতকারিদের স্বার্থ রক্ষার্থে যথার্থ গুরুত্ব দিচ্ছে না।"
তিনি আরও বলেন, "ব্যাংকিং সেক্টেরে এই ধরনের অনৈতিক সুবিধা কমিয়ে আনতে হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আরও জোরালো ভুমিকা রাখতে হবে। যেমন-যেকোন গ্রাহক খেলাপি হয়ে গেলে তার ঋণ আদায়ে কঠিন ব্যবস্থা নিতে হবে। একইসঙ্গে নতুন ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই করতে হবে।"
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, বিদায়ী ২০২২ এর শুরুতে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৩২৭৩ কোটি টাকা। জুন শেষে এর পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা।
এছাড়া সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ আরও বেড়ে দাঁড়ায় ১ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকায়। যদিও ২০২২ এর ডিসেম্বর শেষে এটা কমে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকায়।
খেলাপি ঋণের বিষয়ে সাবেক এ গভর্নর বলেন, "ব্যাংকিং খাতে এখন যে পরিমাণ খেলাপি ঋণ এটা আসল তথ্য নয়। বিভিন্নভাবে এ চিত্র ঢেকে রাখা হয়েছে।"
তিনি বলেন, "ইন্টারন্যাশনাল রেটিং এজেন্সিগুলো দেশের ব্যাংকিং খাত নিয়ে নেগেটিভ রেটিং করছে যা পুরো দেশের অর্থনীতির জন্য খারাপ দিক। এর ফলে আমাদের আমদানির খরচ ও বিদেশে থেকে ঋণের সুদ হার বেড়ে যাবে। যার ফলে দেশের সাধারণ মানুষ দুর্ভোগের শিকার হবে।"
গত বছরের জুলাইয়ে নতুন ঋণ পুনঃতফসিলের ক্ষমতা দেওয়া হয় ব্যাংকগুলোর বোর্ডের হাতে। তার আগে বিশেষ সুবিধায় ঋণ নিয়মিত করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন লাগত। তবে জাল-জালিয়াতি ও অনিয়ম-প্রতারণার ঋণ নতুন নীতিমালার আওতায় নিয়মিত করা যাবে না বলে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
নতুন নিতিমালায় খেলাপি ঋণ নিয়মিত করতে এখন ২.৫ থেকে সাড়ে ৪ শতাংশ অর্থ জমা দিলেই চলবে। আগে ঋণ নিয়মিতকরণের জন্য দিতে হতো ১০ থেকে ৩০ শতাংশ অর্থ।
এ ধরনের ঋণ পরিশোধে আগে সর্বোচ্চ দুই বছর সময় দেওয়া হলেও এখন তা বাড়িয়ে পাঁচ থেকে আট বছর নির্ধারণ করা হয়েছে।