চীনের মধ্যস্থতায় সৌদি-ইরান সমঝোতা: পেট্রোডলারের ভবিষ্যৎ কি হুমকির মুখে?
গত সপ্তাহে বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক অঙ্গনে একটা ছোটখাটো ভূমিকম্প বয়ে গেছে। সাত বছর আগে কূটনৈতিক সম্পর্কচ্ছেদ করার পর সৌদি আরব ও ইরান আবারও সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের একটি সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করেছে। কিন্তু এর চাইতে বড় খবর হলো, এ সমঝোতায় মধ্যপ্রাচ্যের 'বড় ভাই' মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনো ভূমিকাই ছিল না। সমঝোতা স্বাক্ষরিত হয়েছে বেইজিংয়ে, মধ্যস্থতাও করেছে চীন। গত ১০ মার্চ বেইজিংয়ে সৌদি আরবের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মুসাইদ আল-আইবান ও ইরানের সুপ্রিম ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের সচিব আলি শামকাহনীর মধ্যে এ সমঝোতা স্বাক্ষরিত হয়; এবং তাদের মাঝে বসে মধ্যস্থতা করেন চীনের শীর্ষ কূটনৈতিক ওয়াং ই। পুরো আলোচনা হয়েছে আরবি, ফারসি ও চীনা ভাষায়, ইংরেজির স্থান ছিল না সেখানে। সবকিছু মিলিয়ে সর্বত্র এখন তা-ই আলোচনা — চীন কি তবে মধ্যপ্রাচ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে যাচ্ছে?
সাদাচোখে দেখলে এ পরিবর্তন অত্যন্ত আকস্মিক মনে হবে। কিন্তু এর আভাস কিছুটা পাওয়া যাচ্ছিল সৌদি তরফ হতে গতবছর থেকেই। এবং এর পেছনে রয়েছে দুটো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়: ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ এবং পেট্রোডলার। এ দুটো বিষয় ভূমিকা রাখছে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিত্র সৌদি আরবের যুক্তরাষ্ট্রের ছায়া থেকে সরে আসার ক্ষেত্রে।
পেট্রোডলার নিয়ে আলোচনা করার পূর্বে ছোট করে পেট্রোডলারের ইতিহাসটা দেখে নেওয়া দরকার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে বিশ্বের প্রায় সব দেশই গোল্ড স্ট্যান্ডার্ডকে তাদের মুদ্রামান নির্ধারণের জন্য ব্যবহার করত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইউরোপের কলোনিয়াল দেশগুলো ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয় এবং সে সময় পৃথিবীর মোট সোনার দুই-তৃতীয়াংশ রিজার্ভ ছিল যুক্তরাষ্ট্রের কাছে। কাজেই বিশ্বযুদ্ধ শেষে ইউরোপকে পুনর্গঠনের সময় ব্রেটন উডস চুক্তি ও আইএমএফ-এর কল্যাণে ডলারভিত্তিক আন্তরাষ্ট্রীয় বাণিজ্য স্থাপিত হয়। ১৯৭১ সালে যুক্তরাষ্ট্র গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড তুলে দেয়, ফলে কার্যত পৃথিবী নির্ভরশীল হয়ে পড়ে মার্কিন ডলারের ওপর। ১৯৭৩ সালে সৌদি আরব যুক্তরাষ্ট্রের কাছে একমাত্র ডলারেই তেল বিক্রি করতে সম্মত হয়, যা ১৯৭৫ সালের মধ্যে অন্যান্য ওপেক দেশও মেনে নেয়। ফলে, বৈশ্বিক তেল আমদানি রপ্তানি হয়ে পড়ে পেট্রোডলার-নির্ভর।
পেট্রোডলার যুক্তরাষ্ট্রকে দিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে অপরিসীম প্রভাব। ১৯৭৯ সালে প্রতিষ্ঠিত ইউনাইটেড স্টেটস-সৌদি অ্যারাবিয়ান জয়েন্ট কমিশন অন ইকোনমিক কো-অপারেশন-এর মাধ্যমে সৌদি আরব তেল বিক্রির থেকে অর্জিত লাভ দিয়ে মার্কিন পণ্য কিনে আনে। এসবের মধ্যে রয়েছে অস্ত্র, যার মাধ্যমে সৌদি আরব মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক সক্ষমতা ধরে রাখে। ওপেকভুক্ত বেশিরভাগ দেশই এভাবেই পেট্রোডলারকে ব্যবহার করে। এ প্রক্রিয়াকে ডাকা হয় পেট্রোডলার রিসাইক্লিং নামে। মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন হেজিমনির সবচেয়ে বড় হাতিয়ার এই পেট্রোডলার। এছাড়া অত্যন্ত প্রচলিত একটা ধারণা বিদ্যমান যে সাদ্দাম হোসেন এবং মুয়াম্মার গাদ্দাফিকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়ার পেছনে মূলত কারণ ছিল যে তারা ডলারের পরিবর্তে ভিন্ন মুদ্রায় তেল বিক্রি করতে চাইছিলেন — যদিও এটা স্রেফ একটা মুখরোচক ষড়যন্ত্র তত্ত্ব বই আর কিছু নয়।
২০২২ সালের মার্চে সৌদি আরব চীনের কাছে ইউয়ানে তেল বিক্রি করার চিন্তা শুরু করে। বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু হয় পশ্চিমে। প্রথমে ভাবা হচ্ছিল, এটা যুক্তরাষ্ট্রকে চাপ দেওয়ার নতুন কৌশল, কিন্তু এক বছর বাদে ২০২৩ সালের ১৭ জানুয়ারি ডাভোসে সৌদি অর্থমন্ত্রী মোহাম্মদ আল-জাদান জানান, রিয়াদ কেবল ইউয়ানই নয়, অন্যান্য মুদ্রাতেও তেল বিক্রি করতে আগ্রহী। ব্লুমবার্গকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, 'আমরা কীভাবে আমাদের বাণিজ্য সমঝোতা আলোচনা করব তা নিয়ে কোনো সমস্যা নেই, তা মার্কিন ডলারই হোক, ইউরোই হোক, অথবা সৌদি রিয়ালই হোক।'
এর পূর্বে ইরান, ভেনেজুয়েলা এবং সম্প্রতি রাশিয়া ডলারের পরিবর্তে ভিন্ন মুদ্রা ব্যবহার করে তেল বিক্রি করেছে। বিশেষ করে রাশিয়ার জন্য বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ দেশটি এখন বিশ্বের অপরিশোধিত তেলের শীর্ষ রপ্তানিকারক। ওদিকে সৌদি আরব রাশিয়া থেকে বিপুল পরিমাণে ক্রুড অয়েল কিনে পরিশোধিত করে তা রপ্তানি করছে। সৌদি তার নিজের তেল বিক্রি করছে, অথচ স্থানীয়ভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ২০২২ সালে রাশিয়া থেকে ক্রুড অয়েল আমদানি প্রায় দ্বিগুণ করেছে। সৌদি কিংডম হোল্ডিং কোম্পানি রাশিয়ার এনার্জি সেক্টরে ৫০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। আর এ পুরো সরবরাহ চেইন ডলারের ওপর নির্ভরশীল থাকাটা রাশিয়া ও সৌদি আরবের জন্য ক্ষতিকর।
ওদিকে ২০১৮ সালে পেট্রোইউয়ানের জন্ম হয় সাংহাই ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে। এ পেট্রোইউয়ান ভেনেজুয়েলা, রাশিয়া, ইরান, উত্তর কোরিয়ার কাছে জনপ্রিয়। একই সাথে ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়াও পেট্রোইউয়ানকে ভালো মনে করে। ইরাক সম্প্রতি চীনের সঙ্গে ইউয়ানে বাণিজ্য করার ঘোষণা দিয়েছে। বলে রাখা ভালো, ২০২২ সালে ইরাক ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে মধ্যস্থতার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু হুতি বিদ্রোহীরা আরামকো'র তেল শোধনাগারে রকেট হামলা করলে তা ভেস্তে যায়। এরই মধ্যে ভারত, পাকিস্তান বা আরব আমিরাত চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যে স্থানীয় মুদ্রা ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
আরেকটি গুরুতপূর্ণ দিক হলো, এশিয়ার দেশগুলো এখন তেলের প্রধান ক্রেতা হয়ে উঠছে। পশ্চিম ইউরোপ ধীরে ধীরে বিকল্প জ্বালানির দিকে সরে যাচ্ছে। তাই তেলের বাজারে ডলারের প্রভাবও কমে আসছে। ভারত ও চীনের মতো বৃহৎ তেল আমদানিকারকেরা এখন তেল আমদানিতে ডলারকে ত্যাগ করতে শুরু করেছে। কাজেই এ প্যারাডাইম শিফট পেট্রোডলারকে দুর্বল করছে।
আবার সৌদি আরব ব্রিকস-এ যুক্ত হতে চাইছে বলে জানা যাচ্ছে। ব্রিকসে দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রদূত অনিল সুকলাল গত ১৪ ফেব্রুয়ারি জানান, সৌদি আরব ও ইরান ব্রিকসে যোগদানের জন্য আনুষ্ঠানিক আবেদন করেছে। এ ঘটনাটিও থাকতে পারে সাম্প্রতিক সমঝোতার পেছনে।
তবে পেট্রোডলারের ভবিষ্যৎ এখনই ঝুঁকিতে নেই। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও মুদ্রাব্যবস্থায় মার্কিন ডলারের যে প্রাধান্য, তা এরকম সমঝোতার মাধ্যমে দুর্বল হয়ে যাবে না। এছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যের তেল শিল্প দাঁড়িয়েই আছে ডলারের ওপর ভিত্তি করে বানানো ব্যবস্থার ওপর। কাজেই শিগগিরই পেট্রোডলারের দুশ্চিন্তা নেই। তবে দীর্ঘমেয়াদে পেট্রোডলারের শক্তি খর্ব হতে যাচ্ছে বলে ধারণা করা যায়। তা হলেও তখনো মার্কিন ডলারের প্রভাব কমবে না, কারণ পেট্রোডলার একটি অংশকে কেবল নিয়ন্ত্রণ করে। আর ওদিকে পুরো বৈশ্বিক অর্থব্যবস্থা দাঁড়িয়ে আছে ডলারের ওপর।
সমঝোতার ভবিষ্যৎ কী হবে, সেটা নিয়ে শঙ্কা রয়েই যায়। ইরানি জনগণ এ খবরকে গ্রহণ করেছে দুইভাবে। কট্টরপন্থীরা এ সমঝোতাকে ভাবছে যুক্তরাষ্ট্রের গালে চড়; মধ্য ও সংস্কারপন্থীরা ভাবছে দীর্ঘদিনের অচলাবস্থা কাটিয়ে অবশেষে যাত্রা শুরু করছে দুই দেশ। কিন্তু এ সমঝোতা এখনো নীতিনির্ধারক ও আমলাদের পর্যায়েই আছে — রাজনীতিবিদদের পর্যন্ত পৌঁছায়নি। আর যেকোনো রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আসল নির্ধারক রাজনীতিবিদেরাই। তবে নানা কারণে এ সমঝোতা গুরুত্বপূর্ণ, এবং পেট্রোডলারের ওপর এর প্রভাব কেমন হবে, তা জানার জন্য আমাদের আরেকটু অপেক্ষা করতে হবে।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।