ভারতীয় বিচার বিভাগের সঙ্গে নির্বাহী বিভাগের দ্বন্দ্ব গণতন্ত্রকেই দুর্বল করে
কোন দিকে হাঁটছে ভারতীয় বিচার বিভাগ! সম্প্রতি বেশ কিছু ঘটনা নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছে বলা যায়। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, পশ্চিমবাংলার একজন বিচারপতি একক বেঞ্চে সমাজের সমস্ত অনিয়মকে উপড়ে ফেলে দেওয়ার ব্রত নিয়ে এমন কিছু সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, যা আলোচিত সমালোচিত দুটোই হয়েছে।
সবচেয়ে বড় যে ঘটনাটি বিচারপতি ঘটিয়েছেন, তা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় বিচারকার্যে নিয়োগ থাকা অবস্থাতেই একের পর এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন এবং নানান মন্তব্য করছেন বিচার্য বিষয়গুলো সম্পর্কে। এর মধ্যে অন্যতম ছিল পশ্চিমবাংলার তৃণমূল কংগ্রেসের পার্থ চট্টোপাধ্যয়ের শিক্ষক নিয়োগের ব্যাপক দুর্নীতির বিষয়টি।
পার্থ চট্টোপাধ্যায় এখন জেলে। এর সাথে প্রশ্ন হল, চাকরিপ্রার্থী মানুষগুলো যদি টাকা দিয়ে চাকরি পেয়েও থাকেন, তাহলে তাকে কতটা দোষী করা যায়? যে সমাজের রাজনীতিবিদরা টাকা গ্রহণ করছেন চাকরি দেওয়ার জন্য সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে চাকরি প্রত্যাশীরা যদি টাকা দিয়েও থাকেন, তার অপরাধের মাত্রাটা কতখানি? উপমহাদেশের তিনটি দেশেই এই ধরনের অভিযোগ আছে - দলীয় কর্মীদের চাকরি পাইয়ে দেওয়ার। ক্ষেত্রবিশেষে টাকা পয়সার বিনিময়েও চাকরি প্রদান করা হয়। আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থায়ও ঠিক এ ধরনের বহু অভিযোগ আমরা দেখেছি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর এমপিও ভুক্ত করার ক্ষেত্রে, শিক্ষক নিয়োগ করার ক্ষেত্রে - এ ব্যাপারে গণমাধ্যমে নানান সময় নানান অভিযোগ উঠে এসেছে।
পশ্চিমবাংলা হাইকোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় সর্বশেষ নবম দশম শ্রেণির শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে যে নির্দেশনা দিয়েছেন সেই নির্দেশনাকে কেন্দ্র করে ঘটনা ঘটছে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টে। একজন প্রাক্তন সলিসিটার এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছেন। তিনিই এই বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের গণমাধ্যমে উপস্থিত হওয়ার বিষয়টি তুলে ধরেছেন যে, গঙ্গোপাধ্যায় একাধিকবার টেলিভিশনের সামনে সরাসরি সাক্ষাৎকার প্রদান করেছেন, কিংবা নানান সময়েই সাংবাদিকদের নানান প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন।
সুপ্রিম কোর্টের রিট পিটিশনে সুপ্রিম কোর্টের কাছে এই বিষয়গুলো তুলে ধরার সময় তিনি বিচারপতির বিষয়ে সুস্পষ্ট অভিযোগ এনেছেন। প্রাক্তন সলিসিটার সেই আইনজীবী অভিযোগ করেছেন বহু বিষয়ে সুস্পষ্ট তথ্য ছাড়াই কী করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছেন এই বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। সুপ্রিম কোর্ট বিষয়টিকে খতিয়ে দেখছে ।
এদিকে, বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় প্রকাশ্যেই সুপ্রিম কোর্টে যা ঘটেছে, তার দিকে নজর রাখছেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন।
সর্বশেষ ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট এনফোর্সমেন্ট ডিপার্টমেন্ট ও সিবিআই কর্তৃক যে ইনভেস্টিগেশন চালানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়, আপাতত তা স্থগিত ঘোষণা করেছেন।
এছাড়াও আছে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের আরেকটি রিট পিটিশন; যা মূলত রাজ্যসভার সভাপতি, উপরাষ্ট্রপতি ও আইন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে। তাদেরকে অভিযুক্ত করা হয়েছে যে, তারা উভয়ই সুপ্রিম কোর্টের রায়ের ওপরে মত প্রকাশ করে কোর্টকে অবহেলা করছেন। আবার গুজরাটি হাইকোর্ট দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী আম আদমি পার্টির অরবিন্দ কেজরিওয়ালের একটি রিট পিটিশন খারিজ করে দিয়েছেন, যেখানে অরবিন্দ কেজরিওয়াল প্রধানমন্ত্রী মোদির শিক্ষাগত যোগ্যতার তথ্য জানতে চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে রাইট টু ইনফরমেশনের আওতায় তথ্য চেয়েছিল। গুজরাট বিশ্ববিদ্যালয় সে বিষয়ে কোনো উত্তর না দেওয়াতে অরবিন্দ কেজরিয়াল গুজরাট হাইকোর্টের শরণাপন্ন হয়, এ বিষয়ে দীর্ঘ ৭ বছর কেটে যাবার পর, গুজরাট হাইকোর্ট খারিজ করে দিয়েছে। গুজরাটের সেই আদালত আদেশ দিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর শিক্ষাগত যোগ্যতা জানতে চাওয়া হলে তা জরিমানার আওতায় পড়বে এবং দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে ২৫ হাজার রুপি জরিমানাও নির্ধারণ করা হয়েছে।
ভারতের জন্মলগ্ন থেকে বিচারক নিয়োগের দায়িত্বে থাকা কলেজিয়েম সিস্টেম পাল্টে দিয়ে বর্তমান সরকার সংবিধানের যে সংশোধনী এনেছিলেন, সে সংশোধনীকে সুপ্রিম কোর্ট বাতিল করে দিয়েছে সংবিধান পরিপন্থী বলে। এই সংশোধনী বাতিল হওয়ার পর থেকেই ভারতের বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে সরকার বনাম কলেজিয়াম সিস্টেমের মধ্যে সংঘর্ষ পরিলক্ষিত হয়েছে, যা পরিমাপ করা যায় ব্যাপক সংখ্যক বিচারকের স্বল্পতা ভারতের বিভিন্ন হাইকোর্টসমূহে।
ভারতের বর্তমান হাইকোর্টের সংখ্যা ২৫ টি। এই হাইকোর্টে স্বীকৃত বিচারকের সংখ্যা ১,১১৪। এরমধ্যে ৮৪০জন স্থায়ী বিচারপতি বাদবাকি ২৭৪ অতিরিক্ত বিচারপতি, কিন্তু বর্তমানে প্রায় ৩৩৩ জন বিচারপতির পদ শূন্য। ফলে ভারতের উচ্চ আদালতগুলোতে মামলার সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ভারতের সুপ্রিম কোর্টের সাথে সরকারের সঙ্গে বিচারপতির নিয়োগের বিষয়ে মতপার্থক্য হওয়াতে সরকার বিচারপতি নিয়োগ দানের ক্ষেত্রে ধীরে চলো নীতি গ্রহণ করেছে । ফলে গণতন্ত্র দুর্বল অবস্থার দিকে ধাবিত হচ্ছে। সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
উন্নয়নশীল অর্থনীতির জন্য ভারতীয় গণতন্ত্র একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ। আমাদের দেশসহ আরো বহু দেশে বিচার ব্যবস্থার ক্ষেত্রে ভারতকে পর্যবেক্ষণ করে। বিগত কয়েক বছর যাবৎ ভারতীয় বিচার বিভাগের সাথে নির্বাহী বিভাগের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যেই চলছে। এমন অবস্থা চলতে থাকলে এই বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশটির গণতন্ত্র দ্রুত দুর্বল অবস্থায় পতিত হবে।
- লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফল। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।