আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড ও ক্রেতাদের আচরণ প্রশ্নবিদ্ধ; উপেক্ষিত শ্রমিক স্বার্থ
রানা প্লাজার পরবর্তী সময়ে পোশাক কারখানার মালিকরা এ খাতের সংস্কারে প্রচুর পরিমাণে বিনিয়োগ করেছেন। তবে ব্যাপক সংস্কারের পরেও আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড এবং ক্রেতাদের ক্রয়াদেশ বাতিল ব্যবসায়িক অনুশীলনকে 'প্রশ্নবিদ্ধ' করছে। সেই সাথে তৈরি পোশাক শিল্পের নিয়োজিত শ্রমিকদের বিরাট সমস্যায় ফেলে দিচ্ছে।
চীনের পর বিশ্বের শীর্ষ পোশাক রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ইউরোপীয় ও আমেরিকান ক্রয়াদেশের উপর অনেক বেশি নির্ভরশীল।
চলমান করোনাভাইরাস সংকটের মধ্যেও বাংলাদেশ সরকার ও শিল্প নেতারা বিভিন্ন স্তরে আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড ও ক্রেতাদের আদেশ বাতিল করার বিষয়টি তুলে ধরা শুরু করেছেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন জানান, এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড ও ক্রেতারা ৩১৮ কোটি ডলারের ক্রয়াদেশ বাতিল বা স্থগিত করেছেন। যার ফলে এক হাজার ১৫০টি কারখানার প্রায় ২৩ লাখ শ্রমিক ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, 'ব্র্যান্ডগুলোর কাছ থেকে এমন ধরনের আচরণ গ্রহণযোগ্য নয় যা শ্রমিকদের অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেয়। গত ছয় বছরে বাংলাদেশের কারখানাগুলো এ খাতে প্রচুর পরিমাণে বিনিয়োগ করেছে।'
বাংলাদেশের পোশাক কারখানা মালিকেরা বিশ্বব্যাপী বিখ্যাত ব্র্যান্ড এবং ক্রেতাদের কাছ থেকে আরও ভালো ক্রয়াদেশ পাওয়ার জন্য এ খাতে বিনিয়োগ করেছে, বলেন তিনি।
শ্রমিকদের কঠোর পরিশ্রমের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, 'তবে, চলমান সঙ্কটের মুহূর্তে ব্র্যান্ডগুলো তাদের ক্রয়াদেশ বাতিল করেছে বা ক্রয়াদেশ ও উৎপাদিত পণ্যের বিপরীতে অর্থ দিতে অনিচ্ছা প্রকাশ করছে বা আংশিক পরিশোধের প্রস্তাব দিচ্ছে। যা নৈতিকতা বিরোধী।
লাখ লাখ শ্রমিকের অক্লান্ত পরিশ্রমের ওপরই ব্র্যান্ডগুলোর সব সম্পত্তি দাঁড়িয়ে আছে। এসময় শ্রমিকদের যখন ব্র্যান্ডের মালিকদের বেশি সমর্থন প্রয়োজন তখন তাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা না করার আহ্বান জানান তিনি।
ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, 'আমরা আশা করি আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলো তাদের ব্যবসায়িক নৈতিকতা বজায় রাখবে। শিপমেন্টের জন্য অপেক্ষায় থাকা পণ্যগুলোর ক্রয়াদেশ বাতিলকরণ, আংশিক প্রদান বা অর্থ না দিলে দীর্ঘমেয়াদী ব্যবসায়িক সম্পর্কের ক্ষেত্রে হুমকি হিসাবে দেখা দিচ্ছে। যা একইসঙ্গে অমানবিক এবং অনৈতিক।
যুক্তরাজ্য-ভিত্তিক খুচরা বিক্রেতা
বৈশ্বিক বাণিজ্য ও সরবরাহ শৃঙ্খলা রক্ষায় ব্রিটিশ সরকারকে পদক্ষেপ নেওয়ার ও নেতৃত্ব দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে সম্প্রতি ব্রিটিশ অর্থমন্ত্রী এবং ব্রিটিশ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যবিষয়ক মন্ত্রীকে চিঠি পাঠিয়েছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ এমপি রুশনারা আলী।
তিনি চিঠিতে উল্লেখ করেন, 'অনেক বহুজাতিক পশ্চিমা প্রতিষ্ঠান বাণিজ্যিক চুক্তি বাতিল করায় বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প (আরএমজি) খাতের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প খাতে ৩৭০ কোটি ডলারের ক্রয়াদেশ বাতিল হয়েছে।
যার প্রায় ২৪০ কোটি পাউন্ডের বাণিজ্যিক চুক্তি ছিল যুক্তরাজ্যভিত্তিক খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান এএসডিএ, নিউ লুক, এডিনবার্গ উলেন মিল, পিককস, স্পোর্টস ডাইরেক্ট অ্যান্ড আরবান আউটফিটার্স ইত্যাদির সঙ্গে।
ব্রিটিশ এমপি রুশনারা আলী বলেন, চীনের পর বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ পোশাক উৎপাদনকারী দেশ। এ সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়লে করোনা ভাইরাসের মহামারির এ সময়ে বিশ্বে পিপিই উৎপাদন সক্ষমতা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
এ অবস্থায় বৈশ্বিক বাণিজ্য ও সরবরাহ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে যুক্তরাজ্যকে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা নিতে হবে, বলেন তিনি।
যেসব ব্রিটিশ কোম্পানি কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে তাদের প্রয়োজনীয় সহায়তা দিয়ে তাদের সরবরাহকারীদের সঙ্গে দেয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারে সেজন্য যুক্তরাজ্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান ব্রিটিশ পার্লামেন্টের এ এমপি। 'এর ফলে যারা আমাদের যুক্তরাজ্যের হাই-স্ট্রিট পণ্য সরবরাহ করছে তাদেরকে সুরক্ষিত রাখা যাবে।'
তিনি বলেন, বড় বহুজাতিক সংস্থাগুলো যাদের অর্থ প্রদানের সক্ষমতা আছে তাদের চুক্তি থেকে সরে আসা নৈতিকভাবে নিন্দনীয়।
এর ফলে শ্রমিকরা তাদের একমাত্র আয়ের উৎসও হারিয়ে তাদের পরিবার নিয়ে ক্ষুধার ঝুঁকিতে পড়েছে। তাদের কাজের ফলে সম্ভাবনাময় দেশগুলোকে অস্থিতিশীল করছে এবং বিশ্ব মন্দা থেকে পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলেন, রুশনারা আলী।
এক চিঠিতে তিনি জানিয়েছেন, এতে বিশ্বব্যাপী সরবরাহ ব্যবস্থা ব্যাহত হচ্ছে, ব্যবসায়িক সংঘাতের ফলে স্থানীয় অর্থনীতি ভেঙ্গে পড়ছে এবং লাখ লাখ শ্রমিক তাদের চাকরি হারাতে হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক ঐকমত্য
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনকে নেদারল্যান্ডসের বৈদেশিক বাণিজ্য ও উন্নয়ন সহযোগিতা বিষয়ক মন্ত্রী সিগ্রিড কাগ জানিয়েছেন তৈরি পোশাক শিল্পের সরবরাহ ব্যবস্থা যাতে ব্যাহত না হয় সে ব্যাপারে কাজ করবে ডাচ সরকার।
ডাচ ক্রেতারা বাংলাদেশের তৈরি পোশাক কারখানার কাছ থেকে তাদের ক্রয়াদেশ বাতিল বা স্থগিত করবে না বলে বাংলাদেশকে আশ্বাস দিয়েছে নেদারল্যান্ডস।
তবে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) এক কর্মকর্তা ইউএনবিকে জানিয়েছেন, ডাচ ব্র্যান্ডগুলো ইতোমধ্যে ১৯ কোটি ২৬ লাখ ডলারের ক্রয়াদেশ বাতিল করেছে।
অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, আমাদের আন্তর্জাতিকভাবে ঐক্যমত্য তৈরি করা দরকার যে সঙ্কটের সময়ে আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড এবং ক্রেতাদের কাছ থেকে এধরনের ব্যবসায়িক অনুশীলন ঠিক নয়।
তিনি বলেন, ইস্যুগুলো আলোচনায় নিয়ে আসার ক্ষেত্রে বিদেশে বিশেষত ইউরোপীয় দেশ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশ মিশনগুলোর ভূমিকা রয়েছে।
বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, সরকার ও বিভিন্ন দেশে থাকা বাংলাদেশ মিশনগুলোকে প্রচারণা চালাতে হবে যাতে শ্রমিকদের অধিকার এবং মালিকদের বিনিয়োগের স্বার্থ রক্ষা করে বাংলাদেশের পণ্যগুলোর চাহিদা বাড়ানো যায়।
বাংলাদেশের সারা বছরের রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮৩ শতাংশ আয় আসে তৈরি পোশাক শিল্প থেকে।
বাংলাদেশ পোশাক রপ্তানির মাধ্যমে ৫০০০ কোটি মার্কিন ডলার আয়ের প্রত্যাশা করছে। যা এখন প্রতিবছর প্রায় ৩২০০ কোটি ডলারেরও বেশি।
বাংলাদেশ সরকার আরএমজি খাতকে মজুরি প্রদানের জন্য ৫৮ কোটি ৮০ লাখ ডলার প্রণোদনার প্যাকেজের ঘোষণা করেছে। এ খাতে প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক নিয়োজিত রয়েছে যার বেশিরভাগ হলেন নারী।