ঈদ স্পেশাল | ফ্র্যাঙ্ক সিনাত্রা হ্যাজ আ কোল্ড
১৯৬৫ সালের শীতকালে এস্কয়ার ম্যাগাজিন থেকে গে টেলিসকে লস অ্যাঞ্জেলেসে পাঠানো হলো গায়ক ফ্র্যাঙ্ক সিনাত্রাকে নিয়ে একটি প্রোফাইল লেখার জন্য। কিন্তু সিনাত্রা তখন অন্য খেয়ালে—কাউকে সাক্ষাৎকার না দেওয়ার মনস্থ করে আছেন। তার ওপর ভুগছেন ঠান্ডায়। গে হাল ছেড়ে না দিয়ে লস অ্যাঞ্জেলেসে পড়ে রইলেন—আশা, সিনাত্রা হয়তো মত পাল্টাবেন। সিনাত্রার বন্ধুবান্ধব, সহকর্মী, পরিবারের মানুষজনের সঙ্গে আলাপ করতে শুরু করলেন তিনি। সে সঙ্গে নিয়মিত সিনাত্রাকে বিভিন্ন জায়গায় অনুসরণও বাদ দিলেন না। তার ফলাফল হিসেবে পাঠকেরা পেলেন ম্যাগাজিনের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি উদযাপিত এক অনন্য সাধারণ রচনা: ফ্র্যাঙ্ক সিনাত্রা হ্যাজ আ কোল্ড। ১৯৬৬ সালের এপ্রিল মাসে এস্কয়ার ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয় গে'র লেখাটি। বাংলায় সংক্ষেপিত ও পরিমার্জিত অনুবাদ করেছেন সুজন সেন গুপ্ত।
এক হাতে বার্বনের গ্লাস আর অন্য হাতে সিগারেট নিয়ে বারের এক কোনে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছেন ফ্র্যাঙ্ক সিনাত্রা। তার দুপাশে অন্ধকারে আধো-আধোভাবে দুই সোনালি চুলের তরুণীকে দেখা যাচ্ছে, সিনাত্রা মুখ খুলে কিছু বলবেন—এ আশায় বসে আছেন তারা। কিন্তু সিনাত্রা কথা বললেন না, সেদিন পুরো সন্ধ্যাটাই তিনি চুপচাপ কাটিয়েছিলেন। কিন্তু বেভারলি হিলসের এ ব্যক্তিগত বারটিতে সিনাত্রাকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি বাস্তব দুনিয়া থেকে আরও বেশি দূরে সরে গেছেন। সিগারেটের ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন আধা অন্ধকারের মধ্য দিয়ে সামনের একটি বড় কক্ষের দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি। ওই দুই তরুণী ও আশেপাশে থাকা সিনাত্রার চার পুরুষ বন্ধু জানতেন, গায়ক সাহেব যদি নিজে থেকে কথা বলতে না চান, তাহলে তার সঙ্গে জোর করে আলাপ পাড়তে যাওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।
একটি সিনেমায় কাজ করছেন সিনাত্রা, মাঝপথে সিনেমাটি নিয়ে তার বিতৃষ্ণা ধরে গেছে। তাই কাজটা শেষ করতে পারলেই বাঁচেন। ২০ বছর বয়সী মিয়া ফারোর সঙ্গে তার প্রেম নিয়ে চারপাশে ছড়িয়ে পড়া প্রচারণা নিয়েও তিনি ক্লান্ত। সিবিএস টেলিভিশনে সপ্তাহ দুয়েক পরে তার জীবনী নিয়ে একটি ডকুমেন্টারি প্রচার হবে, সেখানে নাকি তার ব্যক্তিগত জীবনের নানা দিক দেখানো হবে; এমনকি মাফিয়া বসদের সঙ্গে তার বন্ধুত্বের কথাও ওই ডকুমেন্টারিতে ইঙ্গিত করা হতে পারে। এনবিসিতে 'আ ম্যান অ্যান্ড হিজ মিউজিক' শীর্ষক এক অনুষ্ঠানে তাকে উপস্থিত থাকতে হবে। ওই অনুষ্ঠানে ১৮টা গান গাইতে হবে সিনাত্রাকে; কিন্তু তার কণ্ঠ এখন দুর্বল, আহত, আর অনিশ্চিত । ফ্র্যাঙ্ক সিনাত্রা অসুস্থ। তিনি যে অসুখের শিকার, তা বেশিরভাগ মানুষ রোগ হিসেবে তুচ্ছই জ্ঞান করবেন। কিন্তু সেটা যখন সিনাত্রাকে পেয়ে বসে, তখন সিনাত্রা এক তীব্র মনোপীড়ন, গভীর বিষণ্ণতা, আতঙ্ক, এমনকি ক্রোধে আচ্ছন্ন হয়ে যান। ফ্র্যাঙ্ক সিনাত্রার ঠান্ডা লেগেছে।
ঠান্ডায় আক্রান্ত সিনাত্রা যেন ছবি ছাড়া পিকাসো, তেল ছাড়া ফেরারি—তবে সে সবের চেয়েও করুণ। কারণ এ ঠান্ডা তার মহার্ঘ রত্ন, তার কণ্ঠস্বরকে কেড়ে নেয়, ছিনিয়ে নেয় তার আত্মবিশ্বাস। আর এ ঠান্ডা কেবল তার মননের ওপরেই ভার বসায় না, তার আশেপাশের মানুষেরা যারা তার জন্য কাজ করেন, তার সঙ্গে বসে পান করেন, তাকে ভালোবাসেন, তার ওপর নির্ভর করেন, তাদের জীবনকেও আক্রান্ত করে। ঠান্ডায় ধরা সিনাত্রা আমেরিকার বিনোদন জগতে ছোটখাটো একটা কাঁপুনি ধরিয়ে দিতে পারেন। ঠিক যেমনটা কোনো মার্কিন রাষ্ট্রপতির হঠাৎ অসুস্থতা তার দেশের অর্থনীতিকে নাড়িয়ে দিতে পারে।
কারণ সিনাত্রা এখন জড়িয়ে গেছেন অনেক কিছুতে। তার সঙ্গে জড়িয়ে গেছে অনেক মানুষও। সিনাত্রার ফিল্ম কোম্পানি, রেকর্ড কোম্পানি, ব্যক্তিগত এয়ারলাইন, মিসাইল যন্ত্রাংশের ফার্ম, দেশজুড়ে থাকা রিয়াল এস্টেট ব্যবসা, নিজের ৭৫ জন ব্যক্তিগত কর্মচারী—এসব কেবল তার ক্ষমতার একটা অংশ। তিনি বোধহয় আমেরিকায় এ মুহূর্তে একমাত্র মানুষ, যিনি যা চাইবেন তা-ই করতে পারবেন। কারণ তার অর্থ আছে, কর্মশক্তি আছে, আর নেই কোনো দৃশ্যমান অপরাধবোধ। এখন সময়টা তরুণদের, তারাই সবকিছুর দায়িত্ব বুঝে নিচ্ছে। কিন্তু যুদ্ধের আগের প্রজন্মের সিনাত্রা এখনো দিব্যি টিকে আছেন এ শক্তির খেলায়। ফ্র্যাঙ্ক সিনাত্রার সব ছিল, এরপর সব হারালেন, তারপর আবার সব ফিরে পেলেন। ফ্র্যাঙ্ক সিনাত্রা বুড়ো বোধ করেন না, তাকে দেখে বুড়ো মানুষেরা নিজেদের তরুণ মনে করেন।
কিন্তু এখন, বেভারলি হিলসের এ বারে দাঁড়ানো সিনাত্রা ঠান্ডায় কাবু। বার্বনে চুমুক দিচ্ছেন মাঝেমধ্যে, কিন্তু দেখে মনে হচ্ছে এ দুনিয়া থেকে অনেক দূরে নিজের কোনো জগতে ডুবে আছেন তিনি। এমনকি বারের আরেকটি কক্ষে স্টেরিওতে তার গলায় ইন দ্য উই স্মল আওয়ার্স অভ দ্য মর্নিং বেজে উঠলেও ভ্রুক্ষেপহীন রইলেন ফ্র্যাঙ্ক সিনাত্রা।
মিষ্টি এ গানটি দশ বছর আগে প্রথম রেকর্ড করেছিলেন সিনাত্রা। সিনাত্রার ভরাট গলায় এ গানের সাদাসিধে কথাগুলো আরও যেন অর্থবহ হয়ে উঠেছে। তার আরও অনেক ক্লাসিক গানের মতো এ গানটাও নিঃসঙ্গতা আর কামকে জাগ্রত করে। এ গানে কতজন প্রেম করেছে, কত রাতে গাড়ির স্টেরিওতে এ গান শুনতে শুনতে আদরে ডুবে গিয়েছে কত শত কপোতমিথুন; কোনো লেকের ধারের কটেজে, গ্রীষ্মের সন্ধ্যায় সৈকতের বালুকাবেলায়, নিরিবিলি পার্কে, বিলাসবহুল পেন্টহাউজে—এ গানের সুরে কত প্রেমিক প্রণয় যাচনা করেছে; দুটো প্রজন্ম এ গানের সুরে বিবশ, তার জন্য তারা সিনাত্রার ঋণে ঋদ্ধ।
বারের আরেক কক্ষে পুল খেলছেন সিনাত্রার অন্যতম ঘনিষ্ঠ বন্ধু লিও ডুরোশের। দরজার পাশে দাঁড়িয়ে সিনাত্রার প্রেস এজেন্ট জিম ম্যাহোনি। কাছেই বিশালবপু অভিনেতা ব্র্যাড ডেক্সটার।
বছর দুয়েক আগে সমুদ্রে ডুবে যাওয়ার সময় নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সিনাত্রাকে বাঁচিয়েছিলেন ডেক্সটার। সেই থেকে সিনাত্রার কাছের মানুষদের একজন তিনি—সিনাত্রার ফিল্ম কোম্পানিতে প্রডিউসারের জায়গাও লাভ করেছেন। সিনাত্রাকে বেশ চোখে চোখে রাখেন ডেক্সটার—বিশেষত সিনাত্রা যখন কারও সঙ্গে কথা বলেন, তখন আলাপ যেন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে না যায় সেদিকে বিশেষ নজর তার। সম্প্রতি তো বলেই দিয়েছেন: 'ওর জন্য আমি খুনও করতে রাজি।' কথাটা হুট করে নাটকীয় ঠেকলেও কাছের মানুষদের অনেকে সিনাত্রার জন্য অমন করেই ভাবেন। এ যেন সিনাত্রার ভেতরকার সিসিলিয়ান রূপটাই তাদেরকে অমন ভক্তি গদগদ হতে প্রস্তুত করে। আর এ অনুগত মিত্রদের জন্যও সিনাত্রা কম করেন না—অতি চমৎকার সব উপহার, ব্যক্তিগত দাক্ষিণ্য, তাদের খারাপ সময়ে উৎসাহ, ভালো সময়ে মিষ্টভাষণ বিনিময়—এ সবই জোটে ওই বিশেষ মানুষদের। তবে তারা একটা কথা সবসময় খুব ভালোমতো মনে রাখেন। তিনি সিনাত্রা। দ্য বস। ইল পাদ্রোনে।
নিউ ইয়র্কের জিলি'স সেলুনে গত গ্রীষ্মে সিনাত্রার এ সিসিলিয়ান দিকটির কিছুটা দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। নিউ ইয়র্কে গেলে এ সেলুনে বসে একটু গলা ভেজান সিনাত্রা। সেলুনের ভেতরের একটি কক্ষে তার জন্য বিশেষ একখানা চেয়ার বরাদ্দ থাকে। সেদিন রাতেও কাছের কয়েকজনকে নিয়ে সেলুনে বসে সময় কাটাচ্ছিলেন সিনাত্রা। বাইরে তখন অনেক মানুষের জটলা; এরা কেউ সিনাত্রার সাধারণ বন্ধু, কারও সঙ্গে নিছক চেনাপরিচয়, কেউ একেবারেই অপরিচিত। তারা সবাই সেলুনের দিকে এমনভাবে এগিয়ে গেলেন, যেন ওটা একটা মন্দির, আর তারা শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করতে এসেছেন। তাদের মধ্যে কেউ বুড়ো অভিনেতা, কেউ তরুণ অভিনেতা, কেউবা সাবেক প্রাইজফাইটার, অনেকে রাজনীতিবিদ। হাতে বেতের লাঠি নিয়ে একটা ছোকরাকেও দেখা গেল জমায়েতে। অপেক্ষমাণদের মধ্য থেকে এক স্থূলদেহী নারী জানালেন, ফ্র্যাঙ্ক সিনাত্রা যে তার ঘরের সামনে ১৯৩৩ সালে জার্সি অবজারভার পত্রিকা ছুঁড়ে মারত, সে কথা তার স্পষ্ট মনে আছে। এক মধ্যবয়সী দম্পতি ১৯৩৮ সালে রাস্টিক কেবিনে সিনাত্রার গান শুনেছিলেন, তখন তারা দিব্যি ধরতে পেরেছিলেন: 'সিনাত্রার ভেতর এলেম আছে!' কেউ কেউ তার গান শুনেছেন ১৯৩৯ সালে হ্যারি জেমসের ব্যান্ডে। আরেকজন নারীর মনে আছে কোনো একবার সিনাত্রার গায়ে আলেকজান্ডার ডরোগোকুপেটজ নামক এক আঠার বছরের ছোকরা কীভাবে টমেটো ছুড়ে মেরেছিল। ডরোগোকুপেটজেন কী হয়েছিল? তা অবশ্য ওই ভদ্রমহিলা মনে করতে পারলেন না।
সিনাত্রাকে নিয়ে এরকম কতই না স্মৃতি তাদের। জিলির সেলুনের সামনে তাদের এ অপেক্ষা কেবল একটু ভেতরে ঢোকার সুযোগ লাভের। কিন্তু সে সুযোগ আর হলো না। কেউ কেউ চলে গেলেন, কেউ বা থেকে গেলেন যদি ফাঁকতালে ঢুকে যাওয়া যায় এ আশায়। তারা কেবল সিনাত্রাকে এক পলক দেখতে চান। কিন্তু আশায় গুঁড়েবালি।
সিনাত্রার একান্ত কাছের কিছু বন্ধু জিলির সেলুনে ঢুকতে পারেন, সিনাত্রার কক্ষেও যাওয়ার সুযোগ হয় তাদের। তবে সবদিন তাদের কপালও খোলে না, কেউ কেউ না দেখেই ফিরে যান। আর যারা সিনাত্রার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করার কাছ পর্যন্ত যান, তারা হ্যান্ডশেক করেন না। তার বদলে তারা কেবল সিনাত্রার কাঁধ বা বাহুর ওপর হালকা স্পর্শ করেন। অথবা স্রেফ এমন দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকেন, যেখান থেকে সিনাত্রা দেখতে পাবেন। তাদের সঙ্গে চোখাচোখি হলে সিনাত্রা হয়তো চোখ নাড়িয়ে তাদেরকে চেনার কথা জানান দেবেন, অথবা মাথা নাড়বেন, অথবা এমনকি নাম ধরে ডাক দেবেন। এরপর তারা চলে যাবেন, কারণ তাদের কাজ হয়ে গেছে। তারা সিনাত্রাকে দেখেছেন, সিনাত্রাও তাদের দেখেছেন। তারা সিনাত্রাকে তাদের শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। এ আচার দেখে আমার মনে হলো, ফ্র্যাঙ্ক সিনাত্রা দুই অসম কালের দুই দুনিয়ায় যুগপৎ বাস করছেন। ফ্র্যাঙ্ক সিনাত্রা এ মানুষগুলোর চোখে 'উওমিনি রিসপেত্তাতি'—সম্মানিত ব্যক্তি।
ফ্র্যাঙ্ক সিনাত্রা নিজের মতো করে কাজ করেন। ক্রিসমাসের সময় বন্ধু ও পরিবারের জন্য উপহার নিজে বেছে নেন, তার ঠিক মনে থাকে কার জামার সাইজ কত, কে কোন গহনাটা ভালোবাসেন, কার পছন্দের রং কী। একবার এক সঙ্গীতজ্ঞ বন্ধুর বাড়ি ধ্বংস ও স্ত্রী মারা যাওয়ার পর তার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন সিনাত্রা। হাসপাতালের বিলের বাকি অর্থটুকু নিজে পরিশোধ করেছিলেন, বন্ধুকে নতুন বাড়ি করে দিয়েছেন। সে বাড়ির প্রতিটা অংশে তার নজর ছিল—ঠিকভাবে সব হচ্ছে তো। এ সিনাত্রাই আবার প্রচণ্ড রাগে ফেটে পড়বেন যদি তার এ কাছের বন্ধুরা তার কোনো কাজে ছোট্ট একটু ভুল করে। তাদের আনা কোনো উপহার যদি তার মারাত্মক অপছন্দের তালিকায় থাকে, তাহলে ও উপহার ছুঁড়ে ফেলতেও বাধে না সিনাত্রার। তার চারপাশে যারা কাজ করেন, তারা সবাই বিশালদেহী মানুষজন। কিন্তু তাদের সামনে সিনাত্রাকে কখনো একটুর জন্যও ম্রিয়মাণ হতে দেখা যায় না। তারা কখনো সিনাত্রার রাগের জবাব দেন না। কারণ সিনাত্রা ইল পাদ্রোনে।
সোনালি চুলের দুই তরুণীর দিকে তাকিয়ে কিছু বললেন সিনাত্রা। এরপর পুলরুমের দিকে হাঁটা ধরলেন। সারা ঘরজুড়ে বিলিয়ার্ড বলের ঠোকাঠুকির শব্দ। উঁচু একট টুলের ওপর ভর দিয়ে দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে ডানহাতে মদের গ্লাস ধরে চুপচাপ রইলেন সিনাত্রা। এ বারের তরুণ অতিথিরা সিনাত্রাকে এখানে দেখে অভ্যস্ত, তাই তারা সিনাত্রার আগমনে বিশেষ ভ্রুক্ষেপ করলেন না। ঘরের মধ্যে একটা তরুণ দল অবশ্য অন্যদের চেয়ে একটু ভিন্ন হয়ে ধরা পড়ছে—তাদের যেন বারের কোনো চমকেই আকর্ষণ নেই। এ দলের মাঝে ছোটখাটো গড়নের এক ছোকরা পুরো দল থেকে আলাদা হয়ে উঠেছেন—তার পাণ্ডুর নীলচে চোখ, ঈষৎ স্বর্ণকেশ, ও চৌকোনো চশমা। পরনে একটা বাদামি সুতির ফুলপ্যান্ট, সবুজ শ্যাগি-ডগ শেটল্যান্ড সোয়েটার, ট্যান সোয়েড জ্যাকেট, ও গেম ওয়ার্ডেনের বুট। ওই বুটজোড়ার দাম ৬০ ডলার।
টুলের ওপর বসে নাক টানতে টানতে ওই বুট থেকে চোখ সরাতে পারলেন না ফ্র্যাঙ্ক সিনাত্রা। প্রথমে কয়েকবার তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলেন, এরপর আবার তার জোড়াচোখ আটকে গেল বুটের ওপরে। ওই বুটের মালিক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খেলা দেখছেন, তার নাম হারলান এলিসন। সম্প্রতি এ লেখক দ্য অস্কার-এর একটি চিত্রনাট্যের কাজ শেষ করেছেন।
নিজেকে সামলাতে পারলেন না ফ্র্যাঙ্ক সিনাত্রা।
'হেই', কিছুটা রুক্ষ গলায় ডেকে উঠলেন তিনি। 'ওগুলো ইতালিয়ান বুট?'
'না,' এলিসন জবাব দিলেন।
'স্প্যানিশ?'
'না।'
'ওগুলো কি ইংলিশ বুট?'
'দেখুন তো মশায়, আমি অতশত জানি না,' সিনাত্রার দিকে ভ্রুকুটি করে একটু রুঢ় গলায় জবাব দিলেন এলিসন। তারপর আবার মুখ ফিরিয়ে নিলেন।
হঠাৎ পুলরুমে পিনপতন নীরবতা। লিও ডুরোশের তার কিউ স্টিক নিয়ে একটু ঝুঁকে ছিলেন, সেভাবেই থমকে রইলেন এক সেকেন্ডের জন্য। ওই কক্ষের সবাই মুহূর্তের জন্য যেন চলৎশক্তি রহিত হলেন। তারপর সিনাত্রা টুল ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন—সেই চিরপরিচিত ধীরস্থির, উদ্ধত ভঙ্গিতে হেঁটে এলিসনের সামনে এলেন। ঘরের ভেতর কেবল সিনাত্রার জুতোর শব্দ। এরপর এলিসনের দিকে তাকিয়ে, ভ্রুজোড়া একটু ওপরে বাঁকিয়ে, এবং ঠোঁটে চতুর হাসি ঝুলিয়ে জিজ্ঞেস করলেন: 'ঝামেলা পাকানোর আশা করছো নাকি?'
এক কদম পাশে সরে গেলেন হারলান এলিসন। 'দেখুন, আপনি কেন আমার সঙ্গে কথা বলছেন, তার কি কোনো কারণ আছে?'
'তোমার পোশাকাআশাক আমার পছন্দ হয়নি,' সিনাত্রার জবাব।
''আপনাকে ভিরমি খাওয়ানোর জন্য দুঃখিত,' এলিসন বললেন, 'কিন্তু আমি আমার পছন্দমতো পোশাক পরি।'
এবার ঘরের মধ্যে একটা গুঞ্জন শুরু হলো। কেউ একজন বলে উঠলেন, 'কাম অন, হারলান। চল এখান থেকে বেরোই।' লিও ডুরোশেরও ওই কথার সঙ্গে তাল মেলালেন।
কিন্তু জায়গায় দাঁড়িয়ে রইলেন এলিসন।
'কী করো তুমি?' সিনাত্রা জানতে চাইলেন।
'আমি একজন পাইপমিস্তিরি,' এলিসন বললেন।
'না, না। ও দ্য অস্কার লিখেছে,' আরেক তরুণ টেবিলের ওপাশ থেকে একটু চেঁচিয়ে বললেন।
'ও, তা-ই,' সিনাত্রার কণ্ঠ শোনা গেল, 'আচ্ছা, ওটা আমি দেখেছি, একেবারে যাচ্ছেতাই হয়েছে।'
'বড় অদ্ভুত,' এলিসন বললেন, 'কারণ তারা এখনো সিনেমাটা মুক্তিই দেয়নি।'
'তাও, আমি দেখেছি,' সিনাত্রা প্রত্যুত্তরে বললেন, 'এবং ওটা জঘন্য হয়েছে।'
ব্র্যাড ডেক্সটার ততক্ষণে দুশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠেছেন। এলিসনের সামনে তাকে দশাসই লাগছে। বললেন, 'কাম অন, কিড। আমি তোমাকে এ ঘরে দেখতে চাইনা।'
'এই যে,' ডেক্সটারকে থামিয়ে দিলেন সিনাত্রা, 'দেখছ না আমি ওর সঙ্গে কথা বলছি?'
ডেক্সটারের অবস্থা করুণ। এলিসনের দিকে ফিরে এবার পুরোদস্তুর নরম গলায় প্রায় কাতর কণ্ঠে বললেন, 'আমাকে যন্ত্রণা দিতে এত নাছোড়বান্দার মতো উঠেপড়ে লেগেছ কেন তুমি?'
পুরো ব্যাপারটা একটু হাস্যকররকমের হয়ে উঠছিল। মনে হলো, সিনাত্রা অর্ধেক রাশভারী মেজাজে ছিলেন, বাকিটা বোধহয় তার একঘেয়েমি কাটানোর ঈপ্সা থেকে উদ্ভূত। আরও কয়েকটা বাক্য চালাচালির পর এলিসন ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। ততক্ষণে পুরো ক্লাবে এ ঘটনার কথা ছড়িয়ে পড়েছে। ক্লাবের ম্যানেজার ঘটনা শুনে পগার পার। কক্ষে প্রবেশ করলেন সহকারী ম্যানেজার।
'কোট-টাই ছাড়া এ ঘরে আমি কাউকে দেখতে চাইনা,' তেতে উঠলেন সিনাত্রা।
মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে নিজের অফিসে ফিরে গেলেন সহকারী ম্যানেজার সাহেব।
পরের সোমবার। আকাশটা মেঘাচ্ছন্ন, দিনটাও বাড়াবাড়িরকমের ঠান্ডা। একটা সাদা টেলিভিশন স্টুডিওর ভেতরে শখানেকের বেশি মানুষ জড়ো হয়েছেন। এ কক্ষেই ঘণ্টাখানেকের মধ্যে এনবিসি ফ্র্যাঙ্ক সিনাত্রার প্রোগ্রামটি রেকর্ড করবে। সিনাত্রা তখনো এসে উপস্থিত হননি। সিবিএস-এর ডকুমেন্টারির মতো এ অনুষ্ঠান নিয়ে সিনাত্রার ভয়ের কারণ নেই, এখানে তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কোনো প্রশ্ন করা হবে না। তিনি স্রেফ তার ক্যারিয়ারের সেরা গানগুলো গাইবেন, মাঝখানে কিছু ক্লিপ আর বিজ্ঞাপন থাকবে। ঠান্ডা লাগার আগে সিনাত্রা প্রোগ্রামটি নিয়ে বিশেষ আগ্রহী ছিলেন। এ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তিনি একদল শ্রোতাকে যেমন আবার পুরোনো দিনগুলোতে নিয়ে যেতে চাচ্ছেন, তেমনি হালের রক-অ্যান্ড-রোলারদের মধ্যেও নিজের সুরকে ছড়িয়ে দেওয়ার একটা চেষ্টা আছে—ফ্র্যাঙ্ক সিনাত্রা দ্য বিটলস-এর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমেছেন।
'ফ্র্যাঙ্ক সিনাত্রা—আ ম্যান অ্যান্ড হিজ মিউজিক' প্রোগ্রামের জন্য প্রস্তুত নেলসন রিডল-এর ৪৩ জন মিউজিশিয়ান। ডুইট হেমিওন অনুষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছেন। ক্যামেরা ক্রু, টেকনিক্যাল টিম, নিরাপত্তা প্রহরী, বাডওয়াইজারের বিজ্ঞাপন দল সবাই উপস্থিত—কিন্তু সিনাত্রার এখনো দেখা নেই। ১১টা বাজার আগে স্টুডিওর পার্কিং লট ধরে সিনাত্রাকে হেঁটে আসতে দেখা গেল। দেখতে দিব্যি সুস্থ মনে হচ্ছে। স্টুডিওর ভেতরে সবাই যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন। কিন্তু ভদ্রলোক কাছে আসতেই সবাই আবার দমে গেলেন—ইনি ফ্র্যাঙ্ক সিনাত্রা নন, তার বডি ডাবল জনি ডেলগাডো। স্টেজে সিনাত্রার স্পটে ক্যামেরা ক্রুদের জন্য দাঁড়িয়ে থাকতেই আজ তাকে এখানে আনা হয়েছে।
মিনিটা পাঁচেক বাদে আদত সিনাত্রা স্টুডিওর ভেতর প্রবেশ করলেন। মুখটা ফ্যাকাশে, নীলচে চোখে জল জমে আছে বলে মনে হচ্ছে। ঠান্ডাটা এখনো তাকে ছাড়েনি, কিন্তু গান গাইবেন বলে স্থির করেছেন তিনি। কারণ প্রোগ্রাম স্থগিত হলে অনেক ডলার গচ্চা যাবে। আর তার সময়ের দামও অনেক। স্টুডিওতে প্রবেশ করার পর মিউজিশিয়ানরা তাদের বাদ্যযন্ত্রগুলো তুলে নিয়ে যার যার আসনে সোজা হয়ে বসলেন। কিছুক্ষণ অর্কেস্ট্রার সঙ্গে গলাটা ঝালিয়ে নেওয়ার পর ফ্র্যাঙ্ক সিনাত্রা গাইলেন ডোন্ট ওরি এবাউট মি। যে গলায় গাইলেন, তা-তে তিনি সন্তুষ্ট, কিন্তু কতক্ষণ এ কণ্ঠ ধরে রাখতে পারবেন, সে ব্যাপারে কিছুটা দুশ্চিন্তা ছিল।
একটু পর দৃশ্যপট বদলে গেল। কারণ সিনাত্রা তার মন বদলেছেন। রেকর্ডিংটা তার মনঃপূত হচ্ছিল না। কন্ট্রোল বোর্ডে থাকা ডুইট হেমিওনকে হাল আমলের রেকর্ডিং প্রযুক্তি ও পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা প্রসঙ্গে কতক্ষণ দুকথা শোনালেন। কথা বলতে বলতে হুট করে থেমে গেলেন; বোধহয় নিষ্প্রয়োজনীয় কথা বলে নিজের কণ্ঠকে ক্লান্ত করে তুলতে চান না। হেমিওন অবশ্য টুঁ শব্দটিও করলেন না, মনে হচ্ছিল সিনাত্রার সব কথা তিনি এক কান দিয়ে শুনে অন্য কান দিয়ে বের করে দিয়েছেন। খুবই শান্তভাবে প্রোগ্রামের আউটলাইনটা সিনাত্রাকে পড়ে শোনালেন। এর কয়েক মিনিট পরে ক্যামেরার পাশে ধরা ইডিয়ট কার্ড থেকে সিনাত্রাকে অনুষ্ঠানের সূচনাকথাগুলো পড়তে শোনা গেল। এরপর সেগুলোকে ক্যামেরার সামনে পড়ার প্রস্তুতি নিলেন তিনি।
প্রথমবার কয়েক লাইন পড়ে থেমে গেলেন। এরপর আবার রেকর্ডের চেষ্টা, এ যাত্রায় সফল। তারপর কয়েকটা গানের প্র্যাকটিস। তারপর গাইলেন ন্যান্সি। গানটা আবেগ দিয়ে গাইলেন সিনাত্রা। কারণ এ গানের সঙ্গে তার প্রথম তিন সন্তানের একজনের স্মৃতি জড়িয়ে আছে।
ইফ আই ডোন্ট সি হার ইচ ডে
আই মিস হার…
জি হোয়াট আ থ্রিল
ইচ টাইম আই কিস হার…
কতশতবার এ শব্দরাজি সিনাত্রায় গলায় প্রাণ পেয়েছে। কিন্তু স্টুডিওর ভেতরে সিনাত্রা যখন গাইছেন, তখন সবাই টের পাচ্ছে, সিনাত্রার ভেতরে বিশেষ একটা অনুভূতির জোয়ার বইছে। ঠান্ডালাগা গলা দিয়ে উষ্ণতা আর শক্তি নিয়ে গাইছেন তিনি। এ মেয়েটা তাকে আর যে কারও চাইতে অনেক বেশি বুঝত বলেই সবাই জানে। ন্যান্সির বয়স এখন ২৫। লস অ্যাঞ্জেলেসে একাই থাকেন, বাবার রেকর্ড কোম্পানির জন্য গাওয়া ও সিনেমা বানানো নিয়েই ব্যস্ত। সিনাত্রার সঙ্গে তার প্রতিদিনই দেখা হয়, দেখা না হলে ফোনে কথা হয়—হোক দুজনের মধ্যে দূরত্ব এক মহাদেশ। ন্যান্সির মা, সিনাত্রার প্রথম স্ত্রী ন্যান্সি বারবাটোর সঙ্গে সিনাত্রার সম্পর্ক খুব ভালো। ১৯৩৯ সালে তাদের বিয়ে হয়। বিচ্ছেদের পর আর কখনো বিয়ে করেননি প্রথম মিসেস সিনাত্রা। লস অ্যাঞ্জেলেসে ছোট মেয়ে, ১৭ বছর বয়সী টিনার সঙ্গে বাস করেন তিনি। দুজনের মধ্যে কোনো তিক্ততা নেই; সিনাত্রা আর ন্যান্সির একে অপরের মধ্যে শ্রদ্ধার সম্পর্ক, সেই সঙ্গে কিছুটা অনুরাগেরও।
'ওখানে কী এমন সামলাচ্ছ, ডুইট?'
কন্ট্রোল রুম থেকে ডুইট কোনো উত্তর দিলেন না।
'ওখানে কি পার্টি-টার্টি কিছু হচ্ছে নাকি, ডুইট?'
সিনাত্রা নিজের স্পটে দাঁড়ানো, দুহাত ভাঁজ করা, চোখ সোজা কন্ট্রোল রুমের ভেতরে হেমিওনের প্রতি। গলার সব প্রাণ আর শক্তি দিয়ে ন্যান্সি গেয়ে ফেলেছেন তিনি, এর পরের গানগুলো আর জমল না। কন্ট্রোল রুম থেকে হেমিওন বেরিয়ে সিনাত্রার দিকে গেলেন। কয়েক মিনিট পর দুজন একসঙ্গে কন্ট্রোল রুমে প্রবেশ করলেন। সিনাত্রার সামনে এতক্ষণ ধরে রেকর্ড করা টেপটা চালু করা হলো। মোটামুটি পাঁচ মিনিট দেখার পর থেকেই মাথা নাড়তে শুরু করলেন ফ্র্যাঙ্ক সিনাত্রা। তারপর ডুইট হেমিওনের দিকে ফিরে বললেন: 'যা হয়েছে সব ভুলে যাও। তুমি শুধু শুধু তোমার সময় নষ্ট করছ।' পর্দায় নিজের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, 'ওখানে যাকে দেখছ, ওটা ঠান্ডায় গলা বসে যাওয়া একটা মানুষ।' এরপর কন্ট্রোল রুম থেকে বেরিয়ে ঘোষণা দিলেন: সারাদিনের সব রেকর্ডিং বাতিল করতে হবে এবং তিনি পুরোপুরি ঠান্ডা থেকে মুক্তি না পাওয়া অব্দি রেকর্ডিং বন্ধ থাকবে।
হুহু করে খবরটা ছড়িয়ে পড়ল। প্রথমে সিনাত্রার কর্মচারীদের মধ্যে, তারপর সারা হলিউডে, জিলির সেলুনে, এমনকি হাডসনের অপর পাড়ে ফ্র্যাঙ্ক সিনাত্রার নিজের বাড়িতেও। বাবাকে ফোন করে সিনাত্রা বললেন, তার কাছে ভীষণ বাজে লাগছে। বাপ সিনাত্রাও জানালেন, তার শরীরটাও ভালো যাচ্ছে না—বাম হাত আর মুঠোটা যেন ক্রমশ শক্ত হয়ে আসছে। বছর পঞ্চাশেক আগে ব্যান্টামওয়েট বক্সিং করতেন ভদ্রলোক, তার আশঙ্কা বাঁ হাত দিয়ে বেশি বেশি হুক ছোড়ার দরুনই আজ হাতের এ অবস্থা। সিসিলির কাতানিয়ায় জন্মগ্রহণ করা মার্টিন সিনাত্রা "মার্টিন ও'ব্রায়েন" নামে বক্সিং করতেন।
সিনাত্রা মা ডলির জন্মও ইতালিতে, জিনোয়ায়। তবে দুই মাস বয়সে মা-বাবার সঙ্গে আমেরিকায় চলে আসতে হয় তাকে। রাজনীতিতে প্রভাবশালী ছিলেন তিনি, নিজের ইতালিয়ান পাড়া থেকে অনায়াসে ৬০০ ভোটের ব্যবস্থা করতে পারতেন। একবার এক রাজনীতিবিদকে বলেছিলেন মার্টিনকে হোবোকেন ফায়ার ডিপার্টমেন্টে নিয়োগ দিতে। তখন কর্মী নেওয়ার জন্য কোনো খালি পদ ছিল না। ডলি বলেছিলেন, 'তাহলে একটা পদ বানিয়ে নাও।' তেমনটাই হলো। এরপর কয়েক বছর পরে আবার নতুন অনুরোধ: এবার মার্টিনকে দমকলের ক্যাপ্টেন হিসেবে দেখতে চান তিনি। একদিন সেটাও হলো, এক রাজনীতিবিদ তাকে ফোন করে অভিনন্দন জানিয়ে মার্টিন সিনাত্রার ক্যাপ্টেন সিনাত্রা হওয়ার খবর দিলেন।
ডলির একমাত্র সন্তান ফ্রান্সিস আলবার্ট সিনাত্রা ১৯১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। সেদিন প্রায় মৃত্যুমুখে চলে গিয়েছিলেন নবজাতক সিনাত্রা। ডাক্তারের ভুলের কারণে তার ঘাড়ের বাম দিকে ফোরসেপের একটু আঁচড় লেগে যায়, সে দাগ আমৃত্যু বয়ে বেড়িয়েছেন ফ্র্যাঙ্ক সিনাত্রা। কখনো অস্ত্রোপচার করে দূর করার চেষ্টা করেননি।
ছয় মাস বয়সের পর থেকে দাদির কাছেই মানুষ হয়েছিলেন সিনাত্রা। ডলির তখন কাজের অনেক চাপ—একটি চকোলেট ফার্মে কাজ করতেন তিনি। নিজের কাজে এতটাই দক্ষ ছিলেন যে একবার অফিস থেকে তাকে প্যারিস অফিসে পাঠানোর প্রস্তাব দেওয়া হয় অন্যদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য। হোবোকেনের অনেকেই সিনাত্রাকে নিঃসঙ্গ বাচ্চা হিসেবে মনে করতে পারেন—বারান্দায় বসে প্রায়ই ঘণ্টার পর ঘণ্টা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতেন তিনি। কখনো বস্তির ছেলেদের সঙ্গে মেশেননি কিশোর সিনাত্রা, কখনো জেলে যাওয়ার মতো অপরাধ করেননি, সবসময় কেতাদুরস্ত হয়ে থাকতেন।
মা হিসেবে ডলি সিনাত্রা সন্তানের কাছ থেকে বাধ্য আচরণ প্রত্যাশা করতেন সবসময়। তিনি চেয়েছিলেন ফ্র্যাঙ্ক সিনাত্রা একজন বিমান প্রকৌশলী হবেন। কিন্তু একদিন ছেলের ঘরে বিং ক্রসবির ছবি দেখে যখন তিনি জানতে পারলেন তার ছেলে সংগীতশিল্পী হতে চায়, তখন ক্রোধে ফেটে পড়েছিলেন। সিনাত্রার দিকে একটা জুতাও ছুড়ে মারেন। পরে যখন বুঝতে পারলেন, ছেলে জিদ ধরে আছে—'মেজাজ একদম আমার মতো' বলে অবশেষে ছেলের সংগীতচর্চায় সমর্থন দিতে শুরু করেন।
রাস্টিক কেবিনে রাতের বেলা নিয়মিত গাইতেন সিনাত্রা। পরদিন সকালে নিউ ইয়র্ক রেডিওতেও তাকে শোনা যেত—তবে রেডিওতে গাইতেন তিনি নজরে আসার জন্য, ওখান থেকে টু-পাইস আসত না। এরপর হ্যারি জেমসের ব্যান্ডে গান গাওয়ার কাজ পেলেন। ১৯৩৯ সালের আগস্টে তার প্রথম রেকর্ড অল অর নাথিং অ্যাট অল জনপ্রিয় হয়। হ্যারি জেমস ও ব্যান্ডটির অন্য সদস্যদের সঙ্গে সিনাত্রার বিস্তর খাতির জমে উঠছিল। সবাই তাকে বেশ পছন্দ করত। কিন্তু টমি ডরসির কাছ থেকে প্রস্তাব পাওয়ার পর হ্যারি জেমসের ব্যান্ড ছেড়ে দিলেন সিনাত্রা। ডরসির ব্যান্ড সম্ভবত তখন দেশসেরা ব্যান্ড ছিল। নতুন জায়গায় তার মাইনে হলো সপ্তাহে ১২৫ ডলার। তবে হ্যারি জেমসকে ছেড়ে আসার পর বিরহযাতনায় ভুগেছিলেন সিনাত্রা।
সিনাত্রার বৈশিষ্ট্যই ছিল এমন। প্রিয় অনেক স্থান ত্যাগ করেছিলেন তিনি। সময় অপচয় না করার, এক প্রজন্মের মধ্যেই সবকিছু করার খিদে ছিল তার। ৩০ বছর বয়সের আগেই জীবনে অনেক অর্জন করে ফেলেছিলেন তিনি। আমেরিকায় ইতালীয় অভিবাসীদের স্বপ্নের বুনো জীবন যাপন করছিলেন ফ্র্যাঙ্ক সিনাত্রা। দ্য আনটাচেবলস নামক টেলিভিশন শোয়ে যখন গ্যাংস্টারদের বর্ণনা করার জন্য ইতালীয় নাম ব্যবহার করা হচ্ছিল, তখন স্পষ্টভাবে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন সিনাত্রা। ডলি সিনাত্রা গর্বভরে বলতেন, 'হ্যাঁ, আমার ছেলে আমার মতোই হয়েছে। আপনি ওর কথা না শুনলে সেটা সে সারাজীবন মনে রাখবে।' তবে মাকে দিয়ে যে সিনাত্রা ইচ্ছেমতো কিছু করাতে পারেন না, সে কথাও খোলাসা করে দিতে ভোলেন না ডলি।
পাম স্প্রিংয়ে এক সপ্তাহ কাটিয়ে লস অ্যাঞ্জেলেসে ফিরলেন ফ্র্যাঙ্ক সিনাত্রা। ঠান্ডা প্রায় কমে এসেছে। রাত নয়টার দিকে প্রাক্তন ন্যান্সির বাড়ি গেলেন, সেখানেই রাতের খাবার খেলেন দুই মেয়েকে নিয়ে। ছেলে ফ্র্যাঙ্ক সিনাত্রা জুনিয়রের সঙ্গে তাদের এখন খুব একটা দেখা হয়না বললেই চলে। ২২ বছরের জুনিয়র সিনাত্রা একটা ব্যান্ডে গান। বেশিরভাগ সময় হোটেলেই রাত কাটান, নাইটক্লাবে রাত দুটো পর্যন্ত সঙ্গীত শোনান। সিনাত্রার ছেলে হওয়ায় তার সঙ্গে তুলনাটা অবিচ্ছেদ্যভাবে যোগ হয়ে গেছে। অবশ্য জুনিয়রের গলা খারাপ না, দিনে দিনে আরও খুলছে।
সিবিএস-এর সিনাত্রাকে নিয়ে শোটি রাত ১০টায় শুরু হলো। পরিচালক ওয়াল্টার ক্রনকিট। মিনিট কয়েক আগে খাওয়াদাওয়া শেষ করে চেয়ার ঘুরিয়ে টেলিভিশনের দিকে মুখ করে বসেছে সিনাত্রা পরিবার। সিনাত্রার কাছের মানুষজনও একই কাজটা করেছে—সবাই প্রস্তুত ডকুমেন্টারি নামক সম্ভাব্য এ ঝড়টি উপভোগ করতে। সিনাত্রার আইনজীবী মিল্টন এ. রুডিন হাতে একটা সিগার নিয়ে চোখ-কান সর্বোচ্চ খোলা করে বসেছেন, যদি কোনো আইনি ফাঁকতাল পেয়ে যান সে আশায়। ব্র্যাড ডেক্সটার, সিনাত্রার প্রেস এজেন্ট জিম ম্যাহোনি, মেকাপ আর্টিস্ট এড পুচি, ইন্স্যুরেন্স ব্রোকার রিচার্ড ক্যারল, ভ্যালে জন লিলি—সবাই টেলিভিশন সেটের সামনে সিবিএস দেখার জন্য প্রস্তুত।
শেষ পর্যন্ত সব ভালোয় ভালোয় শেষ হলো। সিবিএস'র এ ডকুমেন্টারি নিয়ে হলিউডে যে আশঙ্কা ছড়িয়ে পড়েছিল, সেটাকে প্রতিটি মিনিটে ভিত্তিহীন করে তুলল ডকুমেন্টারিটি। যেমনটা গুজব ছড়িয়েছিল—সিনাত্রার প্রেম, মাফিয়া, ও ব্যক্তিজীবন নিয়ে নিয়ে নাক গলানো হবে ডকুমেন্টারিটিতে—তার কিছুই হলো না। শো শেষ হওয়া মাত্র টেলিফোনের মাতম, সবাই যে হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছেন সেটা জানাতে তৎপর। নিউ ইয়র্ক থেকে জিলির টেলিগ্রাম এল: 'আমরা দুনিয়া শাসন করি!'
পরদিন সকালে সিনাত্রা এনবিসি ভবনে তার গানের অনুষ্ঠান আবার রেকর্ড করতে গেলেন। বলা বাহুল্য, সেখানে তখন সবাই আগেরদিনের সিবিএস শো নিয়ে বিস্তর আলোচনা করছে। সে আলোচনায় সিনাত্রাও বাদ গেলেন না, কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে শোটি নিয়ে কথা বলার এক পর্যায়ে তিনি বললেন, 'সেই জমেছিল অনুষ্ঠানটা।' কিন্তু একইসঙ্গে সেদিন দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ অনুষ্ঠানটি নিয়ে প্রকাশিত এক লেখার সঙ্গে তাল মিলিয়ে তিনি বলে উঠলেন, 'তবে আর যা-ই বলো, গান নিয়ে এত কিছু না রেখে মানুষটার ওপর আরেকটু বেশি আলো ফেলতে পারত…' বন্ধুরা সবাই একমত পোষণ করে মাথা নাড়লেন। কেউ মনে করিয়ে দিলেন না, মানুষটাকে নিয়ে বেশি বলে ফেলার আশঙ্কায় কিছুদিন আগে এ শো নিয়ে সবাই কেমন উথালপাথাল করেছিল।
মিনিট দশেক পরে স্টুডিওর ভেতরে ঢুকলেন সিনাত্রা। এবার আর গাইতে গিয়ে গলা নিয়ে অপ্রস্তুত হলেন না তিনি। গানের ফাঁকে ফাঁকে দু-একটা কৌতুকও শোনাতে কার্পণ্য করলেন না। গান শেষ হওয়ার পর কন্ট্রোল রুমের ভেতর মনিটরে রেকর্ডিংটা দেখলেন। ভীষণ সন্তুষ্ট দেখা গেল সিনাত্রাকে, ডুইট হেমিওনের সঙ্গে হাত মেলালেন। তারপর সিনাত্রার ড্রেসিংরুমে হুইস্কির বোতল খোলা হলো। তখনো সারা দেশ থেকে সিবিএস-এর ডকুমেন্টারির প্রশংসা করে মানুষ ফোন করছেন। সিবিএস-এর প্রযোজক ডন হুইটের ওপর সিনাত্রা মারাত্মক রেগে ছিলেন দিন কয়েক আগে। হুইটও ফোন করেছিলেন। ম্যাহোনি যখন জিজ্ঞেস করলেন সিনাত্রাকে যে, হুইটকে ছোট্ট একটা ভদ্রতাসূচক নোট পাঠাবেন কি না—তখন সিনাত্রা উত্তর দিয়েছিলেন, 'চিঠির ভেতর দিয়ে একটা ঘুষি পাঠাতে পারবে?'
তিন সপ্তাহ বড্ড ঝড় গেছে সিনাত্রার ওপর দিয়ে। এবার একটু বিশ্রামের পালা। লাস ভেগাসে গিয়ে শরীরের সব ক্লান্তি উড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনাটা মন্দ না—তাই ব্যক্তিগত বিমানে চড়ে বসলেন সিনাত্রা। ক্যালিফোর্নিয়ায় পাহাড়, নেভাদার ফ্ল্যাট, তারপর মাইলের পর মাইল মরুভূমি পাড়ি দিয়ে দ্য স্যান্ডস হোটেল এবং ক্যাসিয়াস ক্লে-ফ্লয়েড প্যাটারসনের মুষ্টিযুদ্ধ।
সিনাত্রার গানের জোর কমে যাওয়ার পেছনে দ্বিতীয় স্ত্রী আভা গার্ডনারের প্রতি তার প্রাণপণ অনুরাগকে দায়ী করেছেন তার কিছু বন্ধু। আভা ছিলেন সিনেমা জগতের মহাতারকা, ওই সময় বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দরী নারীদের একজন। সিনাত্রার সাবেক একজন ম্যানেজার হ্যাংক সানিকোলার মতে, আভা সিনাত্রাকে ভালোবাসতেন, কিন্তু সিনাত্রা যেভাবে আভাকে ভালোবেসেছিলেন, আভা সিনাত্রাকে সেভাবে ভালোবাসতে পারেননি। 'সিনাত্রা ভালোবাসার চাহিদা নিরবচ্ছিন্ন। সারাদিনই সে প্রেমে ডুবে থাকতে চায়, চারপাশে মানুষের ভিড় দেখতে চায়,' বলেন হ্যাংক।
'আভা চাইত না সিনাত্রার বন্ধু, সহচরেরা তার আশেপাশে ঘুরঘুর করুক সবমসময়,' আরেক বন্ধু জানান। এজন্য সিনাত্রা মেজাজ খারাপ করতেন। ন্যান্সির সঙ্গে সংসার করার সময় সিনাত্রা পুরো ব্যান্ডকে বাড়িতে নিয়ে এলেও ন্যান্সি কিছু মনে করতেন না, কখনো অভিযোগ করেননি— লক্ষ্মী ইতালিয়ান স্ত্রীর মতো সবাইকে এক প্লেট করে স্প্যাগেটি বানিয়ে দিতেন তিনি। ১৯৫৩ সালে বিয়ের দুই বছর পর সিনাত্রা ও আভার বিচ্ছেদ হয়। শোনা যায়, ডলি একটা মিটমাটের আয়োজন করেছিলেন, কিন্তু আভা রাজি হলেও সিনাত্রা আগ্রহ দেখাননি। তখন অন্য নারীদের সঙ্গে তাকে নিয়মিত দেখা যেত। পরিস্থিতি ততদিনে বদলে গেছে, ছেলেমানুষি খোলস ছেড়ে সিনাত্রা তখন পরিণত মানুষে বদলে গেছেন।
ক্লে-প্যাটারসনের ম্যাচের পর সবাই সিনাত্রাদের শোয়ের টিকিট কাটতে লাইন দিয়ে দাঁড়ালেন। দ্য স্যান্ডস-এ ডিন মার্টিন-সিনাত্রা-জোয়ি বিশপের মিলিত স্টেজ পারফর্ম্যান্স মোটামুটি নিয়মিত ঘটনা। মাঝেমধ্যে স্যামি ডেভিস জুনিয়র তাদের সঙ্গে যোগ দেন। সেদিন গাওয়া শেষ হলে সিনাত্রা দলবল নিয়ে দ্য স্যান্ডস থেকে বের হলেন। তার এ দলে মোটামুটি জনা বিশেক সহচর। সবাই লাইন ধরে বিভিন্ন গাড়িতে উঠলেন, গন্তব্য অন্য কোনো ক্লাব। ঘড়ির কাঁটা তিনটায় গড়িয়েছে—রাতটা তখনো সজীব।
সবাই মিলে গেলেন দ্য সাহারায়। পেছনের দিকে লম্বা একটা টেবিলে দলবেঁধে বসে টেকো মাথার কমেডিয়ান ডন রিকলসের ভাঁড়ামো শুনতে লাগলেন। রিকলসের মুখে কিছু আটকায় না। সিনাত্রারা প্রবেশ করার পর তার মুখে হাসি খেলে গেল। নিউ ইয়র্ক থেকে জিলি উড়ে এসেছিলেন সিনাত্রার কাছে ভেগাসে, তার দিকে ইঙ্গিত করে রিকলস বলে উঠলেন, 'ফ্র্যাঙ্কের ট্রাক্টর হওয়ার অনুভূতি কী?... হ্যাঁ, সিনাত্রার সামনে হেঁটে হেঁটে তার রাস্তা পরিষ্কার করে জিলি।' এরপর সিনাত্রাতে লক্ষ্য করে তার খোঁচামারা কথার ফোয়ারা ছুটল। সেখানে বাদ গেল না সিনাত্রার তৃতীয় স্ত্রী মিয়া ফ্যারো, সিনাত্রার পোশাক, শিল্পী হিসেবে সিনাত্রার দম যে শেষ সেসব কথা। সিনাত্রা যখন হাসলেন, তার সঙ্গে সবাই হেসে উঠলেন।
প্রায় ঘণ্টাখানেক রিকলস তার বাক্যবাণ চালিয়ে গেল। সিনাত্রা হাসলেন, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে সবাই হাসলেন। এরপর সিনাত্রা উঠে দাঁড়ালেন, 'হয়েছে, এবার শেষ করো। বেরোতে হবে আমার।'
'চুপ থাকেন আর বসেন!' রিকি বলে উঠল। 'আপনার গান শুনতে হয়েছে আমাকে…'
'কার সঙ্গে কথা বলছ বলে মনে হচ্ছে তোমার?' সিনাত্রা চেঁচিয়ে ফিরতি প্রশ্ন করলেন।
'ডিক হেইমস,' রিকির কাছ থেকে জবাব এল। শুনে সিনাত্রা হেসে উঠলেন।
রাত চারটার দিকে সিনাত্রা সদলবলে দ্য সাহারা থেকে বের হলেন। সঙ্গীদের কারও হাতে হুইস্কির গ্লাস; ফুটপাথে হাঁটতে গিয়ে, গাড়িতে বসে চুমুক দিচ্ছেন তা-তে। সবাই আবার ফিরলেন দ্য স্যান্ডস-এ—সোজা জুয়াখেলার কক্ষে। শেষ রাত হলেও ভিড়ের কোনো কমতি নেই ভেতরে।
সিনাত্রা হাতে একটা বার্বনের গ্লাস নিয়ে ভিড়ের মধ্যে দিয়ে এগোলেন। সারারাতের উন্মাদনায় তার বন্ধুদের পোশাকআশাক তখন দলিতমথিত; কিন্তু সিনাত্রা তখনো ফুলবাবুর মতো আছেন। তার টাক্সিডো দেখে মনে হচ্ছে সদ্য পাট ভেঙে গায়ে জড়ানো হয়েছে, টাইটাও জায়গা থেকে একটুও নড়েনি, জুতায় কোনো দাগ নেই। যতই মদ পেটে পড়ুক, বা যত ঘণ্টাই ঘুম ছাড়া কাটুক না কেন—সিনাত্রা কখনো পুরোপুরি মাতাল হন না, তাল হারান না, হাঁটতে গেলে দোলেন না।
পকেট থেকে এক তাড়া নোট বের করলেন সিনাত্রা—বান্ডিলটা বেশ মোটা, তবে নোটগুলো পরিষ্কার। খুব ধীরে একটা একশ ডলারের নোট বের করে জুয়ার টেবিলে রাখলেন। দুটো কার্ডে ডিল করলেন ডিলার, তৃতীয় কার্ড নিলেন সিনাত্রা, ওভারবিড হলো, একশ ডলার খোয়ালেন।
মুখে ভাবান্তর হলো না, দ্বিতীয় আরেকটা একশ ডলারের নোট রাখলেন টেবিলের ওপর। হারলেন। এবার তৃতীয়টা। আবারও হারলেন। এরপর একসঙ্গে দুটো একশ ডলার ফেললেন, সেগুলোও ফেরত পেলেন না। ষষ্ঠ নোটটা রাখলেন, এটাও একশ ডলারের। বিধি বাম, আবারও হারলেন। এবার টেবিল ছেড়ে উঠলেন, ওপাশের মানুষটার দিকে তাকিয়ে মাথাটা একটু ঝোঁকালেন, বলে উঠলেন, 'গুড ডিলার।'
সিনাত্রার আশেপাশে ভিড় করা দলটি সরে জায়গা করে দিলো। সিনাত্রা হাঁটতে লাগলেন। একজন নারী তার পথরোধ করে অটোগ্রাফের জন্য একটুকরো কাগজ এগিয়ে দিলেন। সিনাত্রা সে কাগজে স্বাক্ষর করলেন, তরপর বললেন 'ধন্যবাদ আপনাকে।'
দ্য স্যান্ডস-এর বড় ডাইনিং রুমের পেছনের দিকে সিনাত্রার জন্য লম্বা একটা টেবিল বরাদ্দ করা থাকত। রাতের এ প্রহরে মানুষজনের ভিড় কমে এসেছে, সবমিলিয়ে বিশ-বাইশ জন হবে। সিনাত্রার দলটা টেবিলে বসে আরও কয়েক পেগ মদ ঢালল গলায়। তারপর খাবারের অর্ডার দিলো। এখানকার টেবিলটাও আকারে নিউ ইয়র্কে জিলি'র সেলুনের টেবিলের মতোই। লাস ভেগাসের এ হোটেলে আজকের রাতে যারা সিনাত্রার পাশে বসেছেন, তাদের অনেককেই জিলি'র ওখানে, ক্যালিফোর্নিয়ার কোনো রেস্তোরাঁয়, ইতালিতে, অথবা নিউ জার্সিতে—মোদ্দাকথা যেখানেই সিনাত্রা থাকেন—সেখানেই পাওয়া যায়। সিনাত্রা খেতে বসলে তার আস্থাভাজন বন্ধুরা তার সঙ্গেই থাকেন। সিনাত্রা যেখানেই থাকুন, সেটা যতই বনেদি হোক না কেন—তার সঙ্গে তার সহচরদের সবসময় দেখা যায়। কারণ সিনাত্রা এখন যত বড়ই হয়েই উঠুন না কেন, তারপরও তিনি এখনো ছোটবেলার সেই পাড়ার ছেলেটা—খানিকটা হলেও। পার্থক্যটা হলো, সিনাত্রা এখন সেই পাড়াতো সহচরদের সঙ্গে করে নিয়ে চলতে পারেন।
কিছু কিছু দিক থেকে এ আপাত-পরিবারটিই যেন সিনাত্রার গার্হস্থ্য জীবনের সবচেয়ে নিকটস্থ সত্তায় পরিণত হয়। ঘর আর পরিবার ছেড়েছিলেন বলে খুব সম্ভবত পাবলিক হোটেলের খাবার টেবিলের এটুকু পরিবারের বেশি কিছুতে তিনি নিজেকে জড়াতে চান না। তবে সেটাও নিশ্চিত করে বলা যায় না। কারণ প্রায়ই পরিবার প্রসঙ্গে এমন উষ্ণতাভরা গলায় কথা বলেন তিনি, প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে এত নিবিড় সম্পর্ক রাখেন—সিনাত্রা যে পরিবারের মায়ায় জড়াতে চান না, তাও তো নয়। আভা গার্ডনারের সঙ্গেও তার দস্তুরমতো বন্ধুত্বের সম্পর্ক। ইতালিতে ভন রায়ান'স এক্সপ্রেস-এর শ্যুটিংয়ের সময় তারা দুজন একসঙ্গে সময় কাটিয়েছিলেন। সেখানে পাপারাজ্জিরা পিছু লেগেছিল। সব পাপারাজ্জি মিলে সিনাত্রাকে একটি প্রস্তাব দিয়েছিল, আভা গার্ডনারের সঙ্গে ছবি তোলার পোজ দিলে তাকে ১৬ হাজার ডলার দেওয়া হবে। সিনাত্রা নাকি পাপারাজ্জি দলকে পাল্টা প্রস্তাব দিয়েছিলেন: তিনি যদি একটা পাপরাজ্জি হাত আর পা ভাঙতে পারেন, তাহলে তিনি তাদেরকে ৩২ হাজার ডলার দেবেন।
নিজের বাড়িতে মাঝেমধ্যে একা থাকতে পছন্দ করেন সিনাত্রা। ওই সময়টুকু তার পড়া ও চিন্তার জন্য বরাদ্দ। কিন্তু কখনো কখনো ফ্র্যাঙ্ক সিনাত্রাকেও একা হয়ে পড়তে হয়। দেখা গেল, তিনি আধডজন নারীকে ফোন করলেন, কিন্তু কোনো কারণে কাউকেই পেলেন না। তখন তিনি নিজের ভ্যালে জর্জ জ্যাকবসকে ফোন করেন।
'আজ রাতে বাড়িতে খাব, জর্জ।'
'কতজন খাবেন?'
'শুধু আমি,' সিনাত্রা বলেন। 'বেশি খিদে পায়নি, হালকা কিছু কোরো।'
সিনাত্রা এলে ডাইনিং রুমে তাকে খাবার দেবেন জ্যাকবস। তারপর সিনাত্রা তাকে ছুটি দিয়ে দেবেন। কিন্তু এরকম সন্ধ্যাগুলোতে সিনাত্রা যদি জ্যাকবসকে আরেকটু থাকতে বলেন, একটু পোকার খেলে যেতে বলেন, তাহলে জ্যাকবস খুশি হন। কিন্তু সিনাত্রা কখনো বলেন না।
সিনেমার শ্যুটিংয়ের সময় সিনাত্রা মাঝেমধ্যে একটু হালকা মেজাজে থাকেন, কিন্তু গান রেকর্ডের সময় তিনি মারাত্মক সিরিয়াস হয়ে ওঠেন। কারণ, সিনাত্রার মতে, গানের সময় নিন্দা-প্রশংসা একান্তই নিজের। কিন্তু সিনেমায় তো কতশত লোক জড়িয়ে থাকে।
ফ্র্যাঙ্ক সিনাত্রা যখন গাড়ি হাঁকিয়ে স্টুডিওতে যান, তখন গাড়ি থেকে নেমে স্টুডিও পর্যন্ত হাঁটাপথটা তাকে দেখলে মনে হয়, তিনি নেচে নেচে যাচ্ছেন। স্টুডিওতে গাওয়ার সময় সব যন্ত্র, প্রতিটা শব্দতরঙ্গ, সব মানুষকে ছাপিয়ে যান। এ যন্ত্রীদের অনেকেই সিনাত্রার সঙ্গে দীর্ঘ পঁচিশ বছর ধরে কাজ করেছেন। তার গলা যখন খোলে, সিনাত্রা তখন ভাবাবেশে ডুবে যান, সে রোমাঞ্চ ছড়িয়ে যায় পুরো স্টুডিও জুড়ে, অর্কেস্ট্রা থেকে কন্ট্রোল বুথ পর্যন্ত এক উত্তেজনা টের পাওয়া যায়—আজ রাতেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
যথারীতি রেকর্ড শোনানো হলো সিনাত্রাকে। সে সময় স্টুডিওতে প্রবেশ করলেন ন্যান্সি সিনাত্রা। বাপ-মেয়ে একসঙ্গে চুপ করে দাঁড়িয়ে সদ্য গাওয়া গানটা শুনলেন—যেন রাজা আর তার রাজকন্যা—সবাই হাততালি দিলেন গান শেষ হওয়ার পর। তারপর অর্কেস্ট্রা পরবর্তী গানের জন্য প্রস্তুতি নিল। এভাবে এক ঘণ্টা পর সেদিনের মতো যবনিকাপাত হলো।
যন্ত্রশিল্পীরা বাদ্যযন্ত্র ব্যাগে ভরলেন, গায়ে কোট চাপালেন, তারপর সিনাত্রাকে শুভরাত্রি জানিয়ে স্টুডিও থেকে বের হতে শুরু করলেন। সিনাত্রা তাদের সবার নাম জানেন, তাদের ব্যক্তিগত জীবনের অনেক কিছুই তার জানা—ঠিক যেমনটা তারাও সিনাত্রাকে জানেন। ফ্রেঞ্চ-হর্ন বাদক ছোটখাটো গড়নের ইতালিয়ান ভিনসেন্ট ডিরোসা বের হওয়ার সময় সিনাত্রা আটকালেন।
'ভিসেঞ্জো,' সিনাত্রা বললেন, 'তোমার খুকি কেমন আছে?'
'ভালো আছে, ফ্র্যাঙ্ক।'
'ওহ, সে তো আর এখন খুকি নয়, অনেক বড় হয়ে গেছে,' নিজেকে সংশোধন করলেন সিনাত্রা।
'হ্যাঁ, ও এখন ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে।'
'কী ভালো।'
'আমার মনে হয়, ফ্র্যাঙ্ক, ওর গানের গলাটাও আছে।'
এক মুহূর্ত চুপ হয়ে রইলেন সিনাত্রা, তারপর বললেন, 'হ্যাঁ, কিন্তু পড়ালেখাটা আগে শেষ করলে ওর জন্য ভালো হবে, ভিসেঞ্জো।'
মাথা নাড়ল ভিনসেন্ট ডিরোসা।
'হ্যাঁ, ফ্র্যাঙ্ক,' সে সায় দিলো, তারপর বলল, 'আচ্ছা, শুভরাত্রি, ফ্র্যাঙ্ক।'
'শুভরাত্রি, ভিসেঞ্জো।'
মাসের বাকি সময়টা দারুণ গেল। রেকর্ডিংয়ের কাজ কোনো বাধা ছাড়াই শেষ হলো, সিনেমার শ্যুটিংও গুটিয়ে এল, টেলিভিশন শো নিয়েও আর কোনো দুশ্চিন্তা রইল না। সিনাত্রা পরবর্তী কাজগুলো নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। দ্য স্যান্ডস-এ তাকে একবার যেতে হলো, ইংল্যান্ডে দ্য নেকেড রানার নামক নতুন একটি স্পাই ফিল্ম শ্যুট হওয়ার কথা ঠিক হলো, এর পরের মাসে আরও দু-তিনটে অ্যালবাম তৈরির কাজও পড়ল। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে সিনাত্রা ৫০ বছরে পা দিতে যাচ্ছেন…
লাইফ ইজ আ বিউটিফুল থিং
অ্যাজ লং অ্যাজ আই হোল্ড দ্য স্ট্রিং
আই'ড বি আ সিলি সো-অ্যান্ড-সো
ইফ আই শুড এভার লেট গো…
গাড়ি থামালেন ফ্র্যাঙ্ক সিনাত্রা। সড়কবাতি লাল হয়ে আছে। পথচারীরা দ্রুত তার উইন্ডশিল্ডের সামনে দিয়ে রাস্তা পার হলেন। কিন্তু যেমনটা সবসময় হয়, একজন পেরোলেন না। মেয়েটার বয়স বিশের কোঠায়, ফুটপাথের কিনারায় দাঁড়িয়ে সোজা সিনাত্রার দিকে তাকিয়ে আছে। বাম চোখের কোনা দিয়ে সিনাত্রা মেয়েটার অস্তিত্ব টের পাচ্ছেন, বুঝতে পারছেন—কারণ এরকমটা প্রায় প্রতিদিনই ঘটে—মেয়েটা কী ভাবছে: দেখতে তো তার মতো মনে হচ্ছে, কিন্তু আসলেই উনি তো?
বাতিটা সবুজ হওয়ার ঠিক আগে সিনাত্রা মেয়েটার দিকে ফিরলেন, তাকালেন সরাসরি তার চোখের দিকে। অপেক্ষা করে রইলেন ওপাশের প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য। তিনি নিশ্চিতভাবে জানেন, মেয়েটার মুখে একটা ভাবান্তর ঘটবে। হলোও তাই, সিনাত্রা মৃদু হাসলেন। মেয়েটাও হাসল, সিনাত্রা ততক্ষণে চলে গেছেন।