অপ্রয়োজনীয় সিজারিয়ান ডেলিভারি বন্ধে ‘গেমচেঞ্জার’ হতে পারেন মিডওয়াইফেরা
২০১৮ সালে মিডওয়াইফ সানজিদা খাতুন যখন সিরাজগঞ্জের কাজীপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মিডওয়াইফ হিসেবে জয়েন করেন, তখন সেখানে মাসে ডেলিভারি হতো ২০-২৫টি। কনসালটেন্ট থাকলে সিজারিয়ান ডেলিভারি (সি-সেকশন) করা হতো, না হলে রোগীদের রেফার করা হতো অন্য হাসপাতালে। বেসরকারি হাসপাতালে ডেলিভারি করাতে সিজারিয়ান ডেলিভারি করাতো অধিকাংশ রোগী। তবে এখন পরিস্থিতি একেবারে বদলে গেছে। কাজীপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এখন প্রতি মাসে ৭০-৮০টি নরমাল ডেলিভারি হচ্ছে। ইনস্টিটিউশনাল ডেলিভারি বাড়ায় উপজেলায় মাতৃমৃত্যুর হারও কমেছে।
সানজিদা খাতুনসহ চারজন মিডওয়াইফ কাজীপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কাজ করেন। তারা গর্ভবর্তী নারীদের এন্টিনেটাল কেয়ার দেয়ার পাশাপাশি হাসপাতালে ডেলিভারির জন্য উৎসাহিত করেন। এর ফলে প্রতি বছরই হাসপাতালে নরমাল ডেলিভারির হার ক্রমান্বয়ে বাড়ছে, কমেছে শিশুমৃত্যুও।
মিডওয়াইফ নিয়োগ দেয়ার পর সিরাজগঞ্জের মতো নরমাল ডেলিভারির সংখ্যা বেড়েছে রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। সেখানকার মিডওয়াইফ নুসরাত জাহান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "নরমাল ডেলিভারির জন্য মায়ের ব্যথা ওঠার পর আমরা ১০-১২ ঘণ্টা মাকে দেখাশোনা করি। বাচ্চা-মা কেমন আছে বারবার তদারকি করি। নরমাল ডেলিভারি সম্ভব না হলে তখন আমরা রোগীকে সিজারিয়ান ডেলিভারির জন্য রেফার করি, তবে সে হার খুবই কম।"
''আমাদের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৫টি ইউনিয়নের রোগী আসে। ৪ জন মিডওয়াইফ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও একজন ইউনিয়ন সাব-সেন্টারে সেবা দেই। আমাদের হাসপাতালে মিডওয়াইফ নিয়োগ দেয়ার আগে প্রতি মাসে ২-৩টা নরমাল ডেলিভারি হতো এখন তা বেড়ে ২০টি হয়েছে,'' যোগ করেন নুসরাত জাহান।
দেশে মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যু কমাতে ও নরমাল ডেলিভারির হার বাড়াতে মিডওয়াইফরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এর সাথে দরকার হাসপাতালে যথাযথ লেবার রুম ও প্রাইভেট হাসপাতালের ওপর নজরদারি।
অবস্টেট্রিকাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের (ওজিএসবি) সভাপতি অধ্যাপক ফেরদৌসী বেগম টিবিএসকে বলেন, "সিজারিয়ান ডেলিভারি কমিয়ে আনার গুরুত্বপূর্ণ একটি উপায় হলো মিডওয়াইফ তৈরি করা। মিডওয়াইফদের তৈরি করা হয় নরমাল ডেলিভারি করানো, এন্টিনেটাল ও পোস্টনেটাল কেয়ারের জন্য। একজন মিডওয়াইফ সর্বোচ্চ চেষ্টা করে নরমাল ডেলিভারি করানোর। আজ পর্যন্ত মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ডিস্ট্রিক্ট হাসপাতালে মিডওয়াইফ নেই। শুধু উপজেলাতে মিডওয়াইফ আছে। যেসব মিডওয়াইফের পদ খালি আছে সেগুলোতে নিয়োগ দিতে হবে, আরো মিডওয়াইফ তৈরি করতে হবে, তাহলে নরমাল ডেলিভারি বাড়ানো যাবে।"
তিনি বলেন, "ইনস্টিটিউশনাল যে ডেলিভারি হয় তার বেশিরভাগ হয় প্রাইভেট ইনস্টিটিউশনে। প্রাইভেট ইনস্টিটিউশনে নরমাল ডেলিভারি করাতে চাইলে আত্মবিশ্বাসী একটি টিম দরকার। একজন গাইনি বিশেষজ্ঞের পক্ষে দশ ঘণ্টা কোনো রোগীকে নিয়ে বসে থাকা সম্ভব নয়। দশ ঘণ্টা মা ও বাচ্চাকে যত্নে রাখার জন্য প্রশিক্ষিত ম্যানপাওয়ার (জুনিয়র ডাক্তার, মিডওয়াইফ, নার্স) দরকার, আলাদা আল্ট্রাসনোগ্রাম মেশিন লাগবে, যথাযথ লেবার রুম লাগবে। বেশিরভাগ প্রাইভেট ক্লিনিকে লেবার রুম নেই, তাদের টিম নেই। প্রত্যেকটা ক্লিনিকে যাতে লেবার রুম থাকে, টিম থাকে তা তদারকি করতে হবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে।"
ইউনাইটেড নেশনস পপুলেশন ফান্ডের তথ্য অনুযায়ী, গত এক দশকে বাংলাদেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ৮,৬৪৬ জন মিডওয়াইফ স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেছেন। এর মধ্যে ২,৫৫৭ জনকে সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। এছাড়াও বর্তমানে ৩৭৬ জন বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে কর্মরত আছেন। কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতেও প্রায় ৪০০ জন মিডওয়াইফকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
সংস্থাটি বলেছে, মিডওয়াইফরা এখন পুরো দেশের ৪০৭টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৮৬% সন্তান প্রসবে সাহায্য করছে।
দীর্ঘদিন ধরে সি-সেকশন ডেলিভারির বিষয়ে সচেতনতা তৈরিতে কাজ করছেন একটি আন্তর্জাতিক সংস্থায় কর্মরত জনস্বাস্থ্যবিদ ড. ইশতিয়াক মান্নান।
তিনি বলেন, "সিজারিয়ান সেকশন একটি জীবন রক্ষাকারী পদ্ধতি, এটি করার প্রয়োজন হয় মায়ের জীবন বাঁচানোর জন্য, যা মূলত ১৫% মায়ের জন্য। অপ্রয়োজনীয় সিজারিয়ান ডেলিভারি কিন্তু মাতৃমৃত্যু রোধে কোন ভূমিকা রাখছে না, বাংলাদেশে মাতৃমৃত্যু হার এখনো অনেক বেশি।"
"প্রাইভেট হাসপাতালে নরমাল ডেলিভারির হার নগণ্য। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাজ হচ্ছে মান নিয়ন্ত্রণ করা, যাকে সিজার করার দরকার নেই তাকে সিজার করা হচ্ছে। এটি বিরাট একটি অপরাধ কারণ একজন মানুষের শরীরে অপ্রয়োজনীয় সিজার করা হলে অনেক জটিলতা ও আর্থিক ক্ষতি হয়। ২০১৯ সালে সিজারিয়ান ডেলিভারি কমাতে সরকার যে গাইডলাইন তৈরি করেছে সেখানে মিডওয়াইফ তৈরির কথা থাকলেও বাস্তবে মিডওয়াইফ নিয়োগ দেয়ার হার কম। জেলা ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সহ বিভিন্ন স্বাস্থ্য খাতে ২০ হাজারের বেশি মিডওয়াইফ মোতায়েন করতে হবে", বলেন তিনি।
সি-সেকশন কমিয়ে আনতে ২০১৯ সালে হাইকোর্টের নির্দেশনার পর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যে গাইডলাইন তৈরি করেছে সেখানেও মিডওয়াইফ তৈরি ও প্রোপার লেবার রুমের বিষয়টি উঠে এসেছে।
'বাংলাদেশ ন্যাশনাল গাইডলাইনস অ্যান্ড টেকনিক্যাল স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড অপারেটিং প্রসিডিউরস ফর প্রমোশন অব নরমাল ডেলিভারি, এনসিউরিং লাইফ-সেভিং ইন্টারভেনশনস এন্ড প্রিভেনশন অব আননেসারি সিজারিয়ান সেকশনস' শীর্ষক নীতিমালায় বলা হয়েছে, প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিকের জন্য সার্টিফায়েড মিডওয়াইফ এবং ফাংশনাল লেবার রুম বাধ্যতামূলক করা উচিত।
বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে অনুযায়ী, ২০২২ সালে সি-সেকশনের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৫ শতাংশে, যা ২০১৭ সালে ৩৪%, ২০১৪ সালে ২৪% এবং ২০১১ সালে ১৮% ছিল। এছাড়াও সিজারিয়ান ডেলিভারির ৮৪% বেসরকারি হাসপাতালে এবং ১৪% সরকারিতে ঘটে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ অনুযায়ী, একটি দেশে সর্বোচ্চ ১০%-১৫% সিজারিয়ান ডেলিভারি থাকা উচিত, এর বেশি হলেই তা উদ্বেগজনক। সংস্থাটি সতর্ক করে বলে, অপ্রয়োজনীয় সিজারিয়ান ডেলিভারির কারণে মায়েদের শারিরীক ও আর্থিক ক্ষতি বাড়ছে।
নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ৫০০০ মিডওয়াইফের পদ সৃষ্টি করতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে। আগামী এক-দুই মাসের মধ্যে ১৫০০ মিডওয়াইফ নিয়োগ দেয়া হবে। পরে পর্যায়ক্রমে ৫০০০ মিডওয়াইফ নিয়োগ দেয়া হবে সারাদেশে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের 'মাতৃস্বাস্থ্য কর্মসূচি'র প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. আজিজুল আলীম বলেন, "সরকারি ও প্রাইভেট সব সেক্টরে আমরা গাইডলাইনটা বাস্তবায়ন শুরু করেছি করোনার পর থেকে। আমাদের ইনস্টিটিউশনাল ডেলিভারি বেড়েছে, সে কারণে সিজারিয়ান ডেলিভারি কিছুটা বেড়ে গেছে। আমরা এখন গাইডলাইন অনুযায়ী সব জায়গায় লেবার রুম প্রোটোকল থাকা এবং লেবার রুম ব্যবহারের বিষয়ে জোর দিচ্ছি। নরমাল ডেলিভারি বাড়াতে ট্রেনিং মডিউল তৈরি করেছি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল শাখা আমাদের সাথে কাজ করছে প্রাইভেট হাসপাতালে সিজারিয়ান ডেলিভারি কমাতে। যখন আমরা গাইডলাইনের পূর্ণ বাস্তবায়ন শুরু করবো তখন আশা করছি সিজারিয়ান ডেলিভারি কমবে।"